হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুশয্যায় শুয়েও যিনি গান গাওয়ার জন্য উঠে বসেন তিনিই প্রতুল মুখোপাধ্যায়। এটা কেবলমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব। কিছুক্ষণ পরে যার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে তিনি বিছানায় বসে গান ধরেছেন, ‘আমি বাংলায় গান গাই—আমি বাংলার গান গাই’। তাই তো তিনি আমাদের প্রাণের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
এই গানই তাকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সমধিক পরিচিত করেছে। এই গান নিয়েই তিনি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অভিমানেও ফেটে পড়েছেন। কখনো বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবেন না বলে প্রতিজ্ঞাও করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের তার এবং তার গানের প্রতি ভালোবাসার যে টান, সে টান তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি।
সময়টা ২০১০ সাল। এর আগের বছর থেকে উদীচী তার প্রতিষ্ঠাতা শিল্পীসংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে শুরু করেছে সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা। উদীচীর উদ্দেশ্য সত্যেন সেনকে স্মরণ করার পাশাপাশি সংগীতের এই ধারাটি ছড়িয়ে পড়ুক মানুষের মাঝে, প্রতিষ্ঠা পাক অন্য আর পাঁচটি গানের ধারার মতো।
প্রথমবারের অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন উপমহাদেশের আরেক গণসংগীতের কিংবদন্তী অজিত পাণ্ডে। অত্যন্ত সফল সে আয়োজনের পর উদীচী সিদ্ধান্ত নেয় প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আসার। কিন্তু আমরা জানতে পারলাম উনি খুব অভিমানী এক শিল্পী এবং বাংলাদেশের ওপর তার ভীষণ অভিমান। তিনি বাংলাদেশে আসবেন না, তাকে আনা প্রায় অসম্ভব।
সেই অসম্ভব কাজটি অবশ্য সম্ভব হয়েছিল। প্রতুলের অভিমান ভেঙে বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার সাগরে স্নান করাতে সক্ষম হয়েছিল। সেখানে অবশ্য উদীচী অকৃত্রিম বন্ধু রতন বসু মজুমদারের অবদান কম না। তিনিই প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে বাংলাদেশে আনার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলেন এবং সর্বতোভাবে সহায়তা করেছিলেন।
প্রতুল মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশে আসবেন—এই খবরটি যখন প্রচারিত হলো তখন বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমী মানুষগুলোর মধ্যে আনন্দের বান ডেকে গেল। তার গান শোনা এবং তাকে একনজরে দেখার জন্য মানুষ পাগলের মতো ফোন করতে থাকলো।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের বন্ধুরা একের পর এক ফোন করে চলেছেন তার সাথে একটু কথা বলা, একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি আমিও তখন কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছি, কারণ আমি সেই উৎসব কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম।
তিনি যখন বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হলেন তার আগেই আমরা উদীচীর কয়েকজন বন্ধু সেখানে হাজির হয়ে গেলাম। রতনদাসহ (রতন বসু মজুমদার) তিনি যখন বিমানবন্দর থেকে বের হলেন তখন আমরা ফুলের তোড়া নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি। সেটি তার হাতে তুলে দিতেই শিশুসুলভ হাসিতে তিনি আমাদের বিমোহিত করে ফেললেন।
বিমানবন্দর থেকে তাকে নিয়ে সোজা হাসান (সৈয়দ হাসান ইমাম) ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম। চারদিকে সাংবাদিকদের বাঁধভাঙা ভিড়। সেগুলো উপেক্ষা করে হাসান ভাইয়ের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সেখানে তার সাথে কিছুটা পরামর্শ শেষে কিছুক্ষণের জন্য সাংবাদিকদের জন্য সময় ঠিক করে দিলাম।
২৭ মার্চ ২০১০ শিল্পকলা একাডেমির খোলা মঞ্চে যখন গান গাইতে দাঁড়ালেন তখন কানায় কানায় পূর্ণ মাঠে গেয়ে উঠলেন—
‘দুইজনাই বাঙালি ছিলাম, দেখ দেখি কাণ্ডখান,
তুমি এখন বাংলাদেশি আমারে কও ইন্ডিয়ান।’
এই গানটা তিনি সেবার বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করেই লিখেছিলেন। ১৯৪২ সালের ২৫ জুন অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী যখন ভিনদেশের নাগরিক তখন স্বদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে গাইলেন এই গান। প্রতুল গান গাওয়া শুরু করেছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। এই বয়েসেই তিনি কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় সুর দেন এবং সেই গানেই প্রথম কণ্ঠ দেওয়া। এরপর কখনো আড্ডা, রাজপথে, মিছিলে, অনুষ্ঠানে সর্বত্রই তার গান সমাদৃত হয়েছে।
প্রতুলের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, কথা এবং সুরের ইন্দ্রজালে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে রাখা। কী অসাধারণ তার গলার কারুকাজ। তার গান শিশুর জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়াসহ গণমানুষের চেতনায় সমৃদ্ধ। ২০১০ সালে বাংলাদেশে আসার পর ২৭ মার্চ শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরে, এরপর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে, দেশ টেলিভিশনে, ছায়ানট মিলনায়তনসহ যে’কটি আসরে গান করেছিলেন, যে গানগুলো গেয়েছিলেন তার প্রত্যেকটি গান জীবনের নির্যাসে সমৃদ্ধ। জীবনের সেই কথাগুলো সুরের আলোয় ভরিয়ে মানুষের হৃদয় মথিত করতে তাই কোনো বাদ্যযন্ত্র প্রয়োজন হয়নি।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির খোলা, বিস্তীর্ণ মাঠে এই ছোট্ট-খাট মানুষটা দাঁড়িয়ে যখন গান ধরলেন তখন দর্শক সারি থেকে মুহুর্মুহু তালি গানের সাথে বাজতে থাকলো। তিনি থামলেন, দর্শকদের প্রতি করজোড়ে অনুরোধ করলেন গানের সাথে তালি না বাজাতে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, দর্শকসারি নিশ্চুপ হয়ে গেল। কোথাও পিনপতনের শব্দ নেই।
কয়েকটা গানের শেষেই ধরলেন, ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি’। গানটির সাথে তিনি নিজে তুড়ি বাজাতে থাকলেন, আস্তে আস্তে দর্শকদের সম্পৃক্ত করলেন। বলে উঠলেন, গাও—অমনি দর্শক সারি মিলিয়ে দিলো গলা। মাঠ ভর্তি মানুষের গলা আর প্রতুলে গলা একাকার হয়ে গেল।
সমীর রায়ের লেখা এই গানটি তিনি জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনেও গেয়েছিলেন। তখন তিনি গানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি আসলে যতটা না শিল্পী তারচেয়ে বেশি ‘কথক’। কথার ফাঁকে গান গাই।” তিনি বলেন, নতুনের আসা যাওয়া থাকবে। সেই আসা যাওয়ার মাঝে অনেক কিছু বেচাকেনা হবে। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যা কখনো বেচা যায় না। যেমন ভাষা, মূল্যবোধ, নারীর ইজ্জত। এসব কিছু রেখে দিতে হয়, না হলে নিজের পরিচয় থাকে না।
দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা প্রতুল আর পাঁচজন শিল্পীর মতো নিরাপদে, নির্বিঘ্নে সংগীতের চর্চা করে শিল্পী হতে পারেননি। তাকে যেতে হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। তিনি জীবন ও জীবিকার টানে শিক্ষকতা করেছেন, ব্যাংকে চাকরি করেছেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে সামিল হয়েছেন গানের মিছিলে।
বামপন্থী চর্চার মধ্যে বড় হওয়া এই গায়ককে অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় ১৯৯৩ সাল, বাংলা ১৪০০ সালে, বাংলার প্রতি তার যে অনুভূতি তার সবটা উজাড় করে দিয়ে লিখলেন, ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি।
আসলে তিনি নিজে লিখে হোক আর অন্যের লেখা গান হোক—সেই গানগুলোই তিনি করেছেন যার সাথে প্রাণের সম্পর্ক আছে, প্রকৃতির সম্পর্ক আছে। তিনি যে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন, তার গানে তার সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় সুর করে গেয়েছেন, ‘স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষজন’। তিনি জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকিতে বীভৎস বোমা হামলায় নিহত শিশুর আর্তিকে নিজের আর্তি হিসেবে অনুভব করে গেয়েছেন, ‘ফিরিয়ে দাও আমার বাবা মাকে’।
তার গানে শাণিত চেতনার উদ্রেক ঘটেছে বারংবার। তাই তো তিনি গানে গানে আহ্বান জানাতে পেরেছেন, ‘ওঠো হে দরজা-জানলা খুলে’, ‘ওঠো হে, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’।
শিল্পীর কোনো জাত থাকে না, দেশ থাকে না। প্রতুল নিজেকে সেরকম একজন শিল্পীতে রূপায়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, যে গান আমি করবো তা যেন মানুষের গান হয়, মানুষের জন্য হয় এবং মানুষের পক্ষে দাড়িয়ে গাইতে পারি। তাই তিনি সব সংকীর্ণতা অতিক্রম করে মানুষের শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
মানুষের শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, তোমায় জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
অমিত রঞ্জন দে ।। সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ সম্পাদক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