29253

03/12/2025 ভয় দেখানোর দিন শেষ

ভয় দেখানোর দিন শেষ

জুবায়ের হাসান

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:১৩

ট্রাম্প-মোদির বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পকে দিয়ে বাংলাদেশকে ভয় দেখানোর কর্মসূচি ব্যর্থ হলো। দিল্লি শুরু থেকেই হাসিনার উৎখাত মেনে নিতে পারছিল না। হাসিনার পতনের পর থেকেই ভারতের কয়েকটি শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে নানান মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল।

তবে তা একে একে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে থাকে। অবশেষে তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভয় দেখানোর কৌশল বেছে নেয়। কয়েক মাস যাবৎ সেই চেষ্টা চলে অবিরাম। নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে ভারতীয় লবির কারসাজিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে টুইট করেন। এতে ভারতীয় ও আওয়ামী শিবির উভয়ই উৎফুল্ল হয়।

এরপর ৫ নভেম্বর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় তারা আরও উদ্যমী হয়। তবে ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি আমন্ত্রিত না হওয়ায় তাদের উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে। অবশেষে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকরের বিশেষ চেষ্টা তদবিরে ট্রাম্প-মোদি শীর্ষ বৈঠক আয়োজন চূড়ান্ত হয়।

তবে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয় না। বরং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য শুল্ক আরোপের খড়্‌গ থেকে ভারতকে বাঁচানোই ছিল বৈঠকের মুখ্য উদ্দেশ্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন পেতে নরেন্দ্র মোদি তার সফরের আগেভাগেই কিছু নজরানা পেশ করেন। নরেন্দ্র মোদি স্বেচ্ছায় প্রায় ৩০টি মার্কিন পণ্যের ভারতের বাজারে প্রবেশ সহজ করতে সেসবের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১৩ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে ট্রাম্প-মোদির দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের ঠিক পূর্বক্ষণে প্রায় ২০ মিনিট ধরে একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব (question and answer session) অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একজন ভারতীয় সাংবাদিক ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন, 'বাংলাদেশ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? কারণ এটা স্পষ্ট যে বাইডেন প্রশাসনের আমলে মার্কিন ডিপস্টেট (সরকারের নেপথ্যের শক্তি) বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এমনকি, মুহাম্মদ ইউনূসও জুনিয়র সরোসের (জর্জ সরোসের পুত্র) সাথে দেখা করেছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়টি নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমাদের ডিপস্টেটের কোনো ভূমিকা ছিল না। এটা এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী (মোদি) দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এবং সত্য বলতে, শত শত বছর ধরে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে, আমি তা পড়ে জেনেছি। কিন্তু আমি বাংলাদেশ (প্রসঙ্গে জবাব দানের জন্য মাইক্রোফোন) প্রধানমন্ত্রীর (মোদি) কাছে ছেড়ে দিচ্ছি।’

অতঃপর ডোনাল্ড ট্রাম্প মাথা ঝুঁকে নরেন্দ্র মোদির দিকে ইশারা করেন। মজার বিষয় হলো, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো জবাব না দিয়ে এক লাফে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন।

ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্পের শেষ বাক্য ছিল, বাট আই উইল লিভ বাংলাদেশ টু প্রাইম মিনিস্টার (But I will leave Bangladesh to prime minister)। কিছু মিডিয়া এই ইংরেজি বাক্যের বিকৃত অনুবাদ করে লিখেছে, বাংলাদেশকে আমি প্রধানমন্ত্রীর (মোদি) হাতে ছেড়ে দিলাম।

মিডিয়ার এমন চাতুরীর উদ্দেশ্য মূলত ট্রাম্পকে দিয়ে বাংলাদেশকে ভয় দেখানোর কৌশল। এই কৌশলে এমন একটা ভাবধারা তৈরির চেষ্টা করা হয়ে থাকে যেখানে বলা যাবে, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। হাসিনা পরবর্তী যুগের ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে করণীয় কৌশল নির্ধারণে নরেন্দ্র মোদির পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদির গৃহীত পদক্ষেপে ট্রাম্পের যথেষ্ট সায়-সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতেই কিছু মিডিয়া তাদের সংবাদ ভাষ্যের শিরোনাম করে, বাংলাদেশের বিষয়টি নরেন্দ্র মোদির ওপর ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত ট্রাম্পের, মোদির হাতে বাংলাদেশকে ছাড়লেন ট্রাম্প ইত্যাদি।

বস্তুত নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের বেশ আগে থেকেই এক ধরনের মিডিয়া হাইপ (মিথ্যা উচ্ছ্বাস) সৃষ্টি করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রচার করা হয়, ট্রাম্পের সাথে মোদির বৈঠকে উঠবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, মোদি ট্রাম্পের বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে কী কথা হবে দুজনের ইত্যাদি।

২০ বছর আগে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ ইস্যুতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়েছিল। সে সময়কালে বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র এড়িয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। ফলে সেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধের এক প্রকার পরিসমাপ্তি ঘটে।

