বৈশ্বিক রাজনীতির আকাশে সুশৃঙ্খল নৌকা এখনো উথাল-পাথাল। একদিকে যেখানে ইউক্রেনের যুদ্ধ, অন্যদিকে চীনের উত্থান, অর্থনৈতিক সংকট এবং গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তনের আশঙ্কা। এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উত্তপ্ত বৈঠক এক নতুন দৃষ্টিকোণ এনে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে।
৬১তম মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের (এমএসসি) এই বৈঠকটি শুধুমাত্র একটি আলোচনার মঞ্চ ছিল না, বরং বৈশ্বিক সংকট ও উত্তরণের একটি জীবন্ত দর্পণ হিসেবেও হাজির হয়েছে। এই সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইউক্রেন সংকট, রাশিয়া এবং পশ্চিমা শক্তির সম্পর্ক এবং সেগুলোর মধ্যবর্তী কৌশলগত কদর।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরাবরের মতো ইউক্রেনকে সরাসরি সমর্থন না দিয়ে বরং ন্যাটো সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির জন্য। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর তহবিলে আর এককভাবে বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করবে না। অন্যদিকে, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের আরও সরাসরি ও জোরালো সমর্থন দাবি করেছেন, যা ট্রাম্পের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এই বৈঠকটি এমন একটি সময় অনুষ্ঠিত হয়েছিল যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক পটভূমি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। চীন, রাশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র—এই দেশগুলোর মধ্যে চলমান উত্তেজনা ও চুক্তি-বিরোধের মাঝে ইউক্রেন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর বৈঠকটিতে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের অসন্তুষ্টি এবং চিৎকার-চেঁচামেচির ঘটনা যেন গোটা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকেই নতুনভাবে পরীক্ষা করল। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যখন বলেছিলেন, ‘যদিও ট্রাম্প চিৎকার করছিলেন, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করা সম্ভব,’ তখন এই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পরবর্তী ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং ট্রাম্পের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের অনেকটা পটভূমি তৈরি করেছে ইউক্রেন যুদ্ধের অবস্থা। ২০১৯ সালে যখন ট্রাম্প ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আশাবাদী যে, এই বৈঠকের মাধ্যমে পরিস্থিতি শিথিল হতে পারে। যদিও বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সংবাদ সম্মেলন না করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তবুও তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে চলছেন।
এদিকে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সও আলোচনায় যোগ দেন এবং মন্তব্য করেন, ‘আপনি একবারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন না।’ এই মন্তব্যের পর ট্রাম্পও ভ্যান্সের সমর্থনে মাথা নেড়ে সায় দেন। এই ধরনের মন্তব্য এবং বৈঠকের পরবর্তী গতি-প্রকৃতি ইউক্রেন সংকটকে নতুন ধরনের জটিলতায় পরিণত করেছে।
ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় কি এই সম্পর্কের এক নতুন যুগের সূচনা? নাকি এটি ইউক্রেনের জন্য আরও এক নতুন সংকটের প্রস্তাবনা? এই প্রশ্ন সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে বিশেষ আগ্রহী, কারণ দেশটি চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। চীন পৃথিবীর বিরল খনিজের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন ইতিমধ্যে কিছু খনিজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে, এবং এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষমতার ওপর পড়েছে। এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে বিশেষভাবে আগ্রহী।
এই আগ্রহ কি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে? এখন প্রশ্ন ওঠে, ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা কি ইউক্রেনের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে? অথবা কি এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক কৌশলে কোনো পরিবর্তন আসবে? এর উত্তরে সঠিক কোনো দৃষ্টিভঙ্গি বলা কঠিন, তবে একথা ঠিক যে, এই বৈঠকটি ইউক্রেনের জন্য এক নতুন ধরণের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যিনি একদিকে সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে অবতীর্ণ হতে পারেন, অন্যদিকে তার কূটনৈতিক নীতির ব্যাপারে অটল অবস্থানে থেকেও, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে এক কঠোর অবস্থান নিতে চান। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কিছু বক্তব্য এবং তার সামরিক নীতি অশান্তি সৃষ্টি করেছে, তবে এখন সেগুলো পর্যালোচনা করা দরকার।
ট্রাম্প যদি তার আগের নীতির পুনঃমূল্যায়ন করেন, তবে কি তা ইউক্রেনের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও সংকটময় করে তুলবে? এদিকে, জেলেনস্কি ইউক্রেনের জনগণের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে তাকে এখন এই সংকটের মধ্যে শক্তি ও কৌশলগত সামর্থ্যের পরীক্ষা দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে তার সমর্থন যদি কমে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তার নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণটি বেশ শক্তিশালী ছিল, তবে বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান অবস্থা একটি নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা বর্তমানে নতুন মাত্রা পেয়েছে। একদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
এই সম্পর্কের ফলে, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের যুগের অবসান হতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে বাদ দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, তবে এটি বিশ্ব রাজনীতির জন্য একটি বিপর্যয় হতে পারে। কারণ, ৩৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীজুড়ে যে আধিপত্য তৈরি করেছে, তা সম্ভবত নতুন জোটের উত্থানে ক্ষুণ্ন হতে পারে। রাশিয়া ও চীনের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভবিষ্যতের একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হতে পারে, যা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় নতুন ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক অবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র এখন আগের মতো বিশ্ব নিরাপত্তার ভার বহন করতে রাজি নয়। এই পরিবর্তনের মূল কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এখন বৈদেশিক যুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যয় করতে চায় না। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি, যেখানে বিদেশের তুলনায় দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এর ফলে ইউক্রেন সংকটসহ ন্যাটো ও ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
ন্যাটো যদি ট্রাম্পের শর্ত অনুযায়ী ৫ শতাংশ জিডিপি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে বাধ্য হয়, তবে ইউরোপীয় অর্থনীতির ওপর বিশাল চাপ পড়বে। ফ্রান্স ও জার্মানি ইতোমধ্যেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। ইউক্রেন সংকটের উত্তরণ বা গভীরতা নির্ভর করছে কেবলমাত্র কূটনৈতিক কৌশল ও আন্তর্জাতিক মহলের সিদ্ধান্তের ওপর। তবে এটুকু বলা যায়, যে ধরনের উত্তপ্ত পরিস্থিতি এই বৈঠকে তৈরি হয়েছে, তা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে।
এখন ইউক্রেনকে শুধুমাত্র সামরিক সহায়তার প্রয়োজন নেই, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল এবং বৈশ্বিক সমর্থনের প্রয়োজন, যাতে তার ভূরাজনৈতিক অস্তিত্ব সুরক্ষিত থাকে। এতসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ইউক্রেনের নেতৃত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন দিক অন্বেষণের সুযোগ বাড়ছে।
তবে সময়ের সাথে সাথে এর প্রকৃত অর্থ এবং ফলাফল কেমন হবে, তা শুধু সময়ই বলতে পারবে। বিশ্বে এখন যে ধরনের কৌশলগত পরিবর্তন ঘটছে, তাতে অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং ভূরাজনীতি একে অপরকে প্রতিফলিত করছে। বিশেষ করে, বিরল খনিজ সম্পদের দখল নিয়েই বিশ্বের নতুন শক্তির ভারসাম্য নির্ধারিত হবে।
চীন এবং রাশিয়া একত্রিতভাবে শক্তিশালী একটি জোট গঠন করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। এর ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, যা ইউক্রেন সংকটের পরবর্তী দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠক একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে ইউক্রেন সংকটের সমাধান এখনো দূরে এবং এটি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি কমিয়ে আনছে, যা ইউক্রেন এবং ন্যাটোর জন্য বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
এদিকে, ইউরোপ নিজস্ব কৌশল খুঁজছে, চীনের উত্থান একটি নতুন শক্তি ভারসাম্য তৈরি করছে এবং রাশিয়া তার অবস্থান শক্তিশালী করছে। এই পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন পর্বের সূচনা করছে, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্র ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং এটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার অভিমুখ নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠছে।
ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়