তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট হলেন চীনের অপছন্দের ব্যক্তি, এরপর কী হবে?
 প্রকাশিত: 
 ১৪ জানুয়ারী ২০২৪ ০৭:৩০
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:৫১
                                বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে তিনি একজন ট্রাবলমেকার বা সমস্যা সৃষ্টিকারী এবং বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী। এখন তিনিই হবেন তাইওয়ানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। চীন তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ডের অংশ মনে করে। শি জিনপিং এই একত্রীকরণের বিষয়টিকে একটি লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। যদিও এই হুমকি বিগত বছরগুলোতে খুব একটা কাজে আসেনি।
বরং ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক প্রগেসিভ পার্টি বা ডিপিপিকে ভোট না দিতে চীনের বারবারের হুমকি সত্ত্বেও শনিবার উষ্ণ ও রৌদ্রজ্বল আবহাওয়ায় তাইওয়ানের লাখ লাখ মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন। তারা চিকিৎসক থেকে রাজনীতিকে পরিণত হওয়া ৬৪ বছর বয়সী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই চিং তেকে বেছে নিয়েছেন তাইওয়ানকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য।
ডিপিপির জন্য এটা টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা, যে দলটিকে চীন তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষের বলে মনে করে। এখন লাই কীভাবে বেইজিংকে ম্যানেজ করেন কিংবা বেইজিং বিষয়টি কীভাবে নেয়- মূলত এটিই তার শাসন বা প্রেসিডেন্সিকে নির্ধারণ করবে।
লাই অঙ্গীকার করেছেন যে তার মেয়াদ হবে পূর্বসূরি সাই ইং-ওয়েনের আট বছরের শাসনের ধারাবাহিকতা। তিনি শনিবার যে ভাষণ দিয়েছেন তিনি সেখানে বেশ সতর্ক হয়েই কথাবার্তা বলেছেন এবং সংলাপ ও সহযোগিতার ডাক দিয়েছেন।
নির্বাচনী প্রচারে পূর্বসূরি সাই ইং-ওয়েনের কথাই তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন- ‘স্বাধীনতা ঘোষণার প্রয়োজন নেই কারণ তাইওয়ান এখনি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র- এর নাম চীন প্রজাতন্ত্র-তাইওয়ান’।
যদিও লাই অনেক বেশি সতর্ক প্রেসিডেন্ট সাইয়ের চেয়ে বেশি স্পষ্টভাষী বলেই বিবেচনা করা হয়। তিনি ডিপিপির কমিটিতে উঠে এসেছিলো ‘নিউ ওয়েভ’ অংশের সদস্য হিসেবে যারা তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে।
লাই ও তার রানিং মেট সিয়াও বি-খিম দুজনই বেইজিংয়ের কাছে খুবই অপছন্দের ও অবিশ্বস্ত। তাদের দুজনের মূল চীনা ভূখণ্ড ও হংকং ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে চীন। সিয়াও এর বাবা তাইওয়ানিজ কিংবা মা আমেরিকান। তিনি নিজেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে তাইওয়ানের প্রতিনিধি ছিলেন।
এসব কারণে চীন নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে সংলাপে যাবে-এটা খুবই অনিশ্চিত। উভয় পক্ষের মধ্যে ২০১৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিক কোন যোগাযোগও নেই। তাইওয়ান মূল চীনের অংশ-এটা মানতে মিজ সাই অস্বীকৃতি জানানোর কারণে চীন ক্ষুব্ধ হয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
শনিবারের ভোটের রায়ের আরেকটি মানে হলো তাইওয়ানকে ঘিরে উত্তেজনা অব্যাহত থাকা এবং প্রতিদিনই চীনা জাহাজ এবং সামরিক বিমানের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটতে থাকা। চীন সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে তার অসন্তুষ্টির বার্তা দিতে পারে, যেমনটি তারা করেছিলো ২০২২ সালে তখনকার যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের সময়। তাইপে তখন চীনের বিরুদ্ধে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ এনেছিলো।
চীন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপও বাড়াতে পারে। তাইওয়ানের বিভিন্ন কোম্পানি, পণ্য ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। চীনা সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য মি. লাইয়ের কৌশল হতে মিস সাই যা করে গেছেন তাকে অনুসরণ করা।
তিনি তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীর জন্য আরও ব্যয়, সাবমেরিন তৈরির কর্মসূচি চালু রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সাই বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কিছু বিষয় উদ্বেগের হতে পারে যে লাইয়ের শাসনকাল তার স্বাধীনতাকামী রাজনীতির অভিজ্ঞতার কারণে কোন উস্কানির তৈরি করে কি-না। যদিও তার রানিং মেট মিস সিয়াও বাইডেন প্রশাসনের কাছে আশ্বাসমূলক। হয়তো তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিবেন যে লাই বেইজিংকে কোন উস্কানি দেবেন না বলে বিশ্বাস করা যায়।
কী করবে চীন?
লাই যতই সতর্কতার সাথেই খেলুন না কেন বেইজিং তার জয়ের মধ্যে যে বার্তা পেয়েছে তাকে উপেক্ষা করতে পারে না। নির্বাচনটি বলছে প্রতিযোগিতাটি ছিলো খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কিন্তু ডিপিপি জিতেছে বড় ব্যবধানে।
“তারা চীনকে বলেছে যে আমরা আর তোমার কথা শুনবো না। আমাদের ভবিষ্যৎ আমরাই ঠিক করবো। সুতরাং আমাদের নির্বাচনের সময় শি জিনপিংকে চুপ থাকা শেখা প্রয়োজন।,” নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ডিপিপির একজন সমর্থক বলছিলেন।
হউ ইউ-ই এবং প্রধান বিরোধী দল কেএমটি তাদের প্রচারে যে ভয়টি তুলে ধরেছে তাহলো চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করতে পারে। কেএমটির জয় হলে সেটি সম্ভবত তাইওয়ানে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে সরিয়ে দিতো বরং বেইজিং তখন হউ এর সাথে সংলাপ হতো।
শি তাইওয়ানে কেএমটির সবশেষ প্রেসিডেন্ট মা ইং জেও এর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন ২০১৫ সালে। ১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের পর এটাই ছিলো চীন ও তাইওয়ানের নেতাদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাত।
যারা কেএমটির বিরোধিতা করে তাদের অভিযোগ হলো দলটি চীনের কাছে আত্মসমর্পণকারীর মতো আচরণ করে এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় আটকে দেয়া ও সামরিক সেবা কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষাকে গুরুত্ব দেয় না।
এই ভয়ও আছে কেএমটি সরকার তাইওয়ানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সহযোগী দেশগুলো প্রশ্ন তুলতে পারে যে তাইওয়ান যেখানে নিজেই তার প্রতিরক্ষাকে গুরুত্ব দেয় না সেখানে তারা কেন এগিয়ে আসবে। তাইওয়ান এখন জিডিপির আড়াই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। যা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ওই অঞ্চলের অন্য দেশগুলো বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম।
এসব কারণে ভোটারদের পছন্দ করার সুযোগ ছিলো অনেকটাই পরিষ্কার। তার বেইজিংয়ের দিক থেকে আসা সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সচেতন এবং তারা চায় সংলাপ। কেএমটি অবশ্য তাইওয়ানের তরুণ ভোটারদের কাছে কোন আবেদন নিবেদনই করেনি, যারা নিজেদের চীনা না ভেবে তাইওয়ানিজ ভাবতে পছন্দ করে।
গত কয়েক মাসে তাইওয়ানের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। এর নির্বাচনটি ছিলো ব্যাপক আলোচনার বিষয় এবং এর গণতন্ত্র অল্প দিনের। তবে ভোটারদের উৎসাহ ছিলো স্পষ্ট। যদিও একই সময়ে বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়া, বেতন না বাড়ানো ও চাকুরী সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে ডিপিপির ওপর থেকেও দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিলো অনেক ভোটার।
এসব কারণে ডিপিপি জিতলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। কেএমটিকে সাথে নিয়ে তাইওয়ান পিপলস পার্টির অবস্থান শক্ত হয়েছে আইনসভায় যা লাইয়ের এজেন্ডাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
প্রেসিডেন্ট লাইয়ের পথ খুব একটা সহজ ছিলো না। এখনো তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে হোয়াইট হাউজে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে আসে, সেজন্যও।

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: