অনেক আলাপ-আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কমে ২০ শতাংশ নির্ধারিত হলো। এর মাধ্যমে আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান হয়েছে। বলা চলে, কিছুটা স্বস্তির জায়গায় আমরা এসেছি। কারণ, ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ হলে চলমান যে ১৫ শতাংশ শুল্ক আছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটি ৫০ শতাংশে দাঁড়াত। এখন তা মোট ৩৫ শতাংশ হলো। যদিও এটা অনেক উচ্চহার। তার পরও আমাদের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ আছে, তাদের সাপেক্ষে এটি আমাদের কিছুটা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দেবে। কারণ, ভিয়েতনামের ওপরও ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ। ভারতের ওপর আবার ২৫ শতাংশ। তার মানে, ভারত বাদ দিলে মোটামুটি সবাই সমপর্যায়ে আছে।
অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হওয়ার কারণে মার্কিন বাজারে চাহিদার অবনমন হতে পারে। এটার জন্য বাংলাদেশকে ছাড়ও দিতে হয়েছে। যদিও সব শর্ত জানা আমাদের সম্ভব হয়নি, তার পরও আমরা জেনেছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং বিমান কেনা, গম কিংবা এলএনজি আমদানি ইত্যাদি করতে হবে। অর্থাৎ, এখানেও ট্রেড-অফের (এক জিনিস পাওয়ার জন্য অন্য কিছু ছেড়ে দেওয়া) বিষয় আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে আরও কিছু দাবি ছিল। যেমন, মেধাস্বত্ব আইন, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ইত্যাদি সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই আমাদের দেখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বা নতুন করে সেখান থেকে অতিরিক্ত আমদানি আমাদের অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি করবে। বস্তুত ট্রাম্পের এই উদ্যোগে বিশ্ব বাণিজ্যের ওপরই একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ওপরও প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহুপক্ষীয় যে বাণিজ্যিক ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল, সেখানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এবারের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বহুপক্ষীয় কিংবা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে সংকট তৈরি করবে। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে দুর্বল করে দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই নানাবিধ বিষয় লক্ষ্য রেখেই আলোচনা করে ২০ শতাংশ ঠিক করেছে। এটা ডব্লিউটিওর সঙ্গে আলোচনা নয়, যেখানে এক দেশের এক ভোট। বরং যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের আলোচনা করতে হয়েছে। আমাদের যেসব বিষয়ে ছাড় দিতে হয়েছে, নিশ্চয়ই তার একটা অর্থনৈতিক মূল্য আছে। তবে ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামার ফলে আমরা আমাদের মূল প্রতিযোগীদের সাপেক্ষে একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে যেতে পেরেছি।
এর জন্য যে আমরা ছাড় দেব তাও লক্ষণীয়। যেমন, ইউক্রেন থেকে গম আনলে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে খরচ কম পড়ত। এলএনজি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনলে খরচ কম পড়ত। আবার এত বিমান কেনার পরিস্থিতি আমাদের হয়তো এখন নেই, তার পরও সে পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। গমের কথা যদি বলি, সরকার আনলে হয়তো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যবহার করবে, তার মানে ভর্তুকি দিয়ে সরকারকে আনতে হবে। আবার ব্যক্তি খাত যদি এই গম আমদানি করতে চায়, তবে সরকারকে সেভাবে তাদের সহযোগিতা করতে হতে পারে, যাতে অন্য দেশের বদলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়।
আরেকটা বিষয়, চীনের সঙ্গে শুল্কের যে পার্থক্য আগে ছিল, সে কারণে আমাদের পোশাকশিল্প কিছুটা লাভবান হচ্ছিল। জুতাসহ অন্যান্য শিল্পও সেভাবে লাভবান হয়েছে। আগে চীনের ওপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক ছিল। এখন আমরা দেখছি, সেখানে ৩০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে। যদি আগের ২০ শতাংশের সঙ্গে এটি যোগ হয়, তবে আমাদের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু যদি মোট ৩০ শতাংশ হয়, তবে আমাদের জন্য নেতিবাচক। ফলে এসব বিবেচনা রাখতে হবে।
এরপরও বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কিছুটা লাভবান হতে পারি, যদি ক্রেতাদের সঙ্গে সেভাবে দরকষাকষি করতে পারি। যেমন, ভিয়েতনামের সঙ্গে একই পণ্যে আমরা প্রতিযোগিতা করছি, উভয়ের শুল্কও সমান। এ ক্ষেত্রে লাভবান হতে গেলে যে মূল্যে আমরা বিক্রি করতে পারব, তা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, আগে একটা পণ্যের দাম ছিল ১০ ডলার। এখন ব্যবসায়ীরা চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষি করে দাম কিছুটা বাড়াতে পারে। এমনও হতে পারে, উভয়ের সম্মতিতে শুল্কের পরিমাণ কিছুটা ক্রেতার ঘাড়ে এবং কিছুটা নিজে নিতে পারে। এতে একই শুল্ক সত্ত্বেও আমরা প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে থাকতে পারি।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)