30242

03/17/2025 শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর করার দাবি

শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর করার দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৬ মার্চ ২০২৫ ১৫:১৫

শিশুরা যৌন নির্যাতন, বিপজ্জনক শ্রম, অবহেলা, অনলাইন সহিংসতা এবং অন্যান্য সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। বাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জনসমক্ষে, কোথাও নিরাপদ নয় শিশুরা। শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর বা জবাবদিহিমূলক নয়।

এসবের মূলে রয়েছে নীরবতার সংস্কৃতি। পরিবারের সদস্য এবং নিকট আত্মীয়দের দ্বারা যৌন অসদাচরণের বিষয়ে নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। অপরাধীরা লালিত হচ্ছে নীরবতার সংস্কৃতিতেই। মেয়ে শিশুদের পাশাপাশি ছেলে শিশুদের জন্যও একই বাস্তবতা। অথচ শিশুদের সুরক্ষা ও সুষ্ঠু বিকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সরকারের কাছে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।

এ অবস্থায় শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর গড়ার পাশাপাশি মহিলা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের মতো ‘শিশু বিষয়ক সংস্কার কমিশন’ প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো।

‘শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় শিশু অধিকার বিষয়ক এনজিওদের প্রতিবাদ ও উদ্বেগ প্রকাশ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি উঠে আসে।

রোববার (১৬ মার্চ) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শফিকুল কবির অডিটোরিয়ামে যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ।

সেখানে লিখিত বক্তব্য উত্থাপন করেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক যৌন সহিংসতা, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা বা হত্যা চেষ্টা আমাদের ভীষনভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই সংকট শুধু শিশুদের জীবনকেধ্বংস করছে না, বরং আমাদের সমাজের মূল ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে মেয়ে শিশুদের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা এই সহিংসতা জাতিকে হতবাক করেছে এবং সারাদেশে প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। দেশব্যাপী প্রতিবাদেরসঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আজ আমরাও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

এ প্রেক্ষিতে তিনি গত ৬ মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণ শিকার শিশুর মৃত্যু থেকে শুরু করে শনিবার (১৫ মার্চ) পর্যন্ত ময়মনসিংহ নগরে ১১ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।

শাহীন আনাম বলেন, বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য সরকারের কাছে একাধিকবার দাবি জানানো হয়েছে। অপরাধীরা প্রায়শই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হওয়ায় তারা পুনর্বার নির্যাতনে লিপ্ত হতে থাকে। এর সবচেয়ে মর্মান্তিক উদাহরণ হলো ২০১৬ সালে ৫ বছর বয়সী একটি শিশুকে নির্মমভাবে ধর্ষণের দায়ে কয়েক বছর আগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন অপরাধীর সাম্প্রতিক জামিন।

মাগুরায় ৮ বছর বয়সী শিশুর সাম্প্রতিক নির্মম ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় জনপরিসরে ভীতি তৈরি করেছে, নিকটআত্মীয় এমনকি নিজের বাড়িতেও নিরাপদ নয় শিশুরা। যদিও এই ঘটনায় অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়েছে, তবে দ্রুত ও যথাযথ তদন্ত, বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

তিনি বলেন, শিশু অধিকার বাস্তবায়নে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় যুক্ত থাকলেও শিশুরণে কল্যার বিষয়টি মূলতঃ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ তিনটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। মন্ত্রণালয়গুলো তাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মতো শিশুদের জন্য কোনো আলাদা অধিদপ্তর নেই যা শিশুদের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ে সমন্বয়কারী সংস্থা হিসাবে কাজ করতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের মহিলা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের মতো ‘শিশু বিষয়ক সংস্কার কমিশন’ প্রতিষ্ঠারও যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।

শিশুদের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সহায়তা ও সমর্থন শিশুদের প্রয়োজন। আমরা চাই সরকার অনতিবিলম্বে শিশুদের সমস্যাগুলিকে অগ্রাধিকার দিক, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের। বর্তমান পরিস্থিতি জরুরিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি করে, তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে।

১৭ দফা দাবি

১. শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলাগুলোর দ্রুত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক। অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যেন তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। বিচার প্রক্রিয়া ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার আইন উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হোক।

২. শিশুদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মতো একটি শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর স্থাপন করা হোক, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করবে।

৩. শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ক একটি সংস্কার কমিশন জরুরি ভিত্তিতে গঠন করা হোক, যা সকল অংশীজনেরসঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় একটি সুপারিশমালা প্রস্তুত করবে এবং অন্যান্য সংস্কার কমিশনের মতো তা প্রধান উপদেষ্টাকে হস্তান্তর করবে।

৪. পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের দ্বারা যৌন নির্যাতনের বিষয়ে নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক, যেন ভুক্তভোগীরা নিরাপদে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে।

৫. শিশু সুরক্ষা সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনগুলোর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা হোক।

৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ এবং সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক।

৭. শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে একটি স্বতন্ত্র মনিটরিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠা।

৮. নির্যাতিত শিশুদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও পুনর্বাসন সেবা নিশ্চিত করা।

৯. সকল নাগরিক, বিশেষ করে প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

১০. ক্ষতিকর সামাজিক রীতি ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার সংস্কৃতি পরিবর্তনে জাতীয় পর্যায়ে প্রচার ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন

১১. ভুক্তভোগীদের সহায়তার ব্যবস্থা শক্তিশালী ও সহজপ্রাপ্য করা হোক, যার মধ্যে কাউন্সেলিং, আইনি সহায়তা, ও পুনর্বাসন সেবা অন্তর্ভুক্ত করা

১২. নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা হিসেবে কমিউনিটি নেতা, শিক্ষক, ও অভিভাবকদের সক্রিয় সংলাপে যুক্ত করা হোক।

১৩. সকল থানায় শিশু হেল্প ডেস্ক কার্যকর করা।

১৪. সহিংসতার শিকার শিশু, শিশুর পরিবার ও ঘটনার সাক্ষীদের জন্য সুরক্ষা আইনগত ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

১৫. হটলাইনকে কার্যকর করা। ১০৯ ও ১০৯৮ নম্বরে আসা অভিযোগ এবং তার পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জবাবদিহিতামূলক নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ করা হোক।

১৬. একটি কার্যকর হটলাইন : নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২৪/৭ নতুন হটলাইন চালু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। ০১৩২০-০০২০০১, ০১৩২০-০০২০০২ ও ০১৩২০-০০২২২২। একাধিক হট লাইনের পরিবর্তে বিদ্যমান নম্বরগুলো আরও কার্যকর করে বিভ্রান্তি এবং অস্পষ্টতা হ্রাস করা যায় কিনা তা বিবেচনা করা হোক।

১৭. জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের (UNCRC) অধীনে ষষ্ঠ ও সপ্তম পর্যায়ক্রমিক রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদন উপস্থাপন করার মাধ্যমে শিশু অধিকার সুরক্ষা, উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]