30229

03/17/2025 জামাল নজরুল ইসলাম : নিঃসঙ্গ কসমোলজিস্ট

জামাল নজরুল ইসলাম : নিঃসঙ্গ কসমোলজিস্ট

আসিফ

১৬ মার্চ ২০২৫ ১২:০২

‘রাতের জীবরা দিনের আলোকে আকর্ষণীয় মনে করবে না, যেমন দূর ভবিষ্যতের অতি-শীতল মহাবিশ্বের অজানা সচেতন প্রাণীরা আমাদের উষ্ণ মহাবিশ্বকে হয়তো খুব একটা আরামদায়ক হিসেবে দেখবে না। কিন্তু তবুও, তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে হয়তো পাওয়া যাবে যাদের কল্পনাশক্তি প্রখর, তারা দূর অতীতে, মহাবিশ্বের দিকে ফিরে তাকাবে, দেখবে একটা সূর্যালোকাপ্লবিত পৃথিবীকে, যেখানে কয়েক কোটি বছরের শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত, তারা সেই পৃথিবীকে এক স্বপ্নের জগৎ বলেই ভাববে-কিন্তু তাদের জন্য সেই স্বপ্নের জগৎ হারিয়ে গেছে, কোনদিন ফিরে আসবে না। বর্তমানে আমরা যারা এই স্বপ্নের পৃথিবীকে নিয়ে আছি, তারা কী করছি? আমরা একে অপরকে অত্যাচারে জর্জরিত করছি, নিজেদের ধ্বংসের জন্য পরমাণু মারণাস্ত্র তৈরি করছি, আর পৃথিবীর সম্পদকে অবাধে লুঠ করছি, মানবতাকে লঙ্ঘন করছি।’

সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব ইউনিভার্স (The Ultimate Fate of the Universe)’-এর ‘ফিউচার অব লাইফ অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ অধ্যায়ে জামাল নজরুল ইসলাম এ কথাগুলোই লিখে গেছেন।

অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বিখ্যাত কসমোলজিস্ট, গণিতবিদ ও পদার্থবিদ। কেমব্রিজ থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’ দুনিয়া কাঁপিয়েছিল। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বইটি পড়ানো হয়। পৃথিবীর বাঘা বাঘা পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ীরা ছিলেন তার বন্ধু, সহপাঠী ও সহকর্মী।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬০ সালে। ওখানে তার সহপাঠী ছিলেন পরবর্তীকালে বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার (Jayant Vishnu Narlikar)। সহপাঠী ছিলেন ব্রায়ান জোসেফসন (Brian Josephson), যিনি তার পিএইচডি থিসিসের জন্য মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, ১৯৭৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান।

সহপাঠী ছিলেন রসায়নবিদ জন পোপল (John Pople)। তিনিও ১৯৯৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ষাটের দশকে কেমব্রিজে স্বয়ং পল ডিরাক (Paul Dirac) তাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্লাস নিতে দেন, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব (ফিল্ড থিওরি) পড়েছেন জন পোলকিংহোর্ন (John Polkinghorne)-এর কাছে।

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম যশোরের ঝিনাইদহ শহরে, ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে। মাতামহ শামসুল ওলামা কামালউদ্দিন ছিলেন গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরকারি কলেজের প্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ। মনীষী আবু সয়ীদ আইয়ুব তার মামা। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের স্রষ্টা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ফুফাতো ভাই। তার পিতা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বিচার বিভাগীয় একজন মুন্সেফ। মা রাহাত আরা ছিলেন উর্দু ভাষার কবি, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটিকাটি সফলভাবে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন।

জামাল নজরুল ইসলাম তার ফুফাত ভাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে ‘উজ্জ্বল স্মৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘সারাজীবন বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে গবেষণা করলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন-চিত্রকলা এসবের প্রতিও আমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এর মূলে রয়েছে আমার পারিবারিক প্রভাব। ...আমার এ আগ্রহের ফলে কোলকাতার অনেক বিখ্যাত গুণীর সঙ্গে আমার আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি, এর পেছনেও ওয়ালী ভাইয়ের বিশেষ প্রভাব থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। এরই ধারাবাহিতায় রবীন্দ্রনাথের রচনার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এরপর প্রাচ্য পাশ্চাত্যের অনেক সাহিত্যিক ও দার্শনিক আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে ও আলোড়িত করেছেন যে, আমি মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে যেমন ভাবি, তেমনি ভাবি আমাদের সমাজ সভ্যতা নিয়ে। নিরন্তর এই ভাবনা থেকে হয়তোবা ভালো কিছুর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন। এখানে তিনি রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথম্যাটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস (RCMPS) নামে একটি বিশ্বমানের গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন।

১৯৮৯ সালে আবদুস সালাম এই কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন। ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সুনামের সঙ্গে কাজ করে গেছেন। এখানে কোনো কোনো কনফারেন্সে এক সঙ্গে ১২ নোবেল লরিয়েট পর্যন্ত এসেছিল। যার মধ্যে রজার পেনরোজ (Roger Penrose), ফ্রিম্যান ডাইসন (Freeman Dyson)ও ছিলেন। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ছাড়া সেমিনার রুমে তারা কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন ভাবলে অবাক হতে হয়। কী অযত্ন অবস্থায় পড়ে আছে সেইসব, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখে এসেছি।

তার রচিত পঞ্চাশটিরও বেশি গবেষণাপত্র রয়েছে। গবেষণাপত্রগুলো অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান জার্নালে। পিএইচডি শেষে তিনি দুই বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে চলে যান। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রায় ৪০ বছর কাজ করেছেন। এ বিষয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কেউ কাজ করেননি বলে জানা যায়।

জামাল নজরুল ইসলামের অবদানকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিদ্যা, কনফর্মাল মহাকর্ষ তত্ত্ব, মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ, মহাজাগতিক ধ্রুবক ল্যামডা। তার গবেষণাপত্র পড়ে ওই সময়ের বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকেরা খুবই প্রভাবিত হয়েছিলেন।

নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ (Steven Weinberg) বিশ্বকে নৈরাশ্যজনক বলে মতামত ব্যক্ত করলেও জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন জামালের রচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আশাবাদী বিশ্বের কথা বলেছিলেন। জামাল নজরুল ইসলামের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে ডাইসন একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘টাইম উইদাউট অ্যান্ড : ফিজিক্স এন্ড বায়োলজি ইন অ্যান ওপেন ইউনিভার্স (Time without end: Physics and biology in an open universe)’।

২০১৬ সালের ১৬ মার্চ ছিল জামাল নজরুল ইসলামের জন্মদিন। এ উপলক্ষে পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের ইমেইলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৯২ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী বলেছেন, আপন দেশকে বৌদ্ধিকভাবে সহযোগিতা করার জন্যই বাংলাদেশে ফিরেছিলেন মহাবিশ্ব তত্ত্ববিদ (কসমোলজিস্ট) জেএন ইসলাম।

তিনি আরও বলেছেন, জামাল ইসলামের একটা গবেষণা প্রবন্ধ পড়েই আমি মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতির নিয়ে কৌতূহলী হয়েছিলাম। এটা ১৯৭৭ সালের কথা। প্রবন্ধটা ছাপা হয়েছিল কোয়ার্টারলি জার্নাল অফ দ্য রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি (Quarterly Journal of the Royal Astronomical Society)-তে। ওই প্রবন্ধটাই প্রথম। আমি শুধু পরে ওই সমস্যাটা নিয়ে একাকী গবেষণা করি।

আমি জামালকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি (Institute for Advanced Study)-তে একটা বছর কাটানোর জন্য। এরই সুবাদে আমি তাকে ও তার পরিবারকে জানাশোনার সুযোগ পাই। ওই সময় আমরা একে অপরের চিন্তাভাবনা বিনিময় করি এবং আমাদের বন্ধুত্বের ফসলই হচ্ছে জামালের ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আলটিমেট ফেট অফ ইউনিভার্স (The Ultimate Fate of the Universe)’ বইটা।

তবে দরকারি সব আইডিয়া জামাল নজরুল ইসলামের ১৯৭৭ সালের প্রবন্ধেই ছিল। এ বইতে তিনি ফ্রিম্যান ডাইসন সম্পর্কে লিখেছিলেন, “চেতনা শুধু পদার্থের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি একটি ‘গঠন বা স্ট্রাকচার’ এর ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, ডাইসনের মতে, চেতনা কোনো বস্তুগত জিনিস নয়, বরং এটি একটি বিন্যাস বা সংগঠনের ফল।”

পরিবেশের তাপমাত্রা কমলে জীবন্ত প্রাণীর শারীরিক কার্যকলাপও কমে যায়। এই ধারণাটি ‘জৈবিক স্কেলিং আইন’ নামে পরিচিত। ডাইসন যুক্তি দেন, যদি কোনো সমাজ শীতনিদ্রার মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে, তবে তারা সীমিত শক্তি ব্যবহার করে অসীম সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তাদের স্মৃতিও অসীম হতে পারে, যদি তারা অ্যানালগ কম্পিউটারের মতো স্মৃতি ব্যবহার করে।

ডাইসন তার ধারণার সাথে কার্ট গোডেলের উপপাদ্যের তুলনা করেন। গোডেলের উপপাদ্য অনুসারে, গণিতের কোনো সীমিত সেট দিয়ে সম্পূর্ণ গণিতকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ডাইসন মনে করেন, তার ধারণাও একইভাবে অসীম সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।

এছাড়া কেমব্রিজ থেকে ১৯৮৩ সালে সম্পাদিত গ্রন্থ হলো, ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (Classical General Relativity)’। এ বইয়ে জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন ডব্লিউ. বি. বনর (W. B. Bonnor) এবং এম.এ.এইচ. ম্যাককুলাম (Malcolm A. H. MacCallum)।

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকেই প্রকাশিত তার লেখা ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (Rotating Fields in General Relativity)’; ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (An Introduction to Mathematical Cosmology)’।

শেষেরটি প্রথম বইটিরই গাণিতিক সংস্করণ। ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় বিখ্যাত জ্যোতিপদার্থবিদ ফ্রেড হোয়েলের প্রতি জামাল নজরুল ইসলাম বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ১৯৮৪ সালে এনডেভার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রকাশিত ‘ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স (The far future of the Universe)’ এবং বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮৫ সালে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘কৃষ্ণ বিবর’ বইটিও উল্লেখযোগ্য।

আপেক্ষিক তত্ত্বকে ঘিরে দীর্ঘ ৪০ বছর গবেষণা করার উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহ ত্যাগ করে মাত্র দুই হাজার আটশো টাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ নেন। এই সময় তার রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথম্যাটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস (RCMPS) নামের বিশ্বমানের গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং তার সঙ্গে পৃথিবীর সেরা গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীদের দেখা করতে আসা স্মরণে রাখার মতো ঘটনা।

জামাল নজরুল ইসলাম আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন না। হাতে লিখতেন। ধ্রুপদী সংগীতের মগ্নতায় বিজ্ঞানকে ভালোবেসে আজীবন কাজ করে গেছেন। ২০১৩ সালে ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন মানবিক পৃথিবীর মানুষ। তার মতো মানুষ এবং তার সৃষ্টি আমাদের আজীবন স্মরণে রাখা উচিত।

আসিফ ।। বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত (বিজ্ঞান সাময়িকী)

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]