রাজশাহীতে ১০ মাসে ২৮ জন এইচআইভি পজিটিভ, বাড়ছে উদ্বেগ
প্রকাশিত:
৫ নভেম্বর ২০২৫ ১০:১৩
আপডেট:
৫ নভেম্বর ২০২৫ ১২:৫০
রাজশাহীতে ১০ মাসে ২৮ জন নারী-পুরুষসহ একজন হিজড়া এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে এইডসে মারা গেছেন একজন। আক্রান্তের বেশির ভাগ ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের এই আধিক্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিগত পাঁচ বছরের হিসাব বলছে, ক্রমগতিতে বেড়েছে এইচঅঅইভি আক্রান্তের সংখ্যা। চলতি বছর সেটা মারাত্মক গতি পেয়েছে।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহীতে যৌনকর্মীর চেয়ে সমকামিতায় বেশি ছড়িয়েছে এইচআইভি। গেল ছয় বছরে এইচআইভিতে আক্রান্তের সংখ্যা দঁড়িয়েছে ৯৩ জনে। এ সময়ে এইডসে মারা গেছেন আটজন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারে (টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং সেন্টার) প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন এইচআইভি নমুনা পরীক্ষার জন্য আসেন। যারা পজেটিভ হন তাদের বিভিন্ন কাউন্সিলিং করা হয়। তাদের বোঝানো হয় যে, এই রোগ পুরোপুরি ভালো না হলেও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিয়মিত চিকিৎসা নিলে ভালো থাকা যায়।
রামেক হাসপাতালের আইটডোরে এইচটিসি সেন্টার চালু রয়েছে। সেখানে এইচআইভির জীবাণু পরীক্ষা করা হয়। খুব অল্প সময়ে দেওয়া হয় রেজাল্ট। এখানে এইচআইভি পজেটিভ হলে রোগীদের বিভিন্ন বিষয়ে কাউন্সেলিং করা হয়। তবে ওষুধের ব্যবস্থা নেই। রাজশাহী বিভাগে অন্য সব জেলায় পজেটিভ হওয়া রোগীদের চিকিৎসা নিতে হয় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) থেকে। সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সের চারজন এসেছেন এইচআইভি পরীক্ষার জন্য। তাদের মধ্যে একজন ১৫ বছরের ছেলে। সঙ্গে তার পুরুষ সঙ্গীকেও নিয়ে এসেছেন। যদিও দুজনের এইচআইভি পরীক্ষায় নেগেটিভ রেজাল্ট এসেছে। তাদের মধ্যে একজন হিজড়া জনগোষ্ঠীর ছিলেন। তারও নেগেটিভ এসেছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তেও তারা কথা বলতে রাজি হননি।
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ৭৭ জন মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। বছরটিতে একজনও পজেটিভ ছিল না। তবে পরের বছর ২০২০ সালে এসে দুইজনের শরীরে এইচআইভি জীবাণু পাওয়া যায়। এই বছর ৩২১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছি। ২০২১ সালে ১ হাজার ৫২৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় আটজন এইচআইভি পজেটিভ হন। সে বছরে একজনের মৃত্যু হয়। তবে তিনি এইচআইভি পজেটিভ হওয়ার পরে চিকিৎসার জন্য সময় পাননি। চিকিৎসা শুরুর কিছুদিন পর তিনি মারা যান।
২০২২ সালে ২ হাজার ৩১ জনের মধ্যে আটজন এইচআইভি পজিটিভ হন। এই বছরে একজনের মৃত্যু হয়। মৃত রোগী একই বছরে এইচআইভি পজেটিভ হয়েছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। ২০২৩ সালে ২ হাজার ৩৬০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৪ জন হন পজেটিভ। ওই বছর এইডসে সর্বোচ্চ ৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৫৩২ জনের মধ্যে ২৭ জন এইচআইভি পজেটিভ পাওয়া যায়। এই বছরেও তিনজনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ ২০২৫ সালে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২ হাজার ৩৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এই বছরের সর্বোচ্চ ২৮ জন এইচআইভি পজেটিভ হয়েছেন। মার্চ মাসে একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ দুই বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সমকামিতার মাধ্যমে এইচঅঅইভি আক্রান্তের হার বেশি। তারপরে রয়েছে সেক্স ওয়ার্কার (যৌনকর্মী)। ২০২৪ সালে ২৭ জন এইচআইভি পজেটিভের মধ্যে সমকামিতার মাধ্যমে এইচআইভি ছড়িয়েছে ১৬ জনের শরীরে। আর সেক্স ওয়ার্কার ১০ জন পজেটিভ। এ ছাড়া, ব্লাড থেকে সংক্রমিত হয়েছেন একজন। এই বছর ২৩ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী এইচআইভি পজেটিভ হন। একই বছরের ৩ হাজার ৫৩২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে ১ হাজার ২৩১ জন পুরুষ, ২ হাজার ১৫০ জন নারী ও ১৫১ জন হিজড়া।
২০২৫ সালে ২৮ জন এইচআইভি পজেটিভের মধ্যে সমকামিতার মাধ্যমে এইচআইভি ছড়িয়েছে ১৭ জনের শরীরে। আর সেক্স ওয়ার্কার ১০ জন পজেটিভ। এ ছাড়া, ব্লাড থেকে একজন সংক্রমিত হয়েছেন। এই বছর ২৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী ও ১ জন হিজড়া এইচআইভি পজেটিভ হন। একই বছরের ২ হাজার ৩৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে ১ হাজার ২৬০ জন পুরুষ, ৯১৭ জন নারী ও ১৬৯ জন হিজড়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এইচআইভি পজেটিভ একজন জানান, পজিটিভ হয়েছে অনেকদিন হলো। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। তবে রাজশাহী হাসপাতালে এইচআইভির ওষুধ পাওয়া যায় না। এখানে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। পজিটিভ হলে যেতে হয় বগুড়ায়। সেখানে বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যায়। তবে সেখানে যাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। রাজশাহী হাসপাতালে এই ওষুধ পাওয়া গেলে এই রোগীদের জন্য উপকার হবে।
তিনি বলেন, এইচআইভি কয়েকভাবে ছড়ায়। আমারও কোনো না কোনোভাবে ছড়িয়েছে। তবে এইচআইভি পজেটিভ জানার পরে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি। আবার মনে হচ্ছিল অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দিই। বিভিন্ন খারাপ চিন্তা মাথায় আসছিল। পরে শুনতে পেলাম, রামেক এইচটিসি সেন্টারে কাউন্সিলিং করা হয়। এই সমস্ত রোগীদের ভালো থাকার বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপর এইচটিসি সেন্টারের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে ভালো আছি।
রামেক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসারা বলছেন, এখানে এইচটিসি সেন্টার চালু রয়েছে। এখানে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ওষুধ পাওয়া যায় না। এইচআইভির ওষুধ বগুড়ার শজিমেক থেকে নিতে হয়। রামেক হাসপাতালেও এআরটি সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু হবে এআরটি সেন্টার। এটি চালু হলে রোগীদের আর বগুড়ায় গিয়ে ওষুধ নিতে হবে না। রাজশাহী ও এর আশপাশের জেলার রোগীরা রামেক হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিতে পারবেন।
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের কাউন্সিলর রেজাউল করিম বলেন, রামেক হাসপাতালে এইচআইভি টেস্ট শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তবে কার্যক্রম শুরু হয় একই বছরের আগস্টে। ছয় বছরে হাসপাতালে ১২ হাজার ৪৬৪টি মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে পজিটিভ হয়েছেন ৯৩ জন। আর মারা গেছেন আটজন এইচআইভি পজেটিভ রোগী। আর হাসপাতালের বাইরে আরও ৩০ জন এইচআইভি পজেটিভ রয়েছেন (এনজিও ও বেসরকারি সংস্থার তথ্য)। যারা রাজশাহী জেলার। তবে তারা হাসপাতালে না এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আক্রান্তরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তারা কখনও কখনও আত্মহত্যার কথাও ভাবেন। আবার ভাবেন এই রোগের জীবাণু অন্যকেও ছড়িয়ে দিতে। এই প্রবণতাটা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তাদের নিয়মিত এইচটিসি সেন্টারে আসতে বলা হয়। আমরা তাদের সুস্থ থাকার লক্ষ্যে কাউন্সিলিঙের মাধ্যমে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি। ওষুধ প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন, এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও ওষুধ দেওয়া হয় বগুড়ায়। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরাও চাচ্ছেন এখান থেকে ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হোক। এ লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের ফোকাল পার্সন ডা. ইবরাহীম মো. শরফ বলেন, এইচআইভি সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে নারী ও পুরুষদের মধ্যে অরক্ষিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ যৌনমিলন, যেমন, নারী-পুরুষে (inter-sexual) অথবা পুরুষে-পুরুষে (homo-sexual) উভয় ধরনের যৌনমিলনের মাধ্যমেই এইচআইভি ছড়ায়। এ ছাড়া, মা থেকে শিশুর এইচআইভি সংক্রমণ হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায়, জন্মগ্রহণের সময় এবং জন্মের পরে মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে।
এইচআইভি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, প্রতিবার যৌনমিলনের সময় সঠিক নিয়মে কনডম ব্যবহার করা। একজন যৌনসঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক সীমাবদ্ধ রাখা। এইচআইভি পরীক্ষা ছাড়া রক্ত সঞ্চালন, ব্যক্তির অঙ্গ অথবা টিস্যু অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন না করা। একই ইনজেকশন সুঁই-সিরিঞ্জ অনেকে মিলে ব্যবহার করে নেশা গ্রহণ না করা। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক নিয়মিত স্বাস্থ্য চেকআপ এবং সঠিক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এইচআইভি সংক্রমিত মা সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সন্তানের বুকের দুধ খাওয়ানো।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: