অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তিনি বলেন, পরিষ্কার বলতে চাই, আপনি সোজা থাকবেন। আমাদের জন্য বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য আমরা পক্ষপাতিত্ব চাই না। আগামী ৮/১০ মাস পর যদি নির্বাচন হয় তখন আপনি সোজা থাকবেন কি না, সেই নিরপেক্ষতার প্রমাণ আপনাকে এই ৮/১০ মাসে দিতে হবে।
শনিবার (২৮ জুন) রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত জাতীয় মহাসমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা।
গোলাম পরওয়ার বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে, রাজনীতির ইতিহাসে আজকের দিন এক ঐতিহাসিক দিন। কেন ঐতিহাসিক দিন? মুসলিম উম্মার নেতৃত্বদানকারী, দেশপ্রেমিক, সব ইসলামিক দল, ব্যক্তিত্ব, স্কলারদের মধ্যে ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও আজ ঐতিহাসিক ঐক্যের পরিবেশ ও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ রেজাউল করিমকে রাহবার উল্লেখ করে বলেন, তার নেতৃত্বে আজ যারা মঞ্চে বসে আছেন তারাই মূলত এই ঐক্যের মহাকাণ্ডারি। আজ নেতাদের উপস্থিতি ও পীর সাহেব চরমোনাইয়ের ভূমিকা নতুন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ও সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে উদ্দেশ করে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, আজকের এই সমাবেশ থেকে, আজকের এই জনসমুদ্র থেকে আপনারা বার্তা বুঝতে যদি ভুল করেন। পিআর পদ্ধতি ছাড়া বাংলার মানুষ নির্বাচন গ্রহণ করবে না।
‘প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশনারকে বলব নিরপেক্ষ থাকার অঙ্গীকার করেছেন। আপনার অঙ্গীকারের প্রতি আপনি সাবধান থাকবেন। আপনার কোনো কোনো ভূমিকায় জাতির মধ্যে কিন্তু সংশয় তৈরি হয়েছে। পরিষ্কার বলতে চাই, আপনি সোজা থাকবেন। আমাদের জন্য বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য আমরা পক্ষপাতিত্ব চাই না। ২০১৭ জনতার জীবন, হাজার হাজার মানুষের রক্ত, ১৭-১৮ বছর বয়সী মানুষের ফাঁসি, অত্যাচার, জুলুম, রিমান্ড ক্রসফায়ারের পরও আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখরা যে ত্যাগ করেছেন সেই সংগ্রাম আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।’
ড. ইউনূসকে উদ্দেশ করে গোলাম পরওয়ার বলেন, জাতির যে দাবি উচ্চারিত হয়েছে, আপনাকে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। জাতির উদ্দেশে ভাষণে একটা কথা বলবেন, হেড অব দ্য গভর্নমেন্ট একটা কথা বলবেন, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একটা কথা বলবেন কিন্তু কিন্তু কোনো একটা দলের সঙ্গে আলোচনায় গিয়ে আপনি সেই কথা ভুলে যাবেন। এতে নিরপেক্ষতা ভঙ্গ হয়েছে। আমরা বারবার বলছি আপনি সোজা থাকুন। রাজনৈতিক সংলাপে আপনি ভুল করেননি, বৈঠক করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু এক জায়গায় কথা বলে কেন আপনি মত পরিবর্তন করবেন? আপনাকে জাতির সামনে আসতে হবে। সব দলের সঙ্গে বসে আপনি বলবেন, ভাই আমার তো এই অসুবিধা, আসুন আমরা সবাই মিলে এটাই করি। তাহলে আমরা বুঝব। রাজি আছি। কিন্তু আপনার এই ভূমিকায় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, আগামী ৮/১০ মাস পর যদি নির্বাচন হয় তখন আপনি সোজা থাকবেন কি না, সেই নিরপেক্ষতার প্রমাণ আপনাকে এই ৮/১০ মাসে দিতে হবে।
তিনি বলেন, আপনাকে নির্বাচনের আগে যে শর্ত, মানবতাবিরোধী, গণহত্যাকারীদের দ্রুত দৃশ্যমান বিচার করতে হবে। দিল্লিতে বসে দিল্লির তাঁবেদার শেখ হাসিনা উসকানি দিয়ে আবার বাংলাদেশকে ভারতের সেবা দাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে। সুতরাং নির্বাচনের আগেই আমরা বিচার দৃশ্যমান দেখতে চাই।
সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, সংস্কার নিয়ে অনেকে ঢিলা দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন, নির্বাচন আর সংস্কার একসঙ্গে করবেন। ক্ষমতায় যাওয়ার পর সংস্কার করবেন। কীভাবে বুঝলেন, ক্ষমতায় কে যাবেন? জনগণের ভোট, তারপর ক্ষমতায় যেতে হবে। আর ফ্যাসিবাদী আমলের রাজনৈতিক, সাংবিধানিক যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, সেই কাঠামো তছনছ করে দিয়ে নতুন বাংলাদেশের নতুন কাঠামো গড়তে সংস্কারের প্রয়োজন। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে আমরা কোনো ফ্যাসিবাদ বা নতুন কোনো হাসিনার আর জন্ম দিতে চাই না। এজন্য সংস্কার আমাদের করতেই হবে।
আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করতে হবে। ১ কোটি ১০ লাখ প্রবাসীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে দেওয়ার দাবি জানিয়ে গোলাম পরওয়ার বলেন, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বার্ষিকী পালন করব, তার আগেই সেটা করতে হবে।
তিনি বলেন, পীর সাহেব চরমোনাই জাতীয় ঐক্য গড়তে চেষ্টার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক, উদারতার ইতিহাসে স্রষ্টা হয়ে থাকলেন। আগামী দিনে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্মকে ঠেকাতে হবে। এই ঐক্যের মাধ্যমে পীর সাহেব চরমোনাই যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রামেগঞ্জে, শহরে নগরে বন্দরে ওলামায়ে কেরাম, মুসলিম উম্মার নেতৃত্বদানকারী জনগণের এই ঐক্যের পরিবেশ দেখে, আজকে এক মঞ্চে দেখে ঐক্যের জোয়ার শুরু হয়েছে। আসুন ভেদাভেদ, ভিন্নমত পরিহার করে মুসলিম জাতিসত্তা মূল্যবোধ রক্ষার জন্য, আল্লাহর দ্বীনকে পার্লামেন্টে নিয়ে ন্যায়বিচার, সুশাসন, বৈষম্যহীন এক নতুন সমৃদ্ধ মানবিক বাংলাদেশ গড়তে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব।