বৃহঃস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১


শ্বাসতন্ত্র পোড়া রোগীদের ৯৮ ভাগই মৃত্যুর কোলে


প্রকাশিত:
২৮ এপ্রিল ২০২১ ১৬:৪৮

আপডেট:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:৩৫

ছবি: সংগৃহীত

গ্যাস-বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবনযাপন চিন্তাই করা যায় না। গ্যাস-বিদ্যুতের সুবিধার সঙ্গে অসুবিধাও যে অনেক। একটু অসতর্কতায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। উনিশ থেকে বিশ হলেই দুর্ঘটনায় যাচ্ছে প্রাণ, বেঁচে থাকলেও বরণ করতে হচ্ছে আজীবন পঙ্গুত্ব।

প্রতিবছর দগ্ধ হয়ে কেবল রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে প্রায় ১ হাজার লোক ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। এর মধ্যে ৬০ ভাগের মৃত্যু হয় বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে এবং বাকি ৪০ ভাগের মৃত্যু হয় গ্যাস ও গ্যাসজাতীয় ও রাসায়নিক দ্রব্যের বিস্ফোরণে। আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৯৮ ভাগের মৃত্যু হয় শ্বাসতন্ত্র পুড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের।

কথা হয় জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, শ্বাসনালি পোড়া ৯৫-৯৮ ভাগ রোগীর অবস্থাই সংকটাপন্ন অবস্থায় মারা যায়। শ্বাসনালি অক্ষত কোনো ব্যক্তির শরীর ৪০ শতাংশ পর্যন্ত দগ্ধ হলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব। প্রতিবছরই দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বছরে প্রায় ৯ লাখের বেশি পোড়া রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। চিকিৎসা দিয়ে নয়, আগুন লাগা বন্ধ করতে হবে-তবেই সাধারণ মানুষ নিরাপদে থাকতে পারবে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। গত বছর ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩৭ জন বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়-চিকিৎসাধীন অবস্থায় সবার মৃত্যু হয়। সবার শ্বাসনালি পুড়ে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, শ্বাসনালি পোড়া ব্যক্তিদের বাঁচানো সম্ভব হয় না। তবে ১৫ ভাগ দগ্ধ ব্যক্তিদেরও মৃত্যু হয়। পেট্রল বা দাহ্য কোনো পদার্থে বদ্ধ কোনো জায়গায় যদি আগুন লাগলে তাহলে শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ার শঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের রোগীর সরাসরি ফুসফুসে প্রভাব সৃষ্টি করে। বাতাসের সঙ্গে ছোট উপাদান থাকে-যেগুলো ফুসফুসে গিয়ে সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এছাড়া বাতাসে যে মাইক্রো অর্গানিজম থাকে- সেগুলো শরীরের চামরা বা ত্বক ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু চামড়া পুরে গেলে খুব সহজেই ফুসফুস এবং মাংসপেশিতে সংক্রমণ তৈরি করে ফেলে।

বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা যায়, শুধু মাত্র শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বছরে দগ্ধ হয়ে আসা রোগীদের মধ্যে ১ হাজারেরও বেশি লোক মারা যাচ্ছে। অঙ্গহানির ঘটনা ঘটছে প্রায় ৭০০ রোগীর। পঙ্গুত্ববরণ করছে হাজার হাজার লোক। বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুতের তার, গ্যাসের পাইপ, সুইচ, সিলিন্ডার পরীক্ষা করে দেখা হয় না। সতর্ক না হলে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এমন ১০টি হাসপাতাল বানালেও তাতে সামাল দেওয়া যাবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিদুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষেরই যে ক্ষতি হচ্ছে তা নয়। বন্যপ্রাণীসহ সাধারণ পশু-পাখির জীবনও যাচ্ছে- ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের লামায় গত এক বছরে ৭টি হাতি বৈদ্যুতিক তারে পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বন্যপ্রাণী বিদ্যুতের তারে পৃষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে। পাহাড়-উঁচু স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি উঁচু না হওয়ায় এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।

বিস্ফোরক অধিদপ্তর বলছে, একটি গ্যাস সিলিন্ডারের লাইফটাইম থাকে ১০ থেকে ১৫ বছর। এর পর সেগুলো ধ্বংস করে ফেলতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে লাইফটাইম পার হওয়ার পরও গাড়িতে চলছে। তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণসংক্রান্ত ১৫ শতাধিক দুর্ঘটনায় ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে। বছরে গড়ে ৫-৬টি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় বছরে গড়ে নিহত হন ৭০ থেকে ৯০ জন। এছাড়া গ্যাস, রাসায়নিকের আগুনে গত ৫ বছরে প্রাণ গেছে ২১৩ জনের। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে সবার মৃত্যু হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

গত শুক্রবার রাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় রাসায়নিক গুদাম থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় বার্ন ইউনিটে ভর্তি ২০ জনের মধ্যে ৩ জন মারা গেছে। বাকিরাও শঙ্কামুক্ত নয়।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বসবাসকারী ব্যাংকার জাহানারা চৌধুরী জানান, গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণে তার দুই আত্মীয় মারা গেছে গত বছর জুনে। নিজের ৫ তলা বাড়ির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ভাড়াটিয়া বা আমরা কেউই আসলে সচেতনভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার করছি না। গ্যাস-বিদ্যুতের লাইন বা বিদ্যুতের মেইন লাইন ঠিক আছে কিনা তা তো সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। যারা সেবা দিচ্ছেন তারা তো কখনোই এসব দেখেন না।

রাজাধানীর সেগুনবাগিচায় ১২ তলা ভবনে একজন ভাড়াটিয়া জানান, তাদের বাসার নিচে ২০-২৫টি গ্যাসের সিলিন্ডার একত্রিত করে গ্যাস ব্যবহার করছে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা। যদি ওখানে একবার বিস্ফোরণ হয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পুরো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিলিন্ডারের সঙ্গে থাকা নিুমানের হোস পাইপ, রেগুলেটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও রাসায়নিকে বিস্ফোরণ হয়েই সবচেয়ে বেশি রোগী এ হাসপাতালে আসছে। এদিকে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের হিসাবে বলা হচ্ছে, তারা বছরে গড়ে প্রায় ২০ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলা করছে। এর প্রায় ৭০ ভাগই গ্যাস ও বিদ্যুতের।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম জানান, গ্যাস-বিদ্যুৎ মানুষের জীবনকে আলোকিত করবে, এটাই স্বাভাবিক কিন্তু তার পরিবর্তে অনেক জীবনকে অন্ধকার করে দিচ্ছে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে এসব দুর্ঘটনা বাড়ছে। সেবা প্রদানের সঙ্গে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই। গ্রাহককেও সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, ব্যবহারকারীদের মধ্যে যারা অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন-তারা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দুর্নীতি গড়ে তুলছেন। ব্যবহারকারীদের মধ্যে কোনো অনিয়ম হলে সঙ্গে সঙ্গে সেবা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কথা থাকলেও অবৈধ অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে তা হালাল করে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ এবং নকল বা নিুমানের বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জামের ব্যবহারের ফলেও দুর্ঘটনা ঘটছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top