28187

03/14/2025 বিশ্বের কোথায় কীভাবে নৈতিক শিক্ষা অগ্রাধিকার পাচ্ছে

বিশ্বের কোথায় কীভাবে নৈতিক শিক্ষা অগ্রাধিকার পাচ্ছে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

১৯ জানুয়ারী ২০২৫ ১০:২৬

সুস্থ সমাজব্যবস্থা ও সুন্দর সামাজিক মনোভাব হলো আমাদের মস্তিষ্কের ন্যায়। তাই একে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদের সবার। সমাজে বসবাসরত প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ সামাজিকতা, সভ্যতা ও সভ্য রূপনীতি মানতে বাধ্য থাকবে—এমনটিই স্বাভাবিক। সমাজ সংস্করণের উন্নতি সাধন করার আগে দেশের সভ্যতার ভার বহন করে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও গুণাবলি।

সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে অনেক উদাহরণ রয়েছে। আমরা এখন অনেকটাই ইতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তে নেতিবাচক মনোভাব লালন করি এবং চর্চা করি। বিশ্বের সব ক্ষেত্রেই মানুষ এখন অনেক বিষয়ে নেতিবাচক মানসিকতায় ভরপুর। উন্নত দেশগুলো নিজেদের বাচ্চাদের ওইসব নেতিবাচকতা থেকে বের করে আনতে নানা ধরনের নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করছে।

আমরা প্রত্যাশা করি, সমাজের সব নেতিবাচকতা দূর হয়ে একটি স্বপ্নময় পৃথিবী সৃষ্টি হোক। বিশ্বজুড়ে শিশুশিক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা যায় যা প্রতিটি দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তবে সব দেশেরই একটি সাধারণ লক্ষ্য থাকে-শিশুদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করা এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করা।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, যা তাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ এবং ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শিশুদের প্রস্তুত করে তুলছে। ফিনল্যান্ড, জাপান ও সুইডেনের মতো দেশগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে চমকপ্রদ উদাহরণ হিসেবে সামনে চলে এসেছে।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। কারণ এখানে শিশুদের নৈতিক শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে শিশুদের স্বাধীন চিন্তা করতে এবং সৃজনশীল হতে উৎসাহিত করা হয়। সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর ওপর পরীক্ষার চাপ কমিয়ে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিশুরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিখতে পারে।

জাপানের শিক্ষাব্যবস্থাতেও শিশুদের প্রাথমিকভাবে শিষ্টাচার, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং সম্মানের বিষয়গুলো শেখানো হয়। ১৯৯০-এর দশকে জাপান নৈতিক শিক্ষাকে শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পায়। নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। পরে নৈতিক শিক্ষা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা আজও কার্যকর হচ্ছে।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের অভিবাদন জানাতে ছাত্ররা ক্লাসের শুরু এবং শেষে মাথা নত করে নম্রভাবে ‘ওহাইও গোজাইমাস’ (সুপ্রভাত) বা ‘আরিগাতো গোজাইমাস’ (ধন্যবাদ) বলে। এখানে মূলত বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা এবং নম্রতা শেখানো হয়। জাপানের স্কুলগুলোয় ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই শ্রেণিকক্ষ এবং স্কুল প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে। জাপানের স্কুলগুলোয় দলগত কাজ এবং সহযোগিতার চর্চা। মাল্টিমিডিয়া বা পাঠ্যসূচির মাধ্যমে শিশুদের বাস্তব জীবনের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

যদি কোনো সহপাঠী অনুপস্থিত থাকে, তার নোট বা কাজ অন্য কেউ নিয়ে রাখে এবং পৌঁছে দেয়। এর মাধ্যমে সেখানে বন্ধুত্ব, সহানুভূতি এবং দায়িত্বশীলতা শেখানো হয়। যদি কোনো শিশু ভুল করে, তাকে সরাসরি ক্ষমা চাইতে শেখানো হয় এবং নিজের ভুল মেনে নিতে উৎসাহিত করা হয়।

জাপানে নৈতিক শিক্ষা তত্ত্বের মাধ্যমে নয়, বরং বাস্তব কাজের মাধ্যমে শেখানো হয়। পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা, সম্মান এবং দায়িত্ববোধ শেখানো শিশুদের ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক আচরণের উন্নয়ন ঘটায়। এটি তাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ব্যবহারিক ও নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।

সুইডেন একটি উন্নত দেশ যেখানে শিশুদের শিক্ষার মান এবং মানসিক বিকাশকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নৈতিক শিক্ষা শিশুদের সঠিক এবং ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়, তাদের নৈতিক মূল্যবোধ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা তৈরি করে। সেখানে স্কুলে ক্লাসের সমস্যার সমাধানে শিশুরা একত্রে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়।

যেমন কীভাবে সবাই মিলে খেলাধুলার সময় বেশি মজা করা যায়। শিশুদের মতামত প্রকাশের অধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শেখানো হয়। পরিবেশ সচেতনতা এবং টেকসই উন্নয়নের গুরুত্ব পরিবেশ রক্ষা এবং পুনর্ব্যবহার (Environmental Responsibility) স্কুলের কার্যক্রমে শিশুরা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে প্রজেক্ট তৈরি এবং বর্জ্য পৃথকীকরণ (waste segregation) শেখে।

স্কুলের প্রকল্পে শিশুদের দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে দেওয়া হয়, যেখানে প্রত্যেকের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। খেলার মাঠে ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ (Friendship Bench) ব্যবহার করা হয়, যেখানে কোনো শিশু একাকী বোধ করলে বসে থাকে। অন্য শিশুরা সেখানে গিয়ে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে।

স্কুলের খাবার পর শিশুদের নিজেদের ট্রে নিজে পরিষ্কার করা এবং শ্রেণিকক্ষ গোছানোর দায়িত্ব নিতে বলা হয়। ক্লাসে বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং বিভিন্ন উৎসব সম্পর্কে জানানো হয়। শিক্ষকরা শিশুদের সমস্যার মীমাংসা করার কৌশল শেখান, যেমন অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং নিজ অবস্থান শান্তভাবে ব্যাখ্যা করা।

রাশিয়া সোভিয়েত যুগের পতনের পর নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হতো। ওইসময় পরিবেশ পরিস্থিতি নেতিবাচক দিকে চলে যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে রাশিয়ায় শিশুদের নৈতিক শিক্ষা খুবই গুরুত্ব সহকারে দেওয়া হয় এবং এটি শৈশব থেকেই শুরু হয়। এই শিক্ষা তাদের সামাজিক আচরণ, দেশপ্রেম, সম্মানবোধ এবং নৈতিক দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

রাশিয়ায় নৈতিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় (৬-৭ বছর) থেকে শুরু হয়। তবে, এর মৌলিক ধারণাগুলো পারিবারিক পরিবেশ এবং পূর্বশৈশব শিক্ষাকেন্দ্র থেকে শেখানো হয়। শিশুরা যখন কিন্ডারগার্টেনে যায়, তখন থেকেই সামাজিক ও নৈতিক আচরণের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মূল্যবোধের অভাব এবং সমাজে দুর্নীতি ও অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

সিঙ্গাপুর একটি বহুজাতিক দেশ, যেখানে সামাজিক সমন্বয় এবং সহনশীলতার চর্চা অপরিহার্য মনে করে Character and Citizenship Education (CCE) নামে একটি নির্দিষ্ট বিষয় পড়ানো হয় শিশুদের। স্কুলে প্রতিটি শিশুকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয় এবং বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম বা পটভূমির ভিত্তিতে কোনোরকম বৈষম্য করা হয় না। বাচ্চারা ছোট বয়স থেকেই পরিবেশ বান্ধব আচরণ শেখে। বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য স্কুলের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, সেখানে নিত্য কাজ। এছাড়াও প্রতিনিয়ত শিশুদের পরিবেশ সচেতনতা এবং টেকসই উন্নয়নের চর্চার দিকে মনোযোগ বাড়ানো হয়।

আমরা যদি নিজেদের নেতিবাচকতা থেকে মুক্ত হতে চাই, তাহলে শিশুদের নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয়ের উন্নতি খুবই জরুরি। নৈতিকতার মূল্যবোধ যেকোনো ব্যক্তিকে নিজের ও অন্যদের কাছে দায়বদ্ধ করে রাখে। নির্মম সত্যিটা হলো এই, আমরা জেনে-বুঝেও আমরা আমাদের শিশুদের নৈতিক শিক্ষায় বড় করে তুলতে পারছি না।

বৃদ্ধ মা-বাবা ইদানীং সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে উঠছেন। আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক থাকছে না। পারস্পরিক আন্তরিকতা, হৃদ্যতা নেই। আপনজনের দেখাশোনা করছি না। দুর্বিষহ এমন সব পরিস্থিতিতে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটা আজ ভয়ানক নড়বড়ে। ভবিষ্যতের সুখের আশায় শিকড়কে অস্বীকার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও আর মানুষ করছে না। মাত্রাহীন অবক্ষয়কে যে করেই হোক ঠেকাতেই হবে, না হলে মানুষের অর্জিত জ্ঞান-শিক্ষা এসবের আর মূল্য থাকবে না।

বর্তমানে বাংলাদেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে অনৈতিক কর্মকাণ্ড একেবারে শূন্যের কোটায় চলে এসেছে। ইদানীং দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় ও আসামাজিক কার্যক্রমের কোনো না কোনো নমুনা আমরা লক্ষ্য করছি। যেগুলোর কোনো কোনোটি ইতিমধ্যেই ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে।

সাধারণত মনে করা হয়, শিক্ষকেরা হবেন আদর্শ, তাদের আচরণ হবে অন্যদের কাছে অনুকরণীয়। শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরাই শুধু পাঠ নেয় না, সমাজও অনেক কিছু শেখে। কিন্তু আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় এমন স্তরে এসে পৌঁছেছে যে এখন শিক্ষকরাও নানা ধরনের অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে উঠছেন। অনেক শিক্ষকই এখন আদর্শের রোল মডেল হতে পারছেন না।

প্রায়ই শুনে থাকি বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত কোনো কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের প্রলোভনের মাধ্যমে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। শিক্ষার্থীরাও অনেক সময় নিরুপায় হয়ে এ ধরনের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করতে পারে না। পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছালে সেগুলোর কোনো কোনোটি আমাদের সামনে আসে। তবে এটি নিশ্চিত যে, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগই আমরা জানতে পারি না। অবশ্য কতিপয় ক্ষেত্রে এসব ঘটনার সুস্পষ্ট সত্যতা অনুমান করা গেলেও সেগুলো যথাযথভাবে প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নই একমাত্র উন্নয়ন নয়। সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিবোধ সৃষ্টি এবং তার উন্নয়ন ঘটানোর প্রেক্ষিতে সব স্তরের এবং সব ধরনের অপকর্মের প্রতিরোধ ঘটানো সম্ভব। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের মূল্যবোধ চর্চার উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী প্রক্রিয়াতে সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ করা যেতে পারে। শুধু গণমাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিকভাবে সচেতন করে তোলাই নয়, এ বিষয়ে আলাদাভাবে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করার সময় এসেছে।

আমি মনে করি, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাত্রাকে টেকসই করে তুলতে এবং তরুণদের রক্ষা করতে সামাজিক অবক্ষয় থেকে দেশকে রক্ষা করার কাজে মনোযোগী হতে হবে। এটি রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্বও বটে। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক ভূমিকা পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]