‘ছোটমাছ’ যেন সোনার হরিণ, তেলাপিয়া-পাঙ্গাসও যাচ্ছে সাধ্যের বাইরে!
প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২৫ ১২:০০
আপডেট:
২৪ আগস্ট ২০২৫ ১৬:১০

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’—একসময় এই প্রবাদটিই ছিল বাংলাদেশের মানুষের পরিচয়। ভাতের সঙ্গে মাছ, বিশেষ করে ছোট মাছ, ছিল সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের আহার। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় দিন দিন মাছ যেন হয়ে উঠছে একপ্রকার বিলাসী পণ্য।
বিশেষ করে একসময়ে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর ভরসার ছোট মাছ, তেলাপিয়া কিংবা পাঙ্গাসও এখন যেন চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। এই অবস্থায় ভোক্তারা নীরব ক্ষোভে ফুঁসলেও মধ্যসত্তভোগীদের দায়ী করে দায় এড়িয়েছেন বিক্রেতারা।
তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় দালালচক্র নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি বৃদ্ধি, নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রজননক্ষেত্র রক্ষার পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী মাছ চাষের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণও জরুরি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (২৩ আগস্ট) রাজধানীর বাড্ডা-রামপুরাসহ একাধিক বাজার ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
অর্থনৈতিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ৩.৬% এবং কৃষিভিত্তিক খাতের অবদানের অংশ প্রায় ২৫%। এছাড়া দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ চাষ, আহরণ, বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যুক্ত।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষে এবং মোট মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে। ২০২৩ সালে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু এই উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল সাধারণ ভোক্তার পাতে পৌঁছাচ্ছে না।
ছোট মাছ যেন সোনার হরিণ
গবেষণা বলছে, ছোট মাছ (যেমন- মোলা, কাচকি, পুঁটি, শিং, কই) পুষ্টিগুণে ভরপুর। এগুলো ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আগে গ্রামাঞ্চলের সহজলভ্য ছোট মাছ এখন হ্রদ, নদী ও খাল দখল, দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত আহরণের কারণে কমে গেছে। ফলে সরবরাহ কমে গিয়ে বাজারদর বেড়েছে কয়েকগুণ।
বাজার সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারে ছোট মাছের মধ্যে মলা মাছ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি, পুঁটি মাছ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, বাইলা মাছ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮৫০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, ট্যাংরা ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, আর চিংড়ি ৯০০ থেকে ১২০০ টাকায়।
রামপুরা বাজারে মাছ কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী আসাদুজ্জামান বলেন, সপ্তাহে অন্তত দু’দিন ছোট মাছ খেতাম। এখন বাচ্চাদের জন্য মাঝেমধ্যে অল্প করে কিনি, আর বাকি সময় পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছে চলে যায়। তবে মাছের বাইরে ব্রয়লার মুরগির মাংস বা ডাল দিয়েই চালাই।
তিনি বলেন, ছোট মাছ এক সময়ে ছিল গরিব মানুষের খাবার। বিশেষ করে পুটি, মলা কিংবা ট্যাংরা এখন পরিণত হয়েছে। দাম বাড়তি থাকায় এসব মাছ এখন চলে যাচ্ছে ধনীদের প্লেটে।
অন্যদিকে বিক্রেতারা বলছেন, জেলেদের জাল খরচ, পরিবহন খরচ আর বরফের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাছের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। রামপুরা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান জানান, এখন নদীতে মাছ কম। আবার যা আসে তা আনতে খরচ হচ্ছে দ্বিগুণ। আগে যেখানে এক ট্রাকে ৫ হাজার টাকা খরচ হতো, এখন সেটাই হচ্ছে ১০-১২ হাজার। সেই খরচ তো আমাদেরই তুলতে হয়।
সস্তার মাছও আর সস্তা নেই
তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস দীর্ঘদিন ধরে স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা ছিল। কিন্তু সেই ভরসাতেও যেন বাজারে আগুন দেখা গেছে। বিশেষ করে তেলাপিয়া কেজি ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা, পাঙ্গাস ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা। আগে যেখানে প্রতিদিন এসব মাছের ক্রেতা ছিল সবচেয়ে বেশি, এখন বাজারে তাদের সংখ্যা কমে গেছে।
মধ্য বাড্ডা কাঁচাবাজারে মাছ কিনতে আসা গৃহিণী আকলিমা আক্তার বলেন, অন্যান্য মাছের তুলনায় এখন তেলাপিয়া আর পাঙ্গাসই সস্তা মনে হয়, কিন্তু আগের দামের তুলনায় এগুলোও অনেক বেশি। প্রতিদিন মাছ খাওয়ার সাধ এখন স্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে।
এই বাজারের মাছ ব্যবসায়ী শহীদ মিয়া বলেন, হ্যাচারি থেকে মাছ আসছে কম, খাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে। এক কেজি মাছ বড় করতে যে খাবার লাগে তার দামই দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে মাছের দামও বেশি রাখতে হচ্ছে।
বাজারের সরেজমিন চিত্র
বাজার ঘুরে দেখা যায়, কাতলা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়, রুই ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, মৃগেল ৪৫০ টাকা, শিং মাছ ১২০০ টাকা, আইড় ১১০০ টাকা, কৈ ৮০০ টাকা এবং বোয়াল ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। এছাড়াও এক কেজির ওজনের ইলিশ মাছ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকা পর্যন্ত।
ক্রেতা-বিক্রেতারা বলছেন, আয়ের সঙ্গে বাজারদরের মিল নেই। এক স্কুলশিক্ষক আব্দুল হাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের স্যালারি একই আছে, কিন্তু বাজারে সবকিছুর দাম দ্বিগুণ। এখন মাছ কিনতে গেলে মনে হয়, বিলাসী কোনো পণ্য কিনছি।
দাম বৃদ্ধির পেছনে দায়ী যেসব কারণ
রাজধানীর বৃহত্তম মাছের আড়ৎ কারওয়ান বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন মাসের ব্যবধানে চাষের রুই মাছের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাছের ফিডের দাম কমলেও পরিবহনসহ অন্যান্য খরচের কারণে মাছের দাম বেশি রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মাছের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ফিরে আসার কারণে হু হু করে বাড়ছে দাম।
কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা আল আমিন বলেন, ‘বর্তমানে রুই মাছের দাম খুব বেশি। দুই কেজির ওপরে রুই মাছের দাম ৪৫০ টাকা করে কেজি। কোনো কোনো দিন দাম ৪৭০ টাকাও ওঠে। তিন মাস আগেও এ ক্যাটাগরির মাছের দাম ছিল ৩৫০-৩৮০ টাকা। এক কেজি ওজনের রুই মাছ তিন মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২৮০-৩০০ টাকা। এখন সেটা ৩২০-৩৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে সব সাইজের রুই মাছে দাম বেড়েছে ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত।’
দাম বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নদী-খাল শুকিয়ে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে নদী দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণে প্রাকৃতিক মাছের পরিমাণ কমছে। যেকারণে ছোটমাছসহ নদী-নালার মাছের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। এছাড়াও চাষের ক্ষেত্রে আমরা দেখি দ্রুত মাছ বড় করার জন্য চাষীরা প্রচুর পরিমাণ খাবার খাওয়াচ্ছে। আর এদিকে মাছের ফিড বা খাবারের দামও দ্বিগুণ বেড়েছে।
রামপুরা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, শুধু যে মাছের খাবারের দাম বেড়েছে তা নয়, জ্বালানির দাম বাড়ার ফলেও মাছ আনার খরচ বেড়েছে। এছাড়া মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বরফ ও ঠান্ডা সংরক্ষণের খরচও অনেক বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো গত কয়েকবছরে গরু-মুরগির দাম বাড়ায় মানুষ তুলনামূলক কম দামের মাছের দিকে ঝুঁকছে, ফলে চাহিদা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শারমিন সুলতানা বলেন, থিওরেটিক্যাল যে বাজার ব্যবস্থা আছে আমাদের দেশে, সেই পলিসির বাইরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের একটি বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কারণ, এখানকার ব্যবসায়ীরা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবসা করছেন। বাজার পলিসি সর্ম্পকে তাদের ধারণা নেই। ব্যবসায়ীরা যে পণ্যের চাহিদা বেশি, সেটি মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অল্পতে লাভবান হন। সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি ও বিকল্প সরবরাহ বাড়ানো না গেলে সাধারণ মানুষের জন্য মাছ খাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষক জানান, মাছ উৎপাদন কমে যাওয়াই মূল কারণ নয়, বরং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বেশি। সরাসরি উৎপাদক থেকে ক্রেতাদের কাছে মাছ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলে দামের চাপ কমবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: