2141

09/21/2024 গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ ও এর চিকিৎসা

গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ ও এর চিকিৎসা

ডা. শাহজাদা সেলিম

৩১ মে ২০২১ ১৭:৪৩

গলগণ্ড বা ঘ্যাগ হলো অস্বাভাবিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থাইরয়েড গ্রন্থি। থাইরয়েড গন্থিটি গলার সামনের দিকের নিচের অংশে থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এটির অবস্থান দৃশ্যমান নয়। থাইরয়েড গ্রন্থির আকার অনেকটা প্রজাপতির মতো। দুইপক্ষের দুটি ডানার মতো অংশ (লোব) একটি সংক্ষিপ্ত ও দেহ (ইয়ামাথ) দিয়ে সংযুক্ত থাকে। গ্রন্থিটি যখন আকার-আয়তনে বড় হয় (গলগণ্ড) তখন তা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয় এবং খাবার সময় বা কথা বলার সময় এর নাড়াচাড়া বিশেষভাবে বুঝা যায়।

থাইরয়েড গ্রন্থিটি দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেহে যে কয়টি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি দেহের সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে, থাইরয়েড তাদের অন্যতম। এটি অন্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকেও প্রভাবিত করে। থাইরয়েড গ্রন্থিটি পক্ষান্তরে পিটুইটার (সামনেরটি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; যা আবার হাইপো থাইরয়েড গ্রন্থির নিয়ন্ত্রণে থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোন (টি৪ ও টি৩) নিঃসৃত হয়।

থাইরয়েড গ্রন্থি বিভিন্ন কারণে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হল পিটুইটারি গ্রন্থি হতে অধিকা কাজ করার নির্দেশপ্রাপ্ত হওয়া। আবার খাদ্যে আয়োডিনের অভাব থাকলেও থাইরয়েড গ্রন্থিটি ক্রমশ বড় হতে থাকবে। এছাড়া থাইরয়েড গ্রন্থির কিছু কিছু স্থানিক সমস্যার কারণে গ্রন্থিটি ক্রমশ বড় হতে থাকে। এর মধ্যে আছে নডুল, ক্যান্সার, হাইপার থাইরয়েজিম ও হাইপো থাইরয়েডজম।

বাংলাদশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহুসংখ্যক গলগণ্ড রোগ আছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এর প্রকোপ বেশি। আবার মহিলাদের মাঝে গলগণ্ডের হার পুরুষের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ বাদে অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকা, আলপম পর্বতের পাদদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট লেক এলাকা ও পার্শ্ববর্তী ভারতের হিমালয় পর্বতের আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচুর গলগণ্ডের রোগী দেখা যায়। সমুদ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে গলগণ্ড বেশি দেখা দেয়ার কারণ হলো- সমুদ্র থেকে যত দূরত্ব বাড়বে মাটিতে তত কম পরিমাণ আয়োডিন পাওয়া যাবে। আয়োডিনের এ দীর্ঘদিনের ঘাটতিতে থাইরয়েড গ্রন্থি ক্রমশ বৃহদাকার হতে থাকবে।

মাটিতে আয়োডিনের ঘাটতি বাদেও কিছু কিছু খাবার বেশি পরিমাণে এবং অনেক ধরে খেতে থাকলেও আয়োডিনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং গলগণ্ড হতে পারে। এ সব খাবারের মধ্যে আছে পাতা কপি, ব্রকলি, ফুলকপি, সয়া জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি। কিছু কিছু ওষুধও থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। থাইরয়েড নডুল, ক্যান্সার ও হাইপো থাইরয়েডিজম ও হাইপার থায়রয়েডিজমের জন্যও গলগণ্ড হতে দেখা যায়।

গলগণ্ডের লক্ষণসমূহ হঠাৎ করে শুরু হয় না; বরং অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে গলগণ্ড হতে থাকে। এর প্রধানতম লক্ষণ হলো গলার সামনের দিকের মাঝখানের নিচের অংশ বা দু’পাশ ফুলে উঠা। রোগী সাধারণত নিজে থেকে প্রথমে এ সমস্যাটি শনাক্ত করতে পারে না। তার বন্ধুবান্ধব বা ঘনিষ্ঠজন প্রথমে একবার গলার এ স্ফীতিকে শনাক্ত করে। এটি এত ধীরে ধীরে হয় যে, অন্য কেউ বলার পরও রোগী সন্দিহান থাকতে পারে এ ব্যাপারে। কিন্তু তারপর দেখা যাবে এ গ্রন্থিটি ক্রমশ বৃহদাকার হয়ে যাচ্ছে। থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্দি প্রাপ্তির সাথে সাথে খেতে বা ঢোক গিলতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। গলগণ্ড খুব বড় হলে শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা হতে পারে। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় ও গর্ভাবস্থায় গলগণ্ড সাময়িকভাবে আরো বড় হয়।

গলগণ্ড হাইপার থাইরয়েডিজমের হলে থাইরয়েড গ্রন্থির নিরসনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ রোগীর কিছু অটোইম্যুন রোগ থাকে যার মধ্যে গ্রেভ’স রোগ প্রধান। এ সব রোগে টিএসএইচ-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে টি৪ ও টি৩ হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। হাইপার থাইরয়েজিমের গলগণ্ডে উপর লক্ষণগুলোর সাথে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, অস্থিরতা, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, গরম অসহ্য লাগা, হাত কাপা ও ডায়রিয়া থাকতে পারে।

হাইপো থাইরয়েভিজমের কারণে গলগণ্ড হলে থাইরয়েড গ্রন্থির নিঃসরণ কমে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা সামলাবার জন্য থাইরয়েড গ্রন্থি আয়তন বাড়তে থাকে। আয়োডিনের স্টাটাড এর প্রধান কারণ। এছাড়া কিছু অটোইম্যুন রোগও এর জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে গলগণ্ডে সাধারণ লক্ষণগুলোর সাথে শারীরিক দুর্বলতা, অবসাদ, শীত সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি থাকতে পারে।

কিছু রোগীর ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যান্সারের জন্যও গলগণ্ড দেখা দিতে পারে। এ ক্যান্সার আবার মেয়েদের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর যাদের যৌবনের শুরুতে বার বার এক্সরে করতে হয়েছে তাদের থাইরয়েড ক্যান্সার বেশি হয়। থায়রয়েড ক্যান্সারের হার বরং কম এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সম্পূর্ণ রূপে সেরে যায়। যে কোনো বয়সে থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে; যদিও চার দশকের কাছাকাছি বয়সে বেশিসংখ্যক রোগীকে শনাক্ত করা হচ্ছে।

গলগণ্ড হয়েছে বা হচ্ছে মনে হলেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। আমাদের দেশের অনেকেই এ ব্যাপারটাতে বেশ অনীহা প্রকাশ করেন এবং এর জন্য রোগীকে ও তার পরিবারকে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। গলগণ্ডের সম্ভাব্য রোগীকে চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষায়, আল্ট্রাসনোগ্রাম থেকে শুরু করে বায়োপথি ও রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন আপটেক পরীক্ষা পর্যন্ত করতে পারেন।

গলগণ্ডের কারণ নির্ধারিত হওয়ার পর এর চিকিৎসা পদ্ধতি টিক করা হয়। গলগণ্ডের রোগীর থাইরয়েড গ্রন্থি যদি সামান্য একটু স্ফীত হয়ে থাকে এবং শুধুমাত্র পর্যাপ্ত আয়োডিন সরবরাহ করেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিছু যদি আয়োডিনের ঘাটার্ড জনিত হাইপোথারয়েডের গলগণ্ড বৃহদাকার হয়। তবে শুধুমাত্র আয়োডিন যোগ করে তেমন কোন উন্নতি আশা করা যাবে না। এক্ষেত্রে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থাইরয়েড গ্রন্থিকে অপারেশন করে বাদ দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এরই সাথে হরমোন খাওয়াতে হয় আজীবন। আর হাইপার থাইরয়েডিজমের কারণে গলগণ্ড হলে থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা কমাতে পারে- এমন ওজন দিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করা হয়। এদের ক্ষেত্রেও অপারেশন করে স্ফীত গ্রন্থিটি বাদ দেয়া জরুরি হয়ে পড়ে অনেক সময়। নিরীহ থাইরয়েড নডুল ওষুধ সংশোধনের চেষ্টা করাই শ্রেয়। আর থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যান্সার হলে দ্রুত অপারেশন করে পুরোটা গ্রন্থি ফেলে দেয়া হয়। এরপর আয়োডিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতিতে আয়োডিনের অভাবজনিত হাইপেথায়রয়েডিজম এং এর ফল স্বরূপ গলগণ্ড খুব বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ যেমন- বৃহত্তর রংপুর জেলা, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ (বিশেষ করে শেরপুর ও জামালপুর জেলা) জেলার বিপুলসংখ্যক নারী ও পুরুষ আয়োডিনের অভাবজনিত গলগণ্ডে ভুগছে। এদের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিনের ব্যবস্থা করতে পারলেই ব্যাপক জনগোষ্ঠী গলগণ্ডের হাত থেকে রেহাই পায়। সরকারিভাবে খাবার লবণে নির্দিষ্টমাত্রার আয়োডিন মেশানোর নির্দেশ দেয়া থাকলেও আমাদের অভিজ্ঞতা বিরূপ। বেশির ভাগ লবণেই আয়োডিন নেই কিন্তু এর দাম নেয়া হচ্ছে আয়োডিনযুক্ত লবণ হিসেবে। আর এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন।

সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ

 

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]