30274

03/17/2025 বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মাত্রা, নিবিড় পর্যবেক্ষণে ভারত

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মাত্রা, নিবিড় পর্যবেক্ষণে ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৭ মার্চ ২০২৫ ১২:২৫

গত বছর বাংলাদেশের নাটকীয় রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে অনেক ঘটনা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে— যার মধ্যে এক সময়ের শত্রু পাকিস্তানের সাথে ঢাকার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে।

এদিকে উভয় দেশের সম্পর্কের এই উন্নতির বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ভারত। সোমবার (১৭ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, কয়েক দশকের অস্থির সম্পর্কের পর গত মাসে দুই দেশ প্রথমবারের মতো সরাসরি বাণিজ্য শুরু করে। ঢাকা এসময় পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করে। উভয় দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান এবং সামরিক যোগাযোগও পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, ভিসা পদ্ধতি আরও সহজ করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়েও সহযোগিতার খবর পাওয়া গেছে।

ভারতের ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই দুটি দেশের মধ্যে গভীর, বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মধ্যে শত্রুতা ১৯৭১ সাল থেকে শুরু হয়, যখন বাংলাদেশ — তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত — ইসলামাবাদ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের সময় ভারত বাঙালি বিদ্রোহীদের সমর্থন করে যার ফলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

যদিও সেই সময়ের ক্ষত ছিল গভীর তারপরও ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। সেসময় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর একটি জোট সরকার।

তবে ২০০৯ সাল থেকে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে এই সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়। সেসময় তিনি দিল্লির কাছ থেকে দৃঢ় সমর্থন পেয়েছিলেন এবং পাকিস্তান থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান এবং এরপর বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের সম্পর্কের বরফ গলছে বলে মনে হচ্ছে।

সাবেক বাংলাদেশি কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা কঠিন পথে ছিল। তবে এই সম্পর্কটি এখন ‘দুটি স্বাভাবিক প্রতিবেশী দেশের’ মতো অবস্থায় ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে।”

তবে দুই দেশের সম্পর্কের ক্রমশ উন্নতির এই ঘটনাবলী বিশেষ করে ভারতে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কারণ পাকিস্তানের সাথে এই দেশটির দীর্ঘ বৈরী সম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে।

হাসিনার বিদায়ের পর থেকে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সম্পর্কও এখন তিক্ত। মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সেই দাবির প্রতি ভারত কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। হাসিনা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো এবং পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, “পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বর্তমানে একটি কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। একসাথে তারা ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি ধাক্কা দিতে চায়।”

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য শুরু করা ছাড়াও অন্যান্য ঘটনাও ঘটছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বহুপাক্ষিক ফোরামে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করেছেন।

এছাড়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্কও রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের বাংলাদেশি সামরিক প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে সফর করেন এবং বিরল সেই সফরে পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সাথে আলোচনা করের তারা। এরপর ফেব্রুয়ারিতে করাচি উপকূলে পাকিস্তান কর্তৃক আয়োজিত বহুজাতিক নৌ মহড়ায় বাংলাদেশি নৌবাহিনীও অংশগ্রহণ করে।

২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বীণা সিক্রি ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতাকে “ডেজা ভু” মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, ঢাকায় তার মেয়াদকালে ভারত বারবার “আইএসআই (পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা) এবং বাংলাদেশি সামরিক বাহিনীর একটি অংশের সহায়তায় ভারতীয় বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নেওয়ার” বিষয়টি উত্থাপন করেছিল।

তার দাবি, “আমরা এমনকি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে প্রমাণও দিয়েছিলাম”। তবে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ সেই সময় এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছিল।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘ ও ছিদ্রযুক্ত সীমান্তের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে পড়ে। কিন্তু ২০০৯ সালে হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা এই গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং তাদের ঘাঁটি ভেঙে দেয়।

তাই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা “ভারতের জন্য প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগ” বলে মিসেস সিক্রি দাবি করেন।

তিনি আরও দাবি করেন, “এটি কেবল সামরিক সম্পর্ক নয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জামায়াতে ইসলামীর মতো বাংলাদেশি ইসলামপন্থি দলগুলোর সাথেও সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামাবাদকে সমর্থন করেছিল।”

এর আগে আইএসআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করেছেন বলে ভারতীয় মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়। তবে ড. ইউনূস প্রশাসনের প্রেস অফিস ভারতীয় মিডিয়ার এসব প্রতিবেদনকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি পাকিস্তানি কর্মীরা বাংলাদেশে ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শিবির পুনরায় চালু করার জন্য কাজ করছে— এমন প্রতিবেদনগুলোকেও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছে প্রেস অফিস।

বাংলাদেশে আইএসআইয়ের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ সম্পর্কে বিবিসির প্রশ্নের জবাব দেয়নি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশি রাজনীতিবিদরা জানেন যে— ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও ভাষাগত সম্পর্কের কারণে ঢাকা ভারত-বিরোধী অবস্থান নিতে পারে না। দিল্লিতে আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি কূটনীতিকরা যুক্তি দেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান না হলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যাবে না।

যুদ্ধের সময় লাখ লাখ বাঙালি নিহত হয় এবং হাজার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ৯০ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি নিরাপত্তা ও বেসামরিক কর্মী ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়। এটিকে ইসলামাবাদের জন্য একটি অপমানজনক অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়।

বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় সংঘটিত নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেছে কিন্তু ইসলামাবাদ তা করতে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। সাবেক বাংলাদেশি কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য পাকিস্তানের দায় স্বীকার করা উচিত। আমরা পাকিস্তানের সাথে বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী সম্পদের বিভাজনের বিষয়টিও উত্থাপন করেছি।”

এমনকি ইকরাম সেহগালের মতো সাবেক পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন, “বাংলাদেশ দাবি যে— পাকিস্তানিদের ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল তার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং এটাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।”

তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই মেজর জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের উচিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় উর্দুভাষীদের ওপর বাঙালিদের আক্রমণের বিষয়টিও সমাধান করা। করাচিতে বসবাসকারী সাবেক এই পাকিস্তানি সেনা কর্মবর্তা বলেন, “(পূর্ব পাকিস্তানে) উর্দুভাষী বিহারি জনগণের ওপর যে নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল তার সাক্ষী ছিলাম আমি।”

যদিও ইতিহাস ঢাকা এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলেছে, তারপরও অর্থনীতিবিদরা উল্লেখ করেছেন, দেশ দুটি প্রথমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করতে পারে, যার পরিমাণ বর্তমানে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের কম। আর এই বাণিজ্যের বেশিরভাগই পাকিস্তানের পক্ষে।

ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক সাবরিন বেগ বলেন, “পাকিস্তানের ২৫ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য একটি শক্ত বাজার।”

তিনি বলেন, বর্তমানে উভয় পক্ষের ওপর উচ্চ শুল্কসহ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং ব্যবসা ও রপ্তানিকারকরা ভিসা ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে “উন্নত দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই সীমাবদ্ধতাগুলো কমিয়ে আনবে”।

আগামী এপ্রিলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরের সময় এই বিষয়গুলোর মধ্যে কিছু আলোচনা হতে পারে। এছাড়া চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে এবং নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি থাকলেও থাকতে পারে।

তবে, যাই ঘটুক না কেন, দিল্লির জন্য ঝুঁকি বেশি। কারণ তারা দৃঢ়ভাবে মনে করে, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তাদের স্থিতিশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ প্রয়োজন।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]