বাইডেন প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর মার্কিন তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে হাসিনার দিকেই ফিরতে বাধ্য করেন। এই লব্ধ অভিজ্ঞতার সুখস্মৃতি থেকেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যেন কোনো এক সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের ইউনূস সরকারের ওপর বেজায় নাখোশ হয়ে পড়েন।

হাসিনা উৎখাতের পর একটা গল্প খাড়া করা হয়েছিল। তা হলো, বাইডেন প্রশাসনের ডিপস্টেট হাসিনা উৎখাতের রিজিম চেঞ্জে জড়িত ছিল। একে পুঁজি করেই সুপরিকল্পিতভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন ভারতীয় ওই সাংবাদিক। বাইডেন প্রশাসন, ডিপস্টেট এবং সাথে জুনিয়র সরোস মানে জর্জ সরোসের পুত্র অ্যালেক্স, এই তিন বিষয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভীষণ খেদ-বিদ্বেষ রয়েছে।

মার্কিন ধনকুবের জর্জ সরোসকে তো ট্রাম্প একেবারেই দুশমন গণ্য করেন। এমনকি, ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন যে তার মামলার বিচারকের সাথে জর্জ সরোসের যোগসাজশ রয়েছে। সুতরাং ভারতীয় ওই সাংবাদিক বাংলাদেশ বিষয়ে প্রশ্ন করার সময় জেনেবুঝেই এই তিনটি নাম জুড়ে দিয়ে ট্রাম্পকে মূলত আবেগীয় ফাঁদে (ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল) ফেলতে চেয়েছেন, যাতে ট্রাম্প ইউনূসবিরোধী কড়া বক্তব্য রাখেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ শান্তভাবেই রিজিম চেঞ্জের সব গল্প উড়িয়ে দেন। সেই সাথে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে প্রকারান্তরে প্রচ্ছন্নভাবে বুঝিয়ে দেন যে ভারত শত শত বছর ধরে বাংলাদেশ অঞ্চলের ওপর আধিপত্য (হেজিমনি) বিস্তারের চেষ্টা করে গেছে। অতএব সব দায় ভারতের, আমেরিকার নয়।

মোদির সাথে সাক্ষাতের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে যথেষ্ট ব্রিফিং নিয়েছিলেন। এমনটাই সব রাষ্ট্রপ্রধানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য প্রচলিত রীতি ও কৌশলী ব্যবস্থা। সুতরাং বাংলাদেশ বিষয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যায়। তার মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ইস্যুতে মোদি ভারতের সাথে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র আর কথা বলবে না। ফলে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের কাঁধে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রাখার যে শঙ্কা এতদিন ধরে বিরাজ করছিল তারও অবসান হলো।

নির্বাচনী ময়দানে ভোট কুড়ানোর কৌশল থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে টুইট করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আর সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের কথা বলতে চাইবেন না এই সহজ সমীকরণ অনুধাবন করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া ভারতের এই ব্যর্থতার বড় কারণ ছিল মূলত ইউনূসের কূটনীতি।

প্রথমত মোদি-ট্রাম্প বৈঠকের একদিন আগে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে হাসিনার অপকর্মের দলিল প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত ইলন মাস্ক ও মোদির বৈঠকের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে দুবাইয়ে বসে ইউনূস ইলন মাস্কের সাথে ভার্চুয়াল মিটিং সেরে ফেলেছিলেন। ওই মিটিংয়ে ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের বাংলাদেশে বাজারে আত্মপ্রকাশ নিয়ে আলোচনা হয়। এই দুই ঘটনাই মূলত বাংলাদেশবিরোধী ভারতীয় আয়োজন ব্যর্থ করে দেয়। অবশ্য এরপরও ভারত নাছোড়বান্দা হয়েই রয়েছে।

ট্রাম্প-মোদি বৈঠকের পর দুজনে দাঁড়িয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তবে সেখানে একবারের জন্য বাংলাদেশ প্রসঙ্গে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু এর পূর্বে বাংলাদেশ বিষয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যকে ঘিরে দুনিয়াব্যাপী ভারতকে লজ্জা শরমের ঢেউ গ্রাস করে বসে। তা মুক্ত হতে ভারত মরিয়া হয়ে ওঠে।

ট্রাম্প-মোদির যৌথ সম্মেলন শেষে অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির একটি একপাক্ষিক সংবাদ সম্মেলন। বিক্রম মিশ্রি সেখানে ভারতের মুখ রক্ষার চেষ্টা করেন। তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জানান, ‘বাংলাদেশ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে তার উদ্বেগ এবং ভারত কীভাবে এই পরিস্থিতি দেখে তা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের প্রত্যাশার কথাও ট্রাম্পের কাছে তুলে ধরেছেন মোদি। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন দিকে যাবে যাতে আমরা গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্কের দিকে যেতে পারি। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আছে এবং প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।’

এভাবে বিক্রম মিশ্রি পুনরায় ট্রাম্পকে দিয়ে বাংলাদেশকে ভয় দেখানোর সেই একই কৌশল অবলম্বন করলেন। কিন্তু বিক্রম মিশ্রির এসব কথা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারবে কীভাবে? কেননা প্রকাশ্যে সবাই দেখলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন ভিন্ন কথা।

জুবায়ের হাসান ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]