শুক্রবার, ১৪ই মার্চ ২০২৫, ৩০শে ফাল্গুন ১৪৩১


আলোর পথিক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী


প্রকাশিত:
১৬ জানুয়ারী ২০২৫ ১২:৩২

আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৬:৪৬

ছবি সংগৃহীত

বাংলা এবং বাঙালির জাগরণ ধারাকে বেগবান করার ভাবনায় উজ্জীবিত ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী পুরো দশকটি। তখন মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করার আয়োজন চলছে। বাংলাভাষায় স্বাস্থ্যবিজ্ঞান পড়া বা ব্যাখ্যা করার উপায় ছিল না। কারণ সে সময় যথাযথ পরিভাষার তীব্র অভাব ছিল। তখন বাংলা একাডেমি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের পরিভাষা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

এই স্বপ্নকে সফল করার জন্য কয়েকজন অগ্রজ চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডা. আহমদ রফিক, ডা. সাঈদ হায়দার প্রমুখগণ। তাদের সাথে অপেক্ষাকৃত তরুণ আরও কয়েকজন যুক্ত ছিলেন। তাদের একজন হলেন ডা. শুভাগত চৌধুরী। ডা. আহমদ রফিক এবং ডা. শুভাগত চৌধুরী যৌথভাবে রচনা করেন ‘চিকিৎসাবিজ্ঞান পরিভাষা (২য় খণ্ড)’ নামের সমৃদ্ধ পুস্তকটি। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে যারা লেখেন বা লিখতে আগ্রহী তাদের জন্য বইটি এখনো গুরুত্ববহ। অনেকের মতো আমিও ডা. শুভাগতের নাম শোনার আগে তার মাকে জেনেছি। তার মা ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী খ্যাতিমান লেখক এবং শিক্ষাবিদ।

মানিকগঞ্জের এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের বৃহত্তর পরিবারে মহিলাদের পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক বেগম’ নিয়মিত আসতো। আমরা যারা বইপোকা ধরনের পড়ুয়া ছিলাম তারা মা, ফুফু, চাচি, আপাদের পড়া শেষ হয়ে গেলে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পড়ার সুযোগ পেতাম।

বিশেষ করে ঈদ ও নানা উৎসব বা বিশেষ সংখ্যায় অনেকগুলো গল্প উপন্যাস থাকতো। ‘সাপ্তাহিক বেগম’-এ তখন কেবল নারী লেখকদের লেখা থাকতো। সেখানেই প্রথম ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরীর নাম জানি এবং তার লেখা পড়ি। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর লেখালেখির সূত্রে ডা. শুভাগত চৌধুরীর নাম জানতে পারি। তিনি তখন দৈনিক সংবাদের মঙ্গলবারের খেলাঘরের পাতায় শিশুকিশোরদের উপযোগী ভাষায় স্বাস্থ্য বিষয়ে লিখতেন।

স্বাধীনতার প্রথম দশকের শেষ অংশে আমি খেলাঘরের পাতায় কাজ করেছি। ১৯৪৫ সালে সিলেটের বিশ্বনাথ পরগণার জমিদার দেওয়ান শরৎচন্দ্র চৌধুরীর পৌত্র সিলেটের ‘ডিস্ট্রিক্ট অর্গানাইজার অব ওয়ার ফ্রন্ট’ শৈলেন্দ্র কুমার চৌধুরীর সাথে মঞ্জুশ্রীর বিয়ে হয়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। শৈলেন্দ্র-মঞ্জুশ্রী দম্পতির তিন সন্তান শুভাগত চৌধুরী, অরূপরতন চৌধুরী এবং মধুশ্রী চৌধুরী (বিয়ের পর মধুশ্রী ভদ্র)। ছোটভাই অধ্যাপক অরূপরতন চৌধুরী দন্তবিশেষজ্ঞ এবং স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ছোটবোন অধ্যাপনা করেন।

১৯৪৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শুভাগতের জন্ম হয়। শৈশবের পড়াশোনা শুরু হয় সিলেটে। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে তার ঠাঁই হয়। কিছুকাল সেখানে কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন সিলেটে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সিলেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন।

১৯৬৯ সালে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর থেকে শুভাগত, ডা. শুভাগত চৌধুরী নামে পরিচিতি লাভ করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি এমফিল, এফসিপিএস পাস করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান। ইংল্যান্ডকে তখন বিলাত বা বিলেত বলা হতো। এছাড়া পৃথিবীর বেশকিছু উন্নত দেশে প্রবন্ধ পাঠ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও প্রশিক্ষণের জন্য তিনি যান।

ছোটবেলা থেকেই গান, কবিতা ও নাটকের প্রতি তার সীমাহীন আগ্রহ। পড়াশোনার পাশাপাশি গান শিখেছেন, অবশ্য পরে গান ধরে রাখেননি। ছাত্রজীবন থেকেই অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন। কবিতা আবৃত্তিতে মগ্ন হতেন। ডা. শুভাগতের মায়ের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল ‘শিক্ষাই জীবন, জীবনই শিক্ষা’।

মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শুভাগতরা তিন ভাইবোন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেন। মেডিক্যাল বায়োকেমিস্ট্রির শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন।

যেসব মেডিক্যাল কলেজে তিনি কর্মরত ছিলেন সেখানকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, নাট্য আয়োজন ইত্যাদির মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করতেন। এসব অনুষ্ঠানে তিনি নিজে সবার সাথে গান গাইতেন, নাটকে অভিনয় করতেন, কবিতা আবৃত্তি করতেন। পারিবারিক শিক্ষা ও রুচির প্রভাবে তিনি মার্জিত ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন।

সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তার ঈর্ষণীয় পর্যায়ের জনপ্রিয়তা ছিল। শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী? এরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তার সরাসরি শিক্ষার্থীরা আবেগাক্রান্ত হয়ে যায়। প্রফেসর চৌধুরীর ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানতো। সাবলীল ভাষায় পাঠ্য বিষয়কে সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি ক্লাস নিতেন।

পরিশীলিত কণ্ঠে, মার্জিত ভঙ্গিতে তিনি কথা বলতেন। শব্দ চয়ন এবং শব্দ প্রক্ষেপণের মুনশিয়ানার সাথে কণ্ঠস্বরের ওঠানামা ও আবেগের সঠিক মিশেলে তার প্রতিটি বাক্য অন্তর্গ্রাহী হতো। লেকচার ক্লাস নেওয়ার সময় তার পাঠদানে কবিতা, সংগীত ও নাটকের সমন্বিত প্রভাব থাকতো। অনেকে এই ভঙ্গির সাথে অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ক্লাসের তুলনা করেন। অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ক্লাস এরকম হৃদয়গ্রাহী হতো।

শিক্ষক সাধারণত দুই ধরনের হয়। এক ধরনের শিক্ষকগণ যোগ্যতা ও গুণাবলীর দ্বারা মনের ভেতর শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হন। এরা শ্রদ্ধাভাজন। এদের জন্য ছাত্রদের বুকভরা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকে। দ্বিতীয় ধরনের শিক্ষক হচ্ছেন কেবলমাত্র শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে যারা শিক্ষক পদাধিকারী হয়েছেন। শিক্ষা এদের জীবনের ব্রত না হয়ে আর পাঁচটা চাকরির মতো শুধুমাত্র অর্থ রোজগারের পথ মাত্র। পাঠদানে এরা আনন্দ পায় না, কেবলমাত্র যান্ত্রিকভাবে সময় ক্ষেপণ করে। এরা কখনো শ্রদ্ধার আসনে অভিষিক্ত হয় না।

নির্দ্বিধায় বলা যায় ডা. শুভাগত চৌধুরী প্রথম ধরনের শিক্ষক ছিলেন। তার মৃত্যুতে তার অনেকজন ষাটোর্ধ্ব বয়সী শিক্ষার্থীর চোখ ভিজে যেতে দেখেছি। প্রিয় শিক্ষকের বিয়োগব্যথায় ম্রিয়মাণ হতে দেখেছি। তখন মনে হয়েছে যে জীবন সৃজন কুশলতায় বহুজীবন ছুঁয়ে যায় সেটাই মহৎ জীবন।

চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অন্যতম একটি অভিযোগ হলো, তারা সহজ বাংলা ভাষায় রোগী বা রোগীর স্বজনকে রোগ সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে পারেন না। তাদের কথায় ইংরেজির বাহুল্য থাকে। চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে কার্যকর মানসিক সংযোগ বা যোগাযোগ স্থাপন। এজন্য মুখের ভাষার সাথে দেহের ভাষার সমন্বয় সাধন করতে হয়। ডা. শুভাগত চৌধুরী এক্ষেত্রে বরফ ভাঙার কাজটি শুরু করেছেন। তিনি সহজ ও বোধগম্য বাংলায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে শুরু করেন।

তিনি যেমন শিশুকিশোরদের জন্য লিখেছেন তেমনি বড়দের জন্যও লিখেছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহের পত্রিকায় তার লেখা থাকতো। এভাবেই দেশের মানুষ স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সাধারণ বিজ্ঞান নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন যে কৃতিত্ব দেখিয়ে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে করেছেন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে লেখালেখির জগতে ডা. শুভাগত চৌধুরী ঠিক সেই কাজটি করেছেন।

শুভাগত চৌধুরী প্রথমে সাহিত্য লিখতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল পড়ে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীনের সাথে শুভাগতের পরিচয় হয়। তার স্বনামধন্য মা ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরীর মাধ্যমে এই পরিচয় ঘটে। আল-মুতী শরফুদ্দীন তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। তখন আল-মুতী শরফুদ্দীন জনপ্রিয় লেখক। তার পরামর্শ গ্রহণ করে শুভাগত চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রাণরসায়ন নিয়ে কলম ধরলেন। তাতে সোনার ফসল জন্ম নিলো। একজন চিকিৎসা বিজ্ঞান লেখককে পথ চিনিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বের জন্য আমরা অবশ্যই আল-মুতী শরফুদ্দীনের নিকট ঋণ স্বীকার করি।

ডা. শুভাগত চৌধুরীর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। এইসব বইয়ে তিনি শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবার স্বাস্থ্য সমস্যা, ভালো থাকা ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। তার রচিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—‘শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে’; ‘বয়স্কদের স্বাস্থ্য’; ‘কর্মজীবী নারীর স্বাস্থ্য’; ‘সুখে অসুখে’; ‘শরীর অসুস্থ হলে আপনার কী করণীয়’; ‘নিজের খেয়াল নিজে রাখুন’; ‘শরীর নামের কারখানা’; ‘সুস্থ হার্টের জন্য’; ‘টিন এজ মন শরীর ও স্বাস্থ্য’; ‘ভালো থাকা সুস্থ থাকা’; ‘কিডনীর যত্ন’; ‘মগজের অসুখ’; ‘ডায়াবেটিস : রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার’; ‘সুস্থ থাকার সহজ উপায়’; ‘প্রেসক্রিপশন ফর লাইফ’; ‘আপনার স্বাস্থ্য কুশলসমগ্র’; ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানে আবিষ্কারের কাহিনী’; ‘গোপন রোগের কথা’; ‘জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই’; ‘আমাদের শরীর’; ‘আবেগ ও স্বাস্থ্য’; ‘ডায়াবেটিস ব্লাডপ্রেশার কোলেস্টেরল হার্ট এটাক’; ‘ক্যান্সার’; ‘রোগীদের বলা গল্প’; ‘খাদ্য পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকথা’; ‘মনের এ দুয়ারটুকু’; ‘যৌবন ধরে রাখতে হলে’; ‘ভালো থাকুন সজীব হয়ে বাঁচুন’; ‘আমাদের শরীর’ ইত্যাদি।

তিনি ‘প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের লীলাভূমি : কানাডা’ নামে একটি ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন। জনপ্রিয় স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির পাশাপাশি তিনি পেশাগত লেখাতেও নিবেদিত ছিলেন। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালে তার ৫০টির মতো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো পেশাগত বিষয়ে তার সুনাম বয়ে এনেছে। তাকে ইউএসএ-র নিউইয়র্ক সায়েন্স একাডেমির সদস্য নির্বাচিত করা হয়।

লেখালেখির জন্য তিনি ২০২১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। অনেকের মতো আমিও মনে করি এই পুরস্কারটি আরও আগে তার পাওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে সান্ত্বনা এই যে জীবিতকালে নিজ হাতে পুরষ্কারটি তিনি গ্রহণ করতে পেরেছেন। অনেকের ক্ষেত্রে মৃত্যুর পরে এই পুরষ্কার প্রাপ্তি ঘটে। এছাড়াও তিনি শেরেবাংলা জাতীয় পুরষ্কার-২০০৯সহ আরও কিছু পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

ডা. শুভাগত চৌধুরীর রাজনৈতিক ভাবনা অধিকাংশ সময়ে অনুল্লেখ্য থেকে যায়। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। মানবমুক্তি ও মানবকল্যাণ তার জীবনের ধ্রুবতারা হয়ে ছিল। তাই কল্যাণব্রতী জীবনের পথে তিনি চিরকাল হেঁটেছেন। তিনি আমৃত্যু প্রগতিশীল চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-র সাথে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি বহুসংখ্যক জনহিতকর অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে নানাভাবে সংযুক্ত থেকেছেন। এরকম একাধিক সংগঠনে তার সহকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।

২০০৪ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সে সময় আমরা পান্থপথে হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালের শুরু করি। আমাদের নতুন হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সার্ভিসের মান ও গুণ সঠিক পর্যায়ে উন্নত রাখতে তাকে আমরা ডায়াগনস্টিক সার্ভিসের উপদেষ্টার পদ গ্রহণের জন্য নিবেদন করি। তিনি সানন্দে রাজি হয়ে দায়িত্ব নেন। সে সময় তিনি সম্মানীর বিষয়টি আলোচনায় আনতে দেননি। আমাদের প্রদেয় ক্ষুদ্র সম্মানীতেই তিনি সন্তুষ্ট থেকেছেন। এরপর তিনি বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সার্ভিসের হেড হিসেবে যোগ দেন।

শুভাগত চৌধুরীর স্ত্রী হচ্ছেন কামনা চৌধুরী। দু'জনকে একত্রে দেখলে 'মাণিকজোড়' অথবা 'হংসযুগল' উপমা মনে আসতো। তাদের দুই কন্যা এবং এক পুত্র। তিনজনেই বিদেশে বসবাস করে। হংসযুগলের একজন চলে গেলে বেদনামথিত আরেকজনকে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করতে হয়। শুভাগতবধু সেই বেদনাকে ধারণ করে পাথরে পরিণত হয়েছেন।

২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর শুভাগত চৌধুরী তার ফেসবুকে লেখেন—“এই ডিপারচার লাউঞ্জে লাগেজ নেই সাথে, একলা। অপেক্ষা কেবল সেই মুহূর্তের যখন ডাক আসবে। শুন্যহাতে মানুষ আসে শুন্য হাতে যায়।” ডা. চৌধুরী কি তার ভেতরে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন? পরের মাস অর্থাৎ নভেম্বরের ৬ তারিখে লিখলেন—“এবার যে যেতে হবে। দাঁড়ায়ে বল না মোরে, না না না।” ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে যে জীবন প্রদীপটি প্রজ্বলিত হয়ে আলো ছড়াতে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে 'মাল্টিপল মায়েলোমা (Multiple Myeloma)' নামের এক ক্যান্সার ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। প্রায় আট বছর এই কর্কটরোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকেন এবং কর্মমুখর জীবনযাপন করেন।

১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সকালে সেই জীবন প্রদীপটি নিভে গেল। যে মানুষটি জীবনব্যাপী আলো হাতে পথ চললেন, নিজ আলোকে বহু জীবনকে আলোকিত করে গেলেন মৃত্যুতে তার সমাপ্তি হবে না। দূর নক্ষত্রের মতো তিনি দিকনির্দেশক হয়ে আমাদের পথ দেখাবেন। হে গুরু, গভীর শ্রদ্ধা এবং অসীম ভালোবাসায় আপনাকে প্রণিপাত করছি।

ডা. লেলিন চৌধুরী ।। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top