সোমবার, ২রা জুন ২০২৫, ১৯শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


নির্বাচনি রোডম্যাপ কবে, কতটা প্রস্তুত ইসি


প্রকাশিত:
১ জুন ২০২৫ ১০:৩২

আপডেট:
২ জুন ২০২৫ ২৩:৫৪

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বললেও, নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখনও এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা পায়নি। তবে, সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে।

জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর পুরো আয়োজন ও পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এ জন্য ইসিকে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আইন-বিধি-নীতিমালা সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল ও পর্যবেক্ষক নিবন্ধনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য সাধারণত প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইসি একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা বা ‘রোডম্যাপ’ প্রকাশ করে থাকে।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের অন্তত দেড় বছর আগে এই রোডম্যাপ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন প্রশ্নে অনেক ‘যদি-কিন্তু’ দেখা দিয়েছে। সাংবিধানিক বা আইনি প্রশ্নগুলোর চেয়েও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয়টি এখন সামনে চলে এসেছে। এই অনিশ্চয়তার কারণে এবার নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনের মধ্যেই এক ধরনের দোটানা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, এখন রোডম্যাপ প্রকাশের মতো সময় এসেছে কি-না আমরা জানি না। তবে, প্রাথমিকভাবে যে সব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার সেটি আমরা নিচ্ছি।

ইসি কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন যে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এরই মধ্যে বেশ কিছু কাজের তালিকা প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন তাদের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এবার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা চূড়ান্ত না হওয়ায় নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপ ঘোষণার দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত করতে পারছে না।

গত মাসে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানিয়েছিলেন, তারা প্রাথমিক কাজ শেষ করে জুন-জুলাই মাসের মধ্যেই রোডম্যাপ ঘোষণা করার কথা ভাবছেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত।

সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকে নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মাস খানেকের মাথায় পদত্যাগ করেন হাবিবুল আউয়ালসহ তার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সব সদস্য। নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তাদের অনেকে বলছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন দল নিবন্ধন, সীমানা নির্ধারণ, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচনি আচরণ বিধিমালা, দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নীতিমালা, ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটাসহ সংশ্লিষ্ট আইন-বিধি সংস্কারসহ বেশ কিছু ধাপ থাকে নির্বাচনি রোডম্যাপে।

ইসির সাবেক কর্মকর্তা ও নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন কাজ কবে, কখন কিংবা কীভাবে সম্পন্ন করা হবে, সেটির একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকে নির্বাচনি রোডম্যাপে।

তিনি বলছেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ইসির জন্যও যেমন জরুরি, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও জরুরি।

জেসমিন টুলীর মতে, যদি এই রোডম্যাপ আগে থেকেই না করা হয় তাহলে কোন কাজটি কত দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, সেটি নিয়ে একটি সংকট তৈরি হতে পারে ইসির জন্য।

তিনি বলেন, সঠিক তারিখ না থাকলেও একটা কাছাকাছি ধারণা থাকতে হবে। কাজ করতে করতে একটা পর্যায়ে তারা একটা চিত্র উপস্থাপন করবে। এটাতে হেরফের হতেই পারে, তবে একটা নির্দিষ্ট টার্গেট থাকতেই হবে।

অন্যদিকে, নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য রাজনৈতিক দলের জন্যও এই রোডম্যাপ জরুরি বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

কী কী থাকে নির্বাচনি রোডম্যাপে?

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১২টি পরিকল্পনা নিয়ে নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রোডম্যাপ প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রাক নির্বাচন, তফসিল পূর্ববর্তী এবং তফসিল ঘোষণার পর কী কী কর্মযজ্ঞ করবে, সেই বিষয়গুলো যুক্ত থাকে রোডম্যাপে।

এক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার আগে ভোটার তালিকা আইন-বিধি-নীতিমালা সংস্কার, সংলাপ, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল নিবন্ধন, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, ভোটার তালিকার সিডি প্রকাশ, ব্যালট পেপার প্রস্তুত, নির্বাচনি কর্মকর্তা নিয়োগসহ বেশ কিছু বিষয় যুক্ত থাকে রোডম্যাপে।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, চলমান পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় অনেক সরঞ্জাম দরকার ছিল সেটা আমরা সংগ্রহ করেছি। আমরা ব্যালট বাক্স, কালি, স্টাম্প প্যাড, এই জিনিসগুলোর জন্য টেন্ডারিং প্রসেসে গিয়েছি। এটার জন্য টাকা লাগবে, সেই বাজেট বরাদ্দ আমরা চেয়েছি।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বড় ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করতে হয় নির্বাচন কমিশনকে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বলেন, যদি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হয় তাহলে এ বছরের জানুয়ারিতে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তাদেরকে যুক্ত করা হবে ভোটার তালিকায়। আর পরের বছর জুনে ভোট হলে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তারা যুক্ত হবেন তালিকায়।

এই বিশ্লেষক বলছেন, ভোটার তালিকার ওপর নির্বাচনের বড় একটি প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। কেননা ভোটার তালিকার ওপর নির্ভর করেই ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতি, সীমানা চূড়ান্তসহ নির্বাচন কেন্দ্রিক বড় প্রস্তুতি নিতে হয়।

তবে, এবার রোডম্যাপ ঘোষণা না হলেও এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা নির্ধারণসহ প্রাথমিক ধাপের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছে ইসি।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে নিবন্ধনের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কমিশন।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনি কর্মপরিকল্পনা রোডম্যাপ প্রস্তুত করার সময় রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মত বিনিময় সভা, ভোটের বাজেট চূড়ান্ত, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক, রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের ব্রিফিং, নির্বাহী-বিচারিক হাকিম নিয়োগ নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুতের মতো বিষয়গুলোও যুক্ত করা হবে।

ঐকমত্যের অপেক্ষায় ইসি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক আলোচনা চলছে ঐকমত্য কমিশনের। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ৯টি প্রস্তাবের বেশ কিছু সুপারিশ আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে গত ১৯শে মার্চ ইসিকে পাঠিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এগুলো বাস্তবায়নে কত সময় প্রয়োজন এবং এতে আর্থিক সংশ্লেষ আছে কি না, তা ইসিকে জানাতে বলা হয়েছিল।

গত ৩০ এপ্রিল সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে মতামত পাঠিয়েছে ইসি।

নির্বাচনি ব্যবস্থা, সংবিধানসহ রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকারের ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক চললেও এখনো চূড়ান্ত ঐকমত্য তৈরি হয়নি। যে কারণে কিছু কিছু বিষয়ে নির্বাচন কমিশন আগাম প্রস্তুতি নিলেও সেগুলো একেবারে চূড়ান্তও করা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বলেন, ধরেন ঐকমত্যের ভিত্তিতে এখন যদি সংসদীয় আসনের সীমানায় বড় কোনো পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে সীমানা নির্ধারণের কাজ এগিয়ে রাখলেও তো সেটি আর কাজে লাগবে না। আবার যদি ‘না ভোট’ চালু হয় কিংবা ভোটারের বয়স পরিবর্তন করে নতুন আইন হয় তাহলেও নতুন করে আবার অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে ।

এসব কারণে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অপেক্ষা আরও বাড়বে।

জেসমিন টুলী বলেন, নির্বাচনি কর্মপরিকল্পনা তৈরির জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য। সব দল মিলে যে সনদ করতে চায়, সেটি যত দ্রুত হবে, তত দ্রুত রোডম্যাপ ও নির্বাচন প্রস্তুতি শুরু করতে পারবে ইসি।

গত এপ্রিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারের দিকে তাকিয়ে থাকবে না নির্বাচন কমিশন। সেজন্য তারা প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছেন।

ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনেরও যেমন কাজ চলছে, আমরা আমাদের প্রস্তুতি রাখবো। আমাদের একটা লক্ষ্য আছে সেটি হলো ভোট হবে। আগাম প্রস্তুতি নিতেই হবে আমাদের।

তবে নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, যদি বড় কোনো পরিবর্তন না হয় ইসি যে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছে, সেই প্রস্তুতি দিয়েই সংস্কারের পর নির্বাচন আয়োজনে খুব বেশি বেগ পোহাতে হবে না। সূত্র: বিবিসি বাংলা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top