জুলাই আন্দোলনে আহত সামিউলের এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে শঙ্কা
প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২৫ ১২:২৯
আপডেট:
১৬ জুন ২০২৫ ০০:০২

গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া বাগেরহাটের সামিউল শেখের জীবন এখন অনিশ্চিতের পথে। আর মাত্র ১১ দিন পর তার উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার অভাবে তার শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সামান্য আর্থিক সহায়তা পেলেও, সরকারি অনুদান বা স্বাস্থ্য কার্ড না পাওয়ায় তার পরিবার এখন হতাশায় ভুগছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়নের বাগদিয়া গ্রামের আইয়ুব আলী শেখের একমাত্র ছেলে সামিউল। ৪ আগস্ট বাগেহাট কোট চত্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্মম হামলার শিকার হন তিনি। রামদা, রড ও পাইপ দিয়ে তাকে এলোপাথাড়ি আঘাত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে বাগেরহাট সদর থানায় নিয়ে যায়, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে তার পরিবারকে তার অবস্থান সম্পর্কে জানানো হয়নি, যা তাদের মানসিক যন্ত্রণায় ফেলেছিল।
পরে রাত ১২টার দিকে সামিউলের মা রুবিয়া বেগম থানায় ছুটে গিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করেন। বাগেরহাট সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর বাড়ি ফিরলেও, আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে তাকে আরও কয়েকবার চিকিৎসা নিতে হয়েছে। মাথায় শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বাম হাতের মাংসপেশি কেটে গেছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন যা আর কখনো পুরোপুরি ঠিক হবে না। পিঠের শিরা ও মাংসপেশিতেও মারাত্মক জখমের কারণে তাকে দীর্ঘদিন বিছানায় বিশ্রামে থাকতে হয়েছে। এখনো তিনি হাত দিয়ে ঠিকমতো কিছু ধরতে পারেন না, বসতে পারেন না, সারাদিন শুয়ে কাটে।
সামিউল কাঁপা কণ্ঠে বলেন, এই মাসের ২৬ তারিখেই আমার এইচএসসি পরীক্ষা। এখন পর্যন্ত ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারি না। সুস্থভাবে বসতে, বা খেতে কিছু পারি না। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমি রাস্তায় নেমেছিলাম, আজ সেই বৈষম্যই আমার জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতগুলো দিন পার হয়ে গেল, কিন্তু এখনো উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো না। সরকার অন্যদের চিকিৎসার জন্য সহায়তা করেছে, আমাকে কেন করছে না? জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছি, যা আমার চিকিৎসার খরচের কাছে সামান্য। আমাকে 'সি' ক্যাটাগরিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনো স্বাস্থ্য কার্ড পাইনি। আমি যদি সুচিকিৎসা না পাই, হয়তো কখনো সুস্থভাবে দাঁড়াতে পারব না।
সামিউলের বাবা আইয়ুব আলী শেখ বলেন, আমার ছেলে গণঅভ্যুত্থানে আহত হয়েছে, অথচ ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও সে এখনো সুস্থ হয়নি। বাগেরহাট, খুলনা, ঢাকা ও ঢাকা নিরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছি, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। ওর পরীক্ষা সামনে, কিন্তু ও কীভাবে পরীক্ষা দেবে? আমরা সরকারের কাছে সামিউলের উন্নত চিকিৎসার দাবি জানাই।
সামিউলের মা রুবিয়া বেগম বলেন, আমার ছেলেটা বিছানায় শুয়ে আছে। ওর কষ্ট দেখতে পারি না। ও ভালো করে বসতে পারে না, হাঁটতে পারে না। পরীক্ষা নিয়ে ওর চিন্তা দেখে আমাদেরও বুক ফেটে যাচ্ছে। সরকার যদি একটু সহযোগিতা করে, তাহলে হয়তো আমার ছেলেটা সুস্থ হতে পারবে।
রনদিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, সামিউল খুব মেধাবী শিক্ষার্থী। জুলাই অভ্যুত্থানে বাগেরহাট কোর্ট চত্বরে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। ওর বাবা দীর্ঘ দশ মাস ধরে বাগেরহাট, খুলনা, ঢাকা সবখানে চিকিৎসা করাচ্ছেন, কিন্তু এখনো পর্যন্ত সুস্থ হতে পারেনি। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করব, তারা যদি সামিউলকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে পরীক্ষার সুযোগ করে দেয়। তাহলে সে অনেক ভালো করতে পারবে।
প্রতিবেশী সামিউলুল দোহা বলেন, সামিউল আমাদের এলাকার ছেলে। ওর এই অবস্থা দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে সে আজ এই অবস্থায়। আমরা চাই সরকার তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিক এবং তাকে সুস্থ করে তুলুক।
বাগেরহাট সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার সদ্দার বলেন, সামিউলের শরীরের অবস্থা অত্যন্ত জটিল। বিশেষ করে তার বাম হাতের মাংসপেশি এবং পিঠের শিরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা সহজে সারানো সম্ভব নয়। তার সুস্থতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিশেষায়িত চিকিৎসা ও থেরাপির প্রয়োজন। এখন তার পুরো বিশ্রামে থাকা জরুরি, নইলে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
বাগেরহাট জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম সদস্য শেখ বাদশা বলেন, তারা নিয়মিত সামিউলের খোঁজখবর রাখেন। আমরা ওর পরীক্ষার জন্য কীভাবে সুস্থভাবে দিতে পারে সে চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে তার উন্নত চিকিৎসা ও তার সুস্থতার জন্য আমরা সবাই মিলে কাজ করছি।
সামিউল শেখ শুধু একজন ছাত্র নয়, বরং বৈষম্যবিরোধী স্বপ্নের এক সাহসী সৈনিক। আজ তার জীবন থমকে আছে। অথচ তার চোখে এখনো পরীক্ষা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বিশেষ কোনো উপায়ে পরীক্ষা দিতে পারলে পরীক্ষায় ভালো কিছু করবে বলে আশা পরিবারের।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: