নাটোর সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই দেশের একমাত্র ওষুধি গ্রাম লক্ষ্মীপুর–খোলাবাড়িয়ার অবস্থান। এ গ্রামে ঢুকতেই চারপাশে সবুজের যে অবারিত সমারোহ চোখে পড়ে তা কোনো সাধারণ কৃষি ফসল নয়, এ যেন এক বিশাল ভেষজ উদ্যান। দেশের একমাত্র এই ভেষজ পল্লি এখন নাটোরের ঐতিহ্য, ইতিহাস আর জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে।
ভেষজ চাষ এই অঞ্চলের হাজারো মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে, গড়ে তুলেছে শত কোটি টাকার গ্রামীণ অর্থনীতি। অ্যালোভেরা, অশ্বগন্ধা, শিমুল মূলসহ প্রায় দেড়শ ধরনের ভেষজ উদ্ভিদের চাষে ভরে উঠেছে পুরো ভেষজ গ্রাম।
স্থানীয়রা জানান, এই ভেষজ বিপ্লব শুরু হয় প্রায় তিন দশক আগে। খোলাবাড়িয়ার আফাজ পাগলা নিজের কবিরাজি কাজে তখন তার বাড়ির আঙিনায় প্রয়োজনীয় গাছপালা লাগাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে, পরে পুরো গ্রামে। আজ সেই ছোট্ট প্রয়াসই রূপ নিয়েছে বিস্তীর্ণ ভেষজ পল্লিতে। এখানকার গ্রাম-গঞ্জে হাঁটলেই দেখা যায় ভেষজ গাছের সারি। আবাদি জমির পাশাপাশি বাড়ির উঠোন, ঘর-দুয়ারের ফাঁক-ফোকর, রাস্তার ধারেও চোখে পড়বে ওষুধি গুণসম্পন্ন সব গাছ।
স্থানীয় কৃষি দপ্তরের হিসাবে, লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়ায় প্রায় ১৫৫ হেক্টর জমিতে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করেছে অ্যালোভেরা। ৭০ হেক্টর জুড়ে শুধু এই ঘৃতকুমারীর চাষ করা হয়েছে। বছরে প্রায় ১৫ হাজার টন অ্যালোভেরা উঠছে এই পল্লী থেকে। এ ছাড়া শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, বিটরুট, মিশ্রি দানা প্রতিটি ফসলই গ্রামের অর্থনীতিতে যুক্ত করছে নতুন মাত্রা। দুই হাজারের বেশি কৃষক এখন এই চাষে যুক্ত। আর তাদের শ্রমের ফলেই বাজারে উঠছে শত কোটি টাকার ভেষজ পণ্য।
অ্যালোভেরা চাষে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। এক বিঘা জমিতে রোপণ করা হয় প্রায় ১০ হাজার অ্যালোভেরার চারা। চারা লাগানোর তিন মাস পর থেকে পাতা সংগ্রহ শুরু হয়, যা টানা দুই বছর পর্যন্ত চলে। আলোভেরা চাষে প্রাকৃতিক জৈব সার ছাড়াও যথাযথ পরিমাণ ইউরিয়া-টিএসপি-এমওপি ব্যবহার করা হয়। পাতায় দাগ বা পচন ঠেকাতে ব্যবহৃত হয় চুন। আর পোকামাকড়ের ক্ষতি কমাতে এখন কৃষকরা ঝুঁকছেন ছত্রাকনাশক টাইকোডার্মা ও সেক্স ফেরোমোনের দিকে।
ভেষজ চাষাবাদকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে লক্ষীপুর-খোলাবাড়িয়াসহ আশপাশের এলাকার অন্তত ১০ হাজার মানুষের। চারা রোপণ, সেচ, আগাছা পরিষ্কার আর পাতা সংগ্রহ বিভিন্ন কাজে বছর জুড়ে ব্যস্ত থাকেন শ্রমিকরা।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, অতিরিক্ত বৃষ্টিতে অ্যালোভেরার গাছ পচে নষ্ট হয়ে যায়। চলতি বছরের টানা বৃষ্টিতে বেশির ভাগ জমির গাছেরই ক্ষতি হয়েছে। তবে একবার অ্যালোভেরা চাষ করলে টানা দুই বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। সেই ভরসায় এ বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশায় এখন পরের মৌসুমের দিকেই তাকিয়ে আছেন কৃষকরা।
এই ভেষজ গ্রামে বিপুল পরিমাণ অ্যালোভেরা উৎপাদিত হলেও এর পাতা সংরক্ষণে কৃষকরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন। অ্যালোভেরা পাতা কাটার পর তা বেশি সময় রাখা যায় না। স্থানীয়ভাবে কোনো হিমাগার বা প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র না থাকায় দ্রুত পাঠাতে হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওষুধ কোম্পানিগুলোর কারখানায়। হামদর্দসহ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি এখানকার অ্যালোভেরার বড় ক্রেতা। ময়মনসিংহের ভালুকায় বিদেশি মালিকানাধীন জুস কোম্পানিও প্রতিদিন ট্রাকভর্তি পাতা সংগ্রহ করে। ঢাকার বাজারেও প্রায় প্রতিদিন পৌঁছায় ট্রাকভর্তি ভেষজ পণ্য।
অন্যদিকে শুকনো ভেষজ বিক্রি হচ্ছে নতুনবাজার, আমিরগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরসহ স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ব্যবসাকেন্দ্রে। ইব্রাহিম ভেষজ ভাণ্ডারের পরিচালক আতিকুর রহমান জানান, প্রতিদিন তার দোকান থেকেই গড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকার ভেষজ বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানকার পণ্য কিনে নিয়ে যান।
কৃষক ও সমবায় নেতাদের দাবি, অ্যালোভেরা সংরক্ষণের জন্য একটি আধুনিক হিমাগার এবং সাবান-শ্যাম্পুসহ ভেষজ প্রসাধনী তৈরির কারখানা হলে এলাকার অর্থনীতি বদলে যেতে পারে।
খোলাবাড়িয়া ভেষজ সমবায় সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ ভেষজ গবেষণা কেন্দ্র প্রয়োজন। গুণাগুণ পরীক্ষা আর মান নিয়ন্ত্রণের কাজ যদি এখানেই হয়, বড় বড় কোম্পানি নিজেই আমাদের দোরগোড়ায় আসবে। এতে করে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবেন।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ভেষজ শিল্পকে ঘিরে এ অঞ্চলের অন্তত দশ হাজার মানুষের জীবিকা তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে চাষের পরিধি, যুক্ত হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা। শুধু কৃষিই নয়, পর্যটন, ব্যবসা এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্পের সম্ভাবনাও বাড়ছে দ্রুত।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাবিবুল ইসলাম মনে করেন, এখানে হিমাগার, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট আর গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে ভেষজ পল্লি দেশের একটি শক্তিশালী শিল্পকেন্দ্র হিসেবে দাঁড়াবে।