বুধবার, ২৬শে জুন ২০২৪, ১১ই আষাঢ় ১৪৩১


বাঁধ ভাঙে গরিবের, লাভ হয় ঠিকাদারের


প্রকাশিত:
৩ জুন ২০২৪ ১৪:৪১

আপডেট:
২৬ জুন ২০২৪ ০৫:১৪

ছবি সংগৃহিত

ঘূর্ণিঝড় রেমাল এসে, আঘাত হেনে, ৪০ ঘণ্টা তাণ্ডব চালিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আমরা শহুরে মানুষ, শহুরে গণমাধ্যম সপ্তাহ পেরোনোর আগেই ভুলে গেছি রেমালের কথা। কিন্তু রেমালের আঘাতে যে ২০ জন মানুষ মারা গেছেন, তাদের পরিবার সারাজীবনেও ভুলতে পারবে না এই ঘূর্ণিঝড়ের কথা। যাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে, গবাদি পশু মারা গেছে, ফসলের খেত ডুবে গেছে, মাছের ঘের ভেসে গেছে; তাদের কাছে রেমাল সারাজীবনের কান্না হয়েই থাকবে।

ভৌগোলিক কারণে আমাদের প্রতিবছরই ছোট বা বড় ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার মোকাবিলা করতে হয়। কোনো কোনো ঘূর্ণিঝড় হয়তো আইলা বা সিডরের মতো প্রলয়ঙ্করী হয়, কোনোটা আবার একটু কম ক্ষতি করে। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ক্ষতি কম বেশি মনে হলেও, উপকূলের প্রান্তিক মানুষের কাছে সবই সমান।

আমাদের কাছে যেটা সামান্য ক্ষতি, তাদের কাছে সেইটাই হয়তো সর্বস্ব। উপকূলের মানুষ নিজেদের মতো করে চাষবাস করে। কিন্তু প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস এসে সব ভাসিয়ে নেয়। তারা আবার গড়ে, আবার ভেসে যায়। এই লড়াই বেঁচে থাকার, এই লড়াই টিকে থাকার।

বন্যা আমাদের প্রতি বছরের দুর্ভোগ। কিন্তু দুর্ভোগই বা বলি কেন। প্রতিবছর বন্যা হয় বলেই আমাদের জমি উর্বর থাকে। বীজ ফেললেই ফসল হয়। তবে অকাল বন্যা হলে ভেসে যায় ফসল। এখন যেমন সিলেটের মানুষ বন্যায় কষ্ট পাচ্ছে। তবে শত দুর্নীতির পরও আমাদের লড়াকু কৃষকরা ফসল ফলান বলেই আমরা বাবুরা এসি রুমে বসে ঠিকঠাক মতো খেতে পারছি।

প্রতিবছর ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা হবেই; এটা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। উন্নয়ন যতই হোক, প্রকৃতির সাথে পেরে ওঠা এখনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি যতটা কমিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা করতে পারি। এটা মানতেই হবে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা যথেষ্টই দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি।

৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। আশির দশকেও ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যেতো। মানুষের লাশ ভেসে যেত, শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করতো। সেই অবস্থা এখন আর নেই। ঘূর্ণিঝড় যত ভয়াবহই হোক, মৃত্যুর সংখ্যা এখন অনেক কমে এসেছে। যারা মারা যাচ্ছেন; তারা নিজেদের খামখেয়ালি বা ঘূর্ণিঝড়কে পাত্তা না দেওয়ার বলি হচ্ছেন।

এখন আগে থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি, শক্তিমত্তা, গতিপথ সব জানা যাচ্ছে। এমনকি সবার মোবাইলেই এখন ঘূর্ণিঝড়ের খবর মিলছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিগন্যাল মেনে সময়মতো আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে হয়তো প্রাণহানি শূন্যে নামিয়ে আনাও অসম্ভব নয়।

জীবন বাঁচানোয় আমরা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলেও জানমাল রক্ষায় আমরা এখনো যথেষ্ট সফল হতে পারিনি। মানতেই হবে জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। জীবন আসলে অমূল্য। কোনোকিছুর বিনিময়েই জীবন ফিরে পাওয়া যায় না। তবে উপকূলের প্রান্তিক মানুষের কারও কারও কাছে জীবনের চেয়ে সম্পদ কখনো কখনো বেশি মূল্যবান হয়ে যায়। বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া তাদের জন্য অনেক সহজ। কারণ বাঁচতে হলে খাওয়া-পড়ার জোগাড় করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যদি সব সম্পদ ধ্বংস করে দেয়, তাহলে তাদের বেঁচে থাকাটা আরও বেশি কষ্টকর হয়ে যায়।

বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কমিয়ে আনতে দেশের বিভিন্নস্থানে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধ ঠিকঠাক থাকলে বন্যার পানি বা জলোচ্ছ্বাসের পানি লোকালয়ে ঢুকতে পারে না, ফসল বা মাছের ঘের ভাসিয়ে নিতে পারে না। একটি বাঁধ তাই হতে পারে লাখো মানুষের লাইফলাইন।

রেমাল আঘাত হানার আগে আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার বদলে বাঁধ রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বাঁধ সরকার বানায়। রক্ষা, মেরামতের দায়িত্বও তাদের। কিন্তু সাধারণ মানুষ সবসময় সরকারের আশায় বসে থাকে না। তারা নিজেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বুক পেতে দিয়ে হলেও বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু সবসময় তাদের চেষ্টা সফল হয় না। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় সব প্রতিরোধ।

এবার রেমালেও উপকূলীয় এলাকার ৮ জেলায় অন্তত ৩০০ স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। অন্তত ৩৫টি স্থানে বাঁধ উপচে জোয়ারের পানি ঢুকে গেছে লোকালয়ে, সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বাঁধ ভাঙার যে ক্ষতি; তা দীর্ঘমেয়াদি, বহুমাত্রিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপূরণীয়।

বাঁধ ভেঙে বা উপচে লোনাপানি লোকালয়ে প্রবেশ করলে ফসল ভেসে যায়, মাছের ঘের-পুকুর ভেসে যায়, লোনা পানি ঢুকে আটকে থাকলে জমির উর্বরতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। বাঁধ তাই উপকূলীয় মানুষের জীবনের অপরিহার্য। কিন্তু মানুষের জন্য এত প্রয়োজনীয় বাঁধ নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ কম।

প্রতিবছরই বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় এলে বাঁধ ভাঙার খবর আসে। বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস যে আসবে, এটা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু তাহলে আমরা উঁচু এবং টেকসই বাঁধ বানাই না কেন? প্রশ্নটি বোকার মতো হলো কি না জানি না।

আমরা এখন পদ্মা সেতু বানাতে পারি, হাওরের বুক চিড়ে সড়ক বানাতে পারি, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল বানাতে পারি; আর টেকসই বাঁধ বানাতে পারবো না; এটা আমি বিশ্বাস করি না। প্রতিবছর যে বাঁধ ভাঙে, এজন্য কি দায়ী কেউ শাস্তি পায়? আমি জানি পায় না। কেন আমরা টেকসই বাঁধ বানাই না? এই প্রশ্নের উত্তরটা আমার ধারণা সবাই জানেন।

প্রতিবছর বাঁধ ভাঙাবে, আবার নতুন করে মেরামত হবে, নতুন নতুন ঠিকাদার আসবে, তাদের পকেট মোটা হবে, ইঞ্জিনিয়াররা কমিশন পাবেন। বাঁধ ভাঙার সাথে অর্থনীতির, সমৃদ্ধির দারুণ যোগসূত্র আছে। বাঁধ ভাঙালে কিছু গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আরও গরিব হবে। আর কিছু বড়লোক ঠিকাদার ও ইঞ্জিনিয়ার আরও বড়লোক হবে। আর তারা বড়লোক হলে জিডিপি বাড়বে, মাথাপিছু আয় বাড়বে। আপনিই বলুন, আপনি কি চাইবেন না, কিছু মানুষ উপকৃত হোক। গরিব মানুষ আরও গরিব হলে কার কী যায় আসে।

গণমাধ্যমে দেখলাম, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত করা নিয়ে টানাপড়েন চলছে। মেরামতের কাজটা কে করবে, বালুটা কে সরবরাহ করবে, বস্তাটা কার দোকান থেকে আসবে এই নিয়ে দ্বন্দ্বে অতি জরুরি বাঁধ মেরামতও আটকে আছে অনেক জায়গায়।

প্রতিবছর বাঁধ ভাঙবে, মেরামত, কিছু লোক আরও ধনী হবে; এই চক্র থেকে বাঁধ ব্যবস্থাপনাকে রক্ষা করতে না পারলে বারবার ঝড় এসে নিঃস্ব করে দেবে আমাদের প্রান্তিক মানুষদের। তাদের জন্য হলেও আমাদের টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও সময়োপযোগী মেরামত ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top