অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন পরবর্তী সহিংসতা ও কার্যকারণ অনুসন্ধান
প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৫২
আপডেট:
৬ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:৫০
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ঘটনার পরে ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশকিছু সহিংসতা এবং অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। যেমন কোনো নিৰ্দিষ্ট দলের অনুসারীদের ওপর আক্রমণ, স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্রমাগত লাঞ্ছনা এবং কিছু ক্ষেত্র বিশেষে হত্যা ও গুমের ঘটনাও মিডিয়ায় এসেছে।
সমাজের এই ট্রানজিশন সময়ে শুধুমাত্র যে সামাজিক কারণেই অপরাধ ঘটছে তা নয় বরং আমি মনে করি, বাংলাদেশে রাজনৈতিক এই পট পরিবর্তনের সাথে সাথে বেশকিছু সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন হওয়া শুরু করেছে এবং হচ্ছে, যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
অর্থাৎ এই ঘটনাগুলো সামাজিক-রাজনৈতিক কারণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিক্রিয়া এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলোর জটিল পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিফলিত করে যা অপরাধমূলক আচরণ এবং সমষ্টিগত ভিন্নমত বোঝার কেন্দ্রবিন্দু। কয়েকটি মূল অপরাধমূলক তত্ত্ব ব্যবহার করে এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
২০২৪ বিক্ষোভের পটভূমি
২০২৪ সালে বাংলাদেশ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখেছিল, যা পরবর্তীতে সরকার পতন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। এই বিক্ষোভগুলো প্রাথমিকভাবে সরকারের চাকরির কোটা পদ্ধতি সম্পর্কিত অভিযোগের জন্য শুরু হয়েছিল, যা শিক্ষার্থীরা অন্যায্য এবং স্বজনপ্রীতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
যাই হোক, আন্দোলনটি দ্রুত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের অসন্তোষের বিস্তৃত অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়, বিশেষ করে দুর্নীতি, গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এবং আন্দোলনের সময় নির্বিচারে সাধারণ মানুষ মেরে ফেলার কারণে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে সংস্কারের সূচনার মধ্যে বিক্ষোভের সমাপ্তি ঘটে।
স্ট্রেন থিওরি এবং সামাজিক আন্দোলনে যুবকের ভূমিকা
২০২৪ সালের শিক্ষার্থী বিক্ষোভের জন্য সবচেয়ে প্রযোজ্য অপরাধমূলক তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো রবার্ট মার্টনের স্ট্রেন তত্ত্ব। এই তত্ত্বটি যুক্তি দেয় যে অপরাধ এবং বিচ্যুতির ফলাফল যখন ব্যক্তিরা বৈধ উপায়ে সামাজিকভাবে অনুমোদিত লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে অক্ষম হয়, তখন অনেক সময়, সমাজ নির্ধারিত পন্থার বাইরে গিয়ে সামাজিক লক্ষ্যগুলো অর্জন করার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশা, যাদের মধ্যে অনেকেই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগের সম্মুখীন হয়েছে, অস্থিরতার জন্য একটি উর্বর ভূমি তৈরি করেছে। সরকারের কোটা ব্যবস্থা, যা পারিবারিক পটভূমি এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার মতো কারণের ভিত্তিতে চাকরির শতাংশ বরাদ্দ করে, ভোটাধিকার বঞ্চিত হওয়ার অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষার্থীরা এটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক বাধা হিসেবে দেখেছে যা তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সাফল্য অর্জনে বাধা দেয়।
অপরদিকে পরবর্তীতে এটিও দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠী যাদের এতদিন দমিয়ে (socially strained) রাখা হয়েছিল তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন সময় আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে আইনের শাসন ব্যাহত করেছে।
লেবেলিং তত্ত্ব এবং রাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া
আরেকটি অপরাধমূলক দৃষ্টিভঙ্গি যা সরকার গঠনের পরবর্তী সময়ের সহিংসতা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ যেতে পারে তা হলো লেবেলিং তত্ত্ব। এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, লেবেলযুক্ত ব্যক্তিদের অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যের সাথে—সমাজে নেতিবাচক স্টেরিওটাইপের সাথে যুক্ত করে। বিক্ষোভ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী দলের বিভিন্ন দুর্নীতির প্রমাণ সামনে আসতে শুরু হয়, এছাড়া বিক্ষোভের সময়ে নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করার বিভিন্ন ভিডিও সামনে আসতে শুরু করে প্রাক্তন সরকার প্রধান থেকে শুরু করে এই দলের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়াও এই দলের ধারক ও বাহককে একভাবে বয়কট থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ আক্রমণ করা শুরু করে।
আদালত প্রাঙ্গণকে বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ অভিযুক্তকে আক্রমণ করা এক ধরনের সহিংসতা, যা মানুষের অনেকদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাই বলে এই ধরনের মব ভায়োলেন্স ও কোনোভাবে কাম্য নয়; কোনো দল, ব্যক্তি যদি দেশের আইনে অপরাধ করে থাকে ও রাষ্ট্র সেই আইনেই যদি বিচার না করে, সাধারণ মানুষ নিজ হাতে আইন তুলে নেয় সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের প্রতি অনাস্থা প্রকাশিত হয় এবং যার জন্য সাধারণ মানুষের আইন হাতে তুলে নেওয়াকে সরকারের কঠোরভাবে অনুৎসাহিত করতে হবে।
ক্রিটিক্যাল ক্রিমিনোলজি এবং পাওয়ার
বাংলাদেশে বর্তমানে একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষক শিক্ষর্থীদের সম্পর্কের জীর্ণতা। শিক্ষার্থী-শিক্ষকের বিশ্বাসমূলক আদর্শকে কলঙ্কিত করে বিভিন্ন সময় শিক্ষকরা ব্যাক্তি স্বার্থে এবং রাজনৈতিক কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে এমনকি আন্দোলনের সময় নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে অনেক শিক্ষক কার্পণ্য করেছেন।
ক্রিটিক্যাল ক্রিমিনোলজি আরেকটি লেন্স প্রদান করে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করা যায়। এই দৃষ্টিকোণটি কীভাবে ক্ষমতা, অসমতা, পুঁজিবাদ অপরাধ এবং বিচ্যুতিকে আকার দেয় তার ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে, প্রায়শই সামাজিক অবিচারকে স্থায়ী করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর জোর দেয়।
শিক্ষকরা যদিও অরাজনৈতিকভাবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণ করবেন এবং তাদের জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন, অনেক সময়ই শিক্ষকরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনৈতিকভাবে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেছেন, স্টেট ভায়োলেন্সকে সমর্থন করেছেন বা যা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে অন্যায় বা বৈষম্য করেছেন। তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগে জোর করানো এবং শারীরিক লাঞ্ছনা কখনোই কাম্য না বরং এই সম্পর্ক পুনর্স্থাপনে রাষ্ট্র এবং শিক্ষকদেরই গুরুতর দায়িত্ব পালন করতে হবে।
ব্রোকেন উইন্ডো তত্ত্ব এবং সহিংসতা বৃদ্ধি
জেমস কিউ উইলসন এবং জর্জ কেলিং দ্বারা বিকশিত ব্রোকেন উইন্ডোজ থিওরি যুক্তি দেয় যে বিশৃঙ্খলা (disorder) এবং ছোটখাটো অপরাধের দৃশ্যমান লক্ষণগুলো অপরাধের বৃদ্ধি এবং বিচ্যুতির আরও গুরুতর রূপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ২০২৪-এর বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে, যেই অপরাধগুলো হয়েছে সেগুলোর বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
বিচারব্যবস্থা যথাযথ প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য সুরক্ষা ব্যবস্থা অনুসারে পরিচালিত হয়, যাতে জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে তাদের যুক্তিসঙ্গতভাবে শো ট্রায়াল হিসেবে চিত্রিত করা না যায়।
যেহেতু বাংলাদেশের সমাজে এক ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ট্রান্সিশন চলছে, তাই ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধ আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন মনে হলেও যেমন অবৈধভাবে জমি দখল কিংবা অন্য দলের অনুসারী অবৈধভাবে আক্রমণ কিংবা কোনো ধর্ম বা দলের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দমন করা না হয় এর থেকে বড় অপরাধও ভবিষ্যতে জন্ম নিতে পারে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের বিক্ষোভ বিশেষ করে সরকার গঠনের পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতা এবং অপরাধমূলক তত্ত্বের প্রয়োগের জন্য একটি শক্তিশালী কেস স্টাডি হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে অবরুদ্ধ সুযোগের ওপর স্ট্রেন থিওরির ফোকাস থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াগুলোয় তত্ত্বের অন্তর্দৃষ্টি লেবেল প্রক্রিয়া পর্যন্ত।
বাংলাদেশ যখন নতুন নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই নতুন করে রূপ নেওয়া অস্থিরতার মূল কারণগুলো মোকাবিলা এবং আরও ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ নীতিগুলো গঠনে সবচেয়ে আগে রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, ক্রিমিনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: