বুধবার, ২৬শে জুন ২০২৪, ১১ই আষাঢ় ১৪৩১


মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার : সুষ্ঠু অভিবাসন আর কত দূর?


প্রকাশিত:
২ জুন ২০২৪ ১০:৪৩

আপডেট:
২৬ জুন ২০২৪ ০৪:৪৯

ছবি সংগৃহিত

মালয়েশিয়ায় অভিবাসী প্রত্যাশীদের দুর্ভোগ কয়েকদিনে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই জীবিকার তাগিদে, উন্নত জীবনের আশায়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, প্রবাসে সাময়িকভাবে কর্মসংস্থানের চল শুরু হয়েছে।

আর একই উদ্দেশ্যে স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলা প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার শুরু পঞ্চাশের দশক থেকেই। জানা যায়, মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় ৮-১০ লাখ (সঠিক পরিসংখ্যান নেই) এবং তাদের অনেকেই নানা কারণে ভালো নেই। কারণ মালেয়েশিয়ায় ৯৬ শতাংশ বাংলাদেশি শ্রমিক ঋণগ্রস্ত (কালের কণ্ঠ, ১৮ মে ২০২৪)।

পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতায় অভিবাসন খাতে আইন-নীতিমালা যেমন হয়েছে, অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো এসবের সুষ্ঠু প্রয়োগ হয়নি। এর কয়েকটি মূল কারণ এখানে উল্লেখ করতে পারি।

অভিবাসন খাত একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ, যা বেসরকারি। আর এই উদ্যোগ নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর। সমন্বয় ও জবাবদিহিতার ঘাটতি এড়াতে চলে ব্লেম গেম আর ভুক্তভোগী হন অভিবাসী প্রত্যাশী সাধারণ মানুষ।

আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, অভিবাসন প্রক্রিয়াটি এখনো অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে হয়ে থাকে, যা অনেক অংশে অনানুষ্ঠানিক এবং দলিলপত্র বা প্রমাণবিহীন। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার অভিবাসনের ক্ষেত্রে একটি দুষ্ট চক্র সক্রিয়, যারা সমাজে ও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাবশালী এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার অচিরেই মালয়েশিয়া সফর করবেন ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে মালয়েশিয়ায় শ্রম অভিবাসনের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়ে আলাপ করবেন।

২৬ মে ২০২৪ হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে তাদের একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারকে একটি চিঠি প্রেরণ করেছে। সেইখানে অভিবাসন খাতের বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরে তারা সেগুলো নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক কালে একটি নির্দিষ্ট দেশের অভিবাসীদের অধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের উদ্বেগ প্রকাশ নজিরবিহীন। তবে জাতিসংঘের অভিবাসন সংক্রান্ত দপ্তরের নিয়মিত পর্যালোচনায় বিভিন্ন দেশের অভিবাসী অধিকারের বিশ্লেষণে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বা কর্মপ্রত্যাশী বাংলাদেশি অভিবাসীদের দুর্ভোগ কমানোর প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা নতুন নয়।

প্রয়োজনের চেয়ে চড়া মূল্যে অভিবাসন, প্রতিশ্রুত কর্মসংস্থান না হওয়া, ঠিকমত বেতন না পাওয়া, বিদেশে অবস্থানের বৈধতা হারানো এসব অভিযোগের আন্তর্জাতিক সমালোচনার প্রত্যুত্তরে বাংলাদেশের সরকারি ভাষ্য হচ্ছে এইসব অনিয়মের জন্য অভিবাসন সংক্রান্ত রিক্রুটিং সংস্থা ও তাদের এজেন্ট দায়ী। এইরকম দায়সারা আচরণ নতুন নয়।

আইনত এইসব এজেন্সি ও এজেন্টদের নিবন্ধন ও তদারকির দায়িত্ব সরকারের। যে অভিবাসী প্রত্যাশীরা বিদেশে যান, তাদেরও নিবন্ধন করতে হয় সরকারের সাথে। যে ট্রাভেল এজেন্সি উড়োজাহাজের টিকেট প্রদান করে, তারাও সরকারের নিয়ন্ত্রণেই এই সেবা দেয়। যে দ্বিপাক্ষিক (এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া) দলিলের মাধ্যমে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও তাদের প্রতিনিধি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে, সেই দলিলটিতে স্বাক্ষর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির।

তারপরেও যদি বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট দেশে অনিয়ম চলতে থাকে, সেই ব্যর্থতার দায়ভার সরকার এড়াতে পারে না। আইন প্রয়োগে সরকার ব্যর্থ হলে সুযোগ সন্ধানীরা বেআইনি কাজে লিপ্ত হতে পারে, এই কথা দুঃখজনক হলেও সত্যি।

এই যে বলা হচ্ছে, প্রকৃত অভিবাসন ব্যয় এবং অভিবাসী প্রত্যাশীর কাছে আদায়কৃত অর্থের মধ্যে বিশাল ব্যবধান এই অর্থ তো শুধু এক হাতে আসে না। অন্য যেকোনো দুর্নীতির ক্ষেত্রে যেমন, এই ক্ষেত্রেও তেমনি এই টাকা দেশে ও বিদেশে কয়েক হাতে ভাগবাটোয়ারা হয়। যদি আমরা ধরেও নেই যে এই ভাগ অধিকাংশই বেসরকারি হাতে যায়, তাহলে এই অন্যায় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব উভয় সরকারের (এই ক্ষেত্রে, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের)।

মালয়েশিয়া বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য শ্রমবাজার। এই ক্ষেত্রে বারবার অনিয়মের জন্য কেন অভিবাসন প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে, তার আশু সর্বোচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠিত হওয়া উচিত। এই ব্যাপারে দীর্ঘস্থায়ী সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন, নতুবা আমরা বারবার হোঁচট খাবো।

এই তদন্ত কমিশনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থা, অভিবাসন ব্যবসায়ীদের সমিতি বায়রা, ব্যবসায়ীদের অ্যাপেক্স প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই, অভিবাসন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, অভিবাসন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সংসদীয় ককাস, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, প্রাক্তন কূটনীতিবিদ, অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধি থাকবেন।

তারা সরকারের ভেতরে ও বাইরে, দেশে ও মালয়েশিয়াতে অনিয়মের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ করবেন ও তা বাস্তবায়নের রোডম্যাপ দেবেন। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না, সেই তদারকিও এই কমিটি করবে। এই কমিটির প্রস্তাব বাস্তবায়নের অগ্রগতি সরাসরি ও নিয়মিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হবে।

এই ধরনের উচ্চ পর্যায়ের পদক্ষেপের পাশাপাশি আরও বিকল্প প্রস্তাব থাকতে পারে, তবে এই ধরনের উদ্যোগ আশু প্রয়োজন। না হলে শুধু অভিবাসীদের ক্ষতি নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নের রোল মডেল ইমেজের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আসিফ মুনীর ।। অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top