ধর্ষণ প্রতিরোধে বহির্বিশ্বে যেসব পদক্ষেপ চালু রয়েছে
প্রকাশিত:
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৮
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ০০:০৭

বিশ্বব্যাপী ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা, যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান। উন্নত দেশগুলোয় এই অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন এবং কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকলেও, অনেক উন্নয়নশীল দেশে এখনো এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
ধর্ষণের হার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো বিচার করতে গেলে দেখা যায় যে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, বিশেষ করে নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্ক, এই অপরাধ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এই দেশগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অপরাধীদের শনাক্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা করে।
ধর্ষণের শিকার কিশোরীদের জন্য তাৎক্ষণিক আইনি ও মানসিক সহায়তা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি, এই দেশগুলোয় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল পর্যায়ে থেকেই যৌনশিক্ষা ও সম্মতির বিষয়ে পাঠ দেওয়া হয়, যা কিশোরীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখায় এবং ছেলেদের মধ্যে নারীদের প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করে।
তবে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও অপরিহার্য। এ জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুধুমাত্র আইনি কাঠামোই শক্তিশালী করা হয়নি বরং সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
সুইডেন, নরওয়ে এবং ডেনমার্কে ধর্ষণ প্রতিরোধে ব্যাপক সামাজিক পদক্ষেপ গ্রহণের দিক থেকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব দেশে সরকারিভাবে স্কুল পর্যায়ে যৌন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে, যেখানে কিশোর-কিশোরীদের সম্মতি, ব্যক্তিগত সীমানা এবং যৌন সহিংসতার পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়।
এমনকি সুইডেনসহ অন্যান্য অনেক উন্নত দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা সম্প্রসারিত করা হয়েছে, যেখানে সম্মতির অভাবকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই আইনটি নারীর অধিকার রক্ষায় একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়া সুইডিশ সরকার নারী ও কিশোরীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে স্কুল, কর্মক্ষেত্র এবং পাবলিক প্লেসে নিয়মিতভাবে ব্যাপক সচেতনতা কর্মসূচি চালু করেছে।
নরওয়েতে ধর্ষণ প্রতিরোধে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, যা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য দ্রুত ও কার্যকরী সহায়তা প্রদান করে। ডