সোমবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩২


অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করতে হবে


প্রকাশিত:
৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৩৪

আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:৫৯

ছবি : সংগৃহীত

দেশের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় এ মুহূর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। পাশাপাশি জলবায়ু সংকট ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় অবিলম্বে একটি বাস্তবভিত্তিক জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সামরিক জাদুঘরে আয়োজিত বাংলাদেশ জ্বালানি সম্মেলনের সমাপনী দিনে বক্তারা এসব কথা বলেন। সম্মেলনে ১৩ দফা দাবি সম্বলিত নাগরিক ইশতেহার উপস্থাপন করা হয়।

সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কায়ুম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক নজরুল হক প্রধান, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক (ঢাকা দক্ষিণ) মঞ্জুর মঈন প্রমুখ।

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রকৃতির ওপর যত বেশি অত্যাচার করছি, ন্যায্য রূপান্তর থেকে আমরা ততটাই দূরে সরে যাচ্ছি। এই ভয়ংকর বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও জনগণকে একসাথে দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা ন্যায়সংগত রূপান্তরের পক্ষে রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে ঘোষিত ৩১ দফার মধ্যে ১৮, ২৯ ও ৩১ নম্বর দফায় জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়ণা। এই তিনটি বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান জাতির সামনে তুলে ধরছি।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ুম বলেন, আমরা ভালো কিছুর আশা করি, কিন্তু বাস্তবে এগিয়ে চলে সবচেয়ে ভয়াবহ অনিয়মের রাজনীতি। তাই রাজনৈতিক ইশতেহারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লুটপাট বন্ধের স্পষ্ট দাবি যথাযথ বলে মনে করছি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে স্বীকৃত লুণ্ঠন চলছে, তার হোতাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে শক্ত সংস্কার ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এখন সময়ের দাবি।

সিপিবির মঞ্জুর মঈন বলেন, জ্বালানিখাতে আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো দেশের জ্বালানির শক্তি নিরাপত্তার পথে উত্তরণ নিশ্চিত করা। আমরা বহুমুখী ও সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান চাই। তবে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ছাড়া এসব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

ইশতেহারের দাবি ও সুপারিশগুলো হলো

১. নতুন জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক অভিঘাত মোকাবিলা, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অবিলম্বে একটি নতুন জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এই নীতির আলোকে পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সব খাতভিত্তিক নীতি ও মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা ও প্রণয়ন করতে হবে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও জলবায়ু-সংক্রান্ত সব নীতি, পরিকল্পনা, আইন ও বিধিমালা প্রণয়নের আগে নাগরিক সমাজ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বাধ্যতামূলক পরামর্শ নিতে হবে

২. জ্বালানি খাতে দুর্নীতি দমনচুক্তির স্বচ্ছতা

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনবিধিমালা সংশোধন করে সব চুক্তি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় প্রকাশযোগ্য করতে হবে। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নাগরিক পর্যবেক্ষণের আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সকল ব্যক্তির বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং বিদ্যুৎ খাত থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৩. জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি বাধ্যতামূলক

কয়লা, গ্যাস ও তেলের ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমিয়ে শিল্প, বাণিজ্য ও আবাসিক খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সব শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ২০৩০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৩০% এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবেনবায়নযোগ্য খাতে রূপান্তরে সহজ শর্তে ঋণকর ছাড় দিতে হবে

৪. নতুন জীবাশ্ম বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়

কয়লা, গ্যাস ও তেলভিত্তিক কোনো নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না। পুরোনো ও অকার্যকর বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে সেখানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এসব কেন্দ্রে কর্মরত শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অদক্ষ কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বাতিল করতে হবে।

৫. নতুন এলএনজি টার্মিনাল নয় ও গ্যাস অপচয় রোধ

নতুন কোনো এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না। পুরোনো ও অকার্যকর গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে সার উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। শিল্পে গ্যাসের পরিবর্তে বিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। গ্যাস লিকেজ ও অবৈধ সংযোগ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং অপচয় রোধে সব খাতে গ্যাস মিটার স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৬. নবায়নযোগ্য শক্তির জাতীয় লক্ষ্য ও বাজেট

২০৩০ সালের মধ্যে ৩০%, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০% এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করার লক্ষ্য সব নীতি, পরিকল্পনা ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের কমপক্ষে ৪০% নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য বরাদ্দ করতে হবে। সৌর প্যানেল, ইনভার্টারসহ সব যন্ত্রাংশের ওপর ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক প্রায় শূন্যে নামাতে হবে।

৭. পরিবহন খাতে ইভি বিপ্লব

পরিবহন খাত দেশের দূষণের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। দ্রুত সবুজায়নের লক্ষ্যে বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর আমদানি শুল্ক ও কর অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের তুলনায় অন্তত ৭৫% কমাতে হবে। উন্নত ব্যাটারির (লিথিয়াম-আয়ন, সোডিয়াম-আয়ন, সলিড স্টেট) ওপর আমদানি কর শূন্যে নামাতে হবে।

৮. স্মার্ট গ্রিড ও ‘সূর্যবাড়ি’ কর্মসূচি

জাতীয় গ্রিড আধুনিকায়ন করে স্মার্ট গ্রিডে রূপান্তরের জন্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিতে হবে। ‘সূর্যবাড়ি’ কর্মসূচির আওতায় পারিবারিক ও কৃষিভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে (৩ কিলোওয়াট পর্যন্ত) ২৫% ভর্তুকি ও ৭০% স্বল্পসুদে ঋণ দিতে হবে। নারী, আদিবাসী, কৃষক, জেলে ও দরিদ্রদের জন্য অতিরিক্ত ১০% ভর্তুকি দিতে হবে।

৯. ২০ লাখ নতুন সবুজ কর্মসংস্থান স্রেডা, বিএমইটি,যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণের মাধ্যমে ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এতে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

১০. ‘ভুল সমাধান’ নয়, সার্কুলার গ্রিন ইকোনমি

অ্যামোনিয়া কো-ফায়ারিং, কার্বন ক্যাপচার ও স্টোরেজ, তরল হাইড্রোজেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও ওয়েস্ট-টু-এনার্জির মতো ব্যয়বহুল ও অনিশ্চিত প্রযুক্তি পরিহার করতে হবে। বর্জ্য কমানো, পৃথকীকরণ, পুনর্ব্যবহার ও জৈবসার উৎপাদনের মাধ্যমে সার্কুলার গ্রিন ইকোনমি বাস্তবায়ন করতে হবে।

১১. নবায়নযোগ্য জ্বালানির ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং শিল্প

মেয়াদোত্তীর্ণ সৌর প্যানেল, ব্যাটারি ও ইনভার্টার সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পুনর্ব্যবহারের জন্য দেশীয় রিসাইক্লিং শিল্প গড়ে তুলতে হবে, যাতে আমদানি নির্ভরতা কমে এবং সবুজ অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।

১২. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও ন্যায্য হিস্যা

জ্বালানি নীতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনাসহ সব নীতিতে নারী, আদিবাসী, শ্রমজীবী, জেলে ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জ্বালানি অবকাঠামোর মুনাফা থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে এবং ব্যবস্থাপনাতেও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

১৩. কৃষিজমি সুরক্ষা ও বহুমুখী ব্যবহার

কৃষিজমি রক্ষার লক্ষ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে জমির মালিকরা প্রতিবছর বাড়তি হারে ভাড়া পান। একই জমির বহুমুখী ব্যবহারের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top