মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১লা আশ্বিন ১৪৩১


যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌপথ যেভাবে গুরুত্ব পেতে পারে


প্রকাশিত:
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৪৫

আপডেট:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০১:৪৫

ছবি সংগৃহিত

বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। সড়কপথ এবং রেলপথের পাশাপাশি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্কে জলপথও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য নদী ও খাল বিদ্যমান, যা নৌপথের কৌশলগত উন্নয়নের জন্য সহায়ক। আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, পণ্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে, জলপথ, শিপিং সেক্টর এবং বন্দরগুলো তাদের দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করছে।

যেমন জার্মানি হলো লজিস্টিকসের জন্য বিশ্বের এক নম্বর কেন্দ্র। সামগ্রিক জার্মানির বাহ্যিক বাণিজ্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ, সমুদ্রবন্দর দ্বারা পরিচালিত হয়। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ জলপথ সমূহও, উদাহরণস্বরূপ রাইন (Rhine River), দানিউব (Danube River), মোজেল (Mosel) এবং অনেক খাল, পরিবহন ও অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

পর্যটন খাতেও জলপথ অবদান রাখছে। যেমন, গ্র্যান্ড ক্যানেল (The Grand Canal) হলো অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরে অবস্থিত বিশ্ব বিখ্যাত লেগুন শহরের জীবনরেখা। গ্র্যান্ড ক্যানেল ছাড়া ভেনিসকে হিসেবে ভাবা যায় না। প্রায় ৪ কিলোমিটারের দৈর্ঘ্য ধরে, প্রস্থ ৩০ থেকে ৭০ মিটারের মধ্যে, যার জলের গভীরতা ৫ মিটার পর্যন্ত। এটি ভেনিসের বৃহত্তম খাল।

শহর পরিদর্শন করার জন্য মানুষ জলপথ ব্যবহার করে এবং তাই এখানে অসংখ্য নিয়মিত নৌকা, জল ট্যাক্সি, সাপ্লাই বোট, গন্ডোলা এবং ট্যুর বোট রয়েছে। জার্মানি ও ইতালির মতো বাংলাদেশও নৌপথের সুবিধা পেয়েছে।

নদী ও নৌপথের সুবিশাল নেটওয়ার্কের আশীর্বাদপুষ্ট বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। এই বিস্তৃত নদী ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীসহ অসংখ্য ছোট নদী ও খাল। এই জলপথগুলো পরিবহন ও বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

যানজট, রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত ব্যয় এবং সড়ক পরিবহনের পরিবেশগত প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থনীতির প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে বিদ্যমান পরিবহন নেটওয়ার্ককে অপটিমাইজ করা জরুরি। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে নৌপথকে একীভূত করা এই চ্যালেঞ্জগুলোর একটি কৌশলগত সমাধান প্রদান করে।

পরিবহন ব্যবস্থায় জলপথের অন্তর্ভুক্তিকরণে বহুমাত্রিক সুবিধা পাওয়া যায়। প্রথমত, এটি পরিবহন খরচ কমাতে পারে। নৌপথে পণ্য পরিবহন সাধারণত সড়ক পরিবহনের চেয়ে বেশি সাশ্রয়ী, বিশেষ করে বড় পণ্যের জন্য।

মালবাহী পরিবহনের জন্য জলপথ ব্যবহার করলে লজিস্টিক খরচ কম হবে, যার কারণে ভোক্তাদের কম দামে পণ্য সরবরাহ করা যাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যগুলো প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।

নৌপথের উন্নয়ন গ্রামীণ এলাকায় অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে উদ্দীপিত করবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি, পর্যটন এবং স্থানীয় শিল্পে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে। এসব এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে, নৌপথসমূহ সুষম আঞ্চলিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে এবং গ্রামীণ এলাকায় শহুরে সুবিধা স্থাপন করা যাবে।

পরিবহন ব্যবস্থায় জলপথ অন্তর্ভুক্তিকরণ পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকেও উপকারী। সড়ক পরিবহনের তুলনায় জলপথে সাধারণত কম পরিবেশ দূষণ হয়। অধিকন্তু, জলপথ পরিবেশের উপর রাস্তার যানজটের প্রভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। রাস্তায় অতিরিক্ত যানবাহন বায়ু এবং শব্দ দূষণ তৈরি করে, যেখানে জলপথগুলো শান্ত এবং পরিষ্কার বিকল্প হিসেবে কাজ করে।

সড়ক পরিবহনের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে, নৌপথে স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে পারবে। এতে করে আমাদের দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় এবং সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্টের লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখতে পারে।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌপথের সফল হওয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান নৌপথের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ, নতুন বন্দর ও টার্মিনাল নির্মাণ এবং সারা বছর নির্বিঘ্নে নৌ চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অবকাঠামোতে বিনিয়োগের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সুরক্ষার মতো সমস্যাগুলোও সমাধান করতে হবে।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এই উন্নয়নগুলো অর্থায়ন ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে, সরকার জলপথের অবকাঠামোর উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। পাশাপাশি, উন্নত ন্যাভিগেশন সিস্টেম এবং টেকসই জাহাজের নকশা এবং নিরাপত্তা উন্নত করতে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগী হ‌ওয়া উচিত।

নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা, নৌপথকে পরিবহন ব্যবস্থায় একীভূত করার জন্য উল্লেখযোগ্য কার্যকর নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। সরকারকে বিস্তর কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে যা পরিবহন নেটওয়ার্কে জলপথের ভূমিকার রূপরেখা হিসেবে কাজ করবে। এই কৌশলের মধ্যে স্পষ্ট উদ্দেশ্য, বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং নৌপথের অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য নিয়ন্ত্রক কাঠামো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

সরকারের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার, আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় সংস্থাগুলোর অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে যাতে জলপথ প্রকল্পগুলো সামগ্রিক পরিবহন লক্ষ্যগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রয়োজনগুলো সমাধান করা হয়।

বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌপথ অন্তর্ভুক্ত করা পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দেশের প্রাকৃতিক জলপথ ব্যবহার করলে আন্তঃজেলা সংযোগ বৃদ্ধি পাবে, পরিবহন খরচ কমাতে পারে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উদ্দীপিত করতে পারে এবং পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

এই সুবিধাগুলো অর্জনের জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ, কৌশলগত পরিকল্পনা এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন। যেহেতু নতুন সরকার পরিবহন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভাবনী সমাধানগুলো অন্বেষণ করছে, তাই জলপথের একীকরণ অগ্রাধিকার দেওয়া আরও দক্ষ, স্থিতিস্থাপক এবং টেকসই পরিবহন নেটওয়ার্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

লেখক: প্রভাষক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top