31324

04/22/2025 কংক্রিটের জঞ্জালে বিশুদ্ধ বায়ুর সন্ধান

কংক্রিটের জঞ্জালে বিশুদ্ধ বায়ুর সন্ধান

রাহাত মিনহাজ

২২ এপ্রিল ২০২৫ ১১:০২

মাতৃভূমি মা সমতুল্য। তাই মায়ের সমালোচনা বা নেতিবাচক দিক তুলে ধরা খুব একটা রুচিকর নয়। কিন্তু উন্নয়নের মানদণ্ড ও পরিবেশের নানা বিষয়ে সতর্ক হতে অনেক সময় বাধ্য হয়েই আমাদের বিভিন্ন দেশের সাথে তুলনা টানতে হয়। আলোচনার টেবিলে আনতে হয় অনেক অপ্রিয় সত্য ও বাস্তবতা।

ছোট একটি পর্যবেক্ষণ। পারিবারিক কারণে আমাকে বছরের কিছু সময় অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বড় শহর ব্রিজবেনে অবস্থান করতে হয়। ব্রিজবেন শহরের সাথে ঢাকার একটা মিল আছে। ব্রিজবেন শহরের গোড়াপত্তন ব্রিজবেন নদীকে কেন্দ্র করে। আর আমাদের ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে।

ঢাকার বয়স ৪০০ বছর পেরিয়েছে, ব্রিজবেনও শহরের বয়সও অনেকটা কাছাকাছি। ব্রিজবেনের তুলনায় ভৌগোলিকভাবে ঢাকা একটি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। ঢাকার আশেপাশে চার নদী—বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু আর তুরাগ। আর ব্রিজবেন শহরে একটাই নদী-ব্রিজবেন। কিন্তু পরিবেশগত অবস্থায় দুই শহরের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত।

হ্যাঁ, অনুন্নত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা উন্নত বিশ্বের প্রতিনিধি অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেনের মতো হবে তেমনটা বলছি না। কিন্তু সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা থাকলে কিছুটা যে উন্নয়ন করা যেত তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

ছোট্ট করে উল্লেখ করি, ব্রিজবেন পৃথিবীর ১৬-তম বসবাসযোগ্য শহর আর ঢাকা ১৬৮-তম। আর এই বসবাসযোগ্য শহর, উন্নত পরিবেশের নানা সূচক রয়েছে। এখানে বিস্তারিত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। আজ আলোচনা করতে চাই শহরের বাতাসের মান নিয়ে।

২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের সকালে রাজধানী ঢাকার বাতাসের মান পৃথিবীর অন্যতম দূষিত। বাতাসের মানের সূচক ৬২ (AQI:Air quality index)। যার অর্থ বাতাসের মান খুব খারাপ। পর্যবেক্ষক সংস্থা AccuWeather এর নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকার বাতাসের মান ২২ এপ্রিল নিম্নমুখী।

যা উল্লেখ করে সংস্থাটি নির্দেশনা দিচ্ছে ‘হাওয়াতে দূষণ উচ্চমাত্রায় পৌঁছে গেছে এবং সংবেদনশীল গোষ্ঠীর মানুষদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। আপনি যদি শ্বাসকষ্ট বা গলায় অস্বস্তির মতো লক্ষণগুলো অনুভব করেন তাহলে বাইরে সময় কাটানোর পরিমাণ কমান।’

আর অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেনে বাতাসের মান ভালো, মান সূচক ২০। মোবাইলে নোটিফিকেশন দিয়ে ব্রিজবেন সিটি কাউন্সিল তার নাগরিকদের জানিয়ে দিয়েছে, আজকের বায়ুর মান কয়েক দিনের তুলনায় ভালো। দিনটি বাইরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য উত্তম।

পারিবারিক কারণে যখন ব্রিজবেন শহরে যাই—তখন ওই শহরে আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাই। বাতাসের মান এতটাই বিশুদ্ধ যে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার পর বুকের ভেতর অনুভব করি বিশুদ্ধ বাতাসের প্রাণশক্তি। মন ও শরীরে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি কাজ করে।

আবারও উল্লেখ করি, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রিজবেনের সাথে ঢাকার তুলনা করা যথাযথ নয়। কিন্তু শুধু পার্থক্য বোঝাতে এই প্রসঙ্গ টানা যেতেই পরে। ঢাকা শহরের বাতাস নিম্নমান হওয়ার বহু কারণ রয়েছে। অন্যতম হলো, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজ ও নির্মাণ সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। আর সবুজহীনতা মানে বৃক্ষনিধনও এর অন্যতম কারণ।

আয়তনে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্র বাংলাদেশ জনসংখ্যায় পৃথিবীর অষ্টম। অর্ধেক পৃথিবীজুড়ে অবস্থান রাশিয়ার চেয়েও বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি। এই জনসংখ্যার চাপ সামলাতে ঢাকায় নির্মাণ কাজ অনিবার্য। কিন্তু এই কাজ এতটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে হয় যে, ঢাকার বাতাস দখল করে নেয় বালু ও অন্যান্য বস্তুকণা।

শুধু বসতঘর-অফিস-আদালত নির্মাণই নয়, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজে মাটি-বালি রাস্তায় ফেলে রাখাও এর অন্যতম কারণ। শুষ্ক মৌসুমে যা বাতাসে মিশে সরাসরি প্রবেশ করছে মানুষের ফুসফুসে। এছাড়া কার্বন নিঃসৃত কালো ধোঁয়া ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ক্ষতিকর গ্যাস তো আছেই।

উত্তরবঙ্গের একটি জেলা শহর থেকে আমি ঢাকায় এসেছি ২০০৪ সালে। ২০ বছরে ঢাকায় সবুজের পরিমাণ কমে যাওয়া আমি নিজে পর্যবেক্ষণ করেছি। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এই শহরে শুধু ভবন আর ভবন। কোথাও গাছ নেই। চারদিকে শুধুই কংক্রিটের স্তূপ।

পরিবেশ গবেষক নওশিন নাওয়ার ও তার সঙ্গীদের এক গবেষণায় উঠে এসেছে ঢাকার বিরানভূমি হয়ে ওঠার চিত্র। তার গবেষক দল জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং পদ্ধতিতে স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল ৩০ বছরে ঢাকা শহরে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ কমেছে ৫৬ শতাংশ।

১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরে সবুজের পরিমাণ যেখানে ছিল মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ, সেখানে ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তার মানে, এই তিন দশকে ঢাকা শহরের সবুজ কমেছে ৮৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। যা বাতাসের মান নির্ধারণে বড় নিয়ামক। গবেষক দল শঙ্কা প্রকাশ করেছে, খুব দ্রুত ঢাকা শহর ইমারতের জঙ্গলে পরিণত হবে। নগর হয়ে উঠবে একেবারে বসবাস অযোগ্য।

ঢাকার বাতাসের মান রাতারাতি ব্রিজবেনের মতো হবে—এটা আমি আশা করি না। কিন্তু জ্যামিতিক হারের দূষণ রোধ ও সবুজ নিধনতো রোধ করা যায়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নির্মাণ কাজ বন্ধ করা যায়। পরিকল্পিতভাবে কিছু জলাধারও সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু এসব কাজে কারও আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

আগামী প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য পরিবেশ উপহার দেওয়া বর্তমান প্রজন্মের দায়। এই দায় ও দায়িত্বে অবহেলার কোনো স্থান নেই। এটা ভাববার কারণ নেই, আমার কী? আমি তো ভালো আছি, আমার সন্তান তো নিরাপদে আছে!

পরিবেশের দূষণ ও বিপর্যয় একটি সামষ্টিক বিষয়। এই যুদ্ধে একা নিরাপদ থাকার সুযোগ নেই। এখানকার বিপদ সবার, সামষ্টিক। সামষ্টিক বিপদকে অনুধাবন করে, বিশুদ্ধ বাতাসের নগর ও দেশ গড়ে তুলতে সবাই সচেষ্ট হোন, এটাই কামনা।

রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]