গাজা উপত্যকায় পশ্চিমা শক্তির সমর্থনে পরিচালিত ইসরাইলি গণহত্যা এখন সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ বিশ্ব এখনও যেন ঘুমিয়ে আছে।
চলতি গ্রীষ্মে ফিলিস্তিনিদের হত্যার সংখ্যা আরও বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন নিহত হচ্ছেন। যাদের অধিকাংশই ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের সঙ্গে লড়াই করছেন।
গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। ইসরাইল ও মিশরের অবরোধে থাকা ছোট্ট উপকূলীয় এই অঞ্চলটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা হয়ে উঠেছে তাদের জন্য।
২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবরেই ইউনিসেফ গাজাকে ঘোষণা করেছিল ‘শিশুদের জন্য এক বিশাল কবরস্থান, আর বাকিদের জন্য জীবন্ত নরক’। এ মন্তব্য পরে আরও বহু জাতিসংঘ কর্মকর্তারা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সর্বশেষ ১২ জুলাই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, গাজায় ‘ম্যাকিয়াভেলীয় কৌশলে গণহত্যা’ চালাচ্ছে ইসরাইল।
ইসরাইলি মন্ত্রীরা ও রাব্বিরা (ইহুদি ধর্মের পণ্ডিত) ঘোষণা দিয়েছেন, গাজায় কোনও নিরীহ মানুষ নেই। প্রতিটি ফিলিস্তিনি শিশু জন্মের পরপরই সন্ত্রাসী। মায়েদেরও হত্যা করো, কারণ তারা সন্ত্রাসী জন্ম দেয়।
অস্থায়ী তাঁবুতে, স্কুল আশ্রয়কেন্দ্রে, এমনকি ঘরের ভিতরেও শিশুদের উপর বোমা বর্ষিত হচ্ছে। এমনকি গর্ভাবস্থাতেও নিরাপদ নয় তারা—বোমার আঘাতে ভ্রূণ পর্যন্ত ছিটকে পড়ছে।
গত সপ্তাহে আট মাস বয়সি গর্ভের সন্তান সাঈদ সামের আল-লাক্কার বিচ্ছিন্ন দেহের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মূলধারার গণমাধ্যমে তা প্রচার হয়নি। গণমাধ্যমের এই নীরবতা ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি গণহত্যার পরিকল্পনাকে টিকিয়ে রাখছে প্রায় ২১ মাস ধরে।
যখন শিশুদের মৃত্যু স্বীকারও করা হয়, তখনও তারা পরিণত হয় শুধু সংখ্যা বা পরিসংখ্যানে। কিন্তু তাদের হত্যা কখনও ‘দুর্ঘটনাবশত’ হয়নি। এটি ছিল সচেতন একটি পদক্ষেপ—ইসরাইল যে ভবিষ্যতের আশঙ্কা করে তা ধ্বংস করার প্রয়াস।
কারাগার থেকে শাহাদাত
২০২৫ সালের ১২ জুলাই, মাত্র ১৭ বছর বয়সি ইউসুফ আল-জাক গাজা শহরে তার ভাতিজি মারিয়া ও ভাতিজা তামীমসহ এক ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হয়। ২০০৮ সালে ইসরাইলি কারাগারে জন্ম নেওয়া ইউসুফ ছিল এক সময়ের সবচেয়ে কনিষ্ঠ ফিলিস্তিনি বন্দি।
তার মা ফাতেমা আল-জাক ২০০৭ সালে পশ্চিম তীর অতিক্রম করতে গিয়ে আটক হন এবং বন্দিত্বের প্রথম দিকে জানতে পারেন তিনি গর্ভবতী। ইসরাইলি বাহিনী বারবার তাকে গর্ভপাত করানোর জন্য নির্যাতন করে।
অবশেষে এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন ফাতেমা, কিন্তু প্রসবের সময় তার হাত ও পা বাঁধা ছিল এবং চিকিৎসা সেবায়ও কার্পণ্য করে তারা।
ইউসুফ তার জীবনের প্রথম ২০ মাস কাটান জেলে। ২০০৯ সালে ইসরাইলি বন্দি গিলাদ শালিতের একটি জীবিত ভিডিও বিনিময়ে ১৯ জন নারী বন্দির সঙ্গে ইউসুফ ও তার মা মুক্তি পান।
তার চাচাত ভাই সাংবাদিক আহমেদ সাহমুদ বলেন, ইউসুফ ছিল পরিবারের একটি ফুল। খুব শান্তশিষ্ট ও সবার প্রিয়। সে মুক্ত জীবন কাটাতে চাইত, ঘুরে বেড়াতে চাইত।
হত্যার টার্গেট ‘শিশু’
ইউসুফের জীবনগাঁথা গাজার শিশুদের জন্য আদর্শ হওয়া উচিত ছিল না। সে জন্ম নিয়েছিল কারাগারে, জীবন কাটিয়েছে এক খোলা-আকাশের কারাগারে।
গত ২১ মাসে মৃত্যু যেন গাজার বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে—এটি ন্যূনতম হিসাব। যাতে এখনও ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা হাজার হাজার শিশুর তালিকা অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
অর্থাৎ, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন শিশু নিহত হয়েছে—প্রতি ৪৫ মিনিটে একটি শিশুর প্রাণহানি।
এই শিশুদের লক্ষ্যবস্তু বানানো কোনো ‘দুর্ঘটনা’ নয়। আধুনিক অস্ত্র, নজরদারি ব্যবস্থা—সবকিছু দিয়েই ইসরাইল বুঝে-শুনে শিশুদের টার্গেট করছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বরাবরই ‘আমালেক’ নামক বাইবেলীয় গল্প টেনে এ হত্যাযজ্ঞকে ধর্মীয়ভাবে বৈধতা দিয়েছেন।
ইসরাইলি মন্ত্রীরা ও রাব্বিরা (ইহুদি ধর্মের পণ্ডিত) ঘোষণা দিয়েছেন, গাজায় কোনও নিরীহ মানুষ নেই। প্রতিটি ফিলিস্তিনি শিশু জন্মের পরপরই সন্ত্রাসী। মায়েদেরও হত্যা করো, কারণ তারা সন্ত্রাসী জন্ম দেয়।
এই কৌশল নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে চায়। এখন সেটি নীতিগত অবস্থানে পৌঁছেছে—গাজার জনসংখ্যা কমানো এখন সরকারি কৌশল।
ফিলিস্তিনি সমাজ নিধন
কেন শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়? কারণ গাজার এক মিলিয়ন শিশু মানে একটি নতুন প্রজন্ম—যা ইসরাইলি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এই হত্যার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো—একটি সমাজের প্রজন্মগত পুনরুৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। সমাজ, পরিবার, শিক্ষা—সবকিছু ভেঙে ফেলা।
একদিকে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তাৎক্ষণিক হত্যা, অন্যদিকে ক্ষুধা, কারাবন্দিত্ব, চিকিৎসাব্যবস্থার ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নির্মূলকরণ।
এভাবে ফিলিস্তিনি সমাজের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ভেঙে ফেলার মাধ্যমে দখলদাররা নতুন বসতি নির্মাণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটের সুযোগ নেয়।
ব্রিটিশরা ১৯৫০-এর দশকে কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহ দমন করতে ১৫ লাখ কিকুয়ু মানুষকে বন্দি শিবিরে আটকে রেখেছিল। সেখানেও ছিল দুর্ভিক্ষ, ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড।
ফ্রান্সও ১৯৫৪-৬২ সালের আলজেরীয় মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই মিলিয়ন মানুষকে বন্দি শিবিরে স্থানান্তর করে তাদের চলাচল ও জীবনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল।
ভবিষ্যতের মুক্তিযোদ্ধা
ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইসরাইলি—সকল ঔপনিবেশিক শক্তির কৌশল এক: কেবল দখল নয়, স্মৃতি ও পরিচয় নিশ্চিহ্ন করা, সমাজ টুকরো টুকরো করা, ভবিষ্যতের প্রতিরোধ দমন করা।
তাহলে আবারও প্রশ্ন উঠে—কেন গাজার শিশুদের হত্যা করা হয়? তারা হলো সেই ভবিষ্যৎ—যারা ইতিহাস জানে, যাদের বুকভরা স্বপ্ন ও সাহস। অবরোধ ও বোমাবর্ষণের মধ্যেও যেসব সমাজে সাক্ষরতার হার সর্বোচ্চ, সেখানে প্রতিটি শিশু একটি প্রতিরোধের প্রতীক। বই হাতে একটি শিশু দখলদারদের চোখে বোমার চেয়েও ভয়ংকর।
তাই শিশুদের হত্যা ‘দুর্ভাগ্যজনিত ক্ষয়ক্ষতি’ নয়। এটি একটি সুপরিকল্পিত কৌশল। এর মাধ্যমে ইসরাইল শুধু জীবন নয়, ভবিষ্যৎ, স্মৃতি, আশা—সবকিছু ধ্বংস করতে চায়।
লেখক: ফিলিস্তিনি সাংবাদিক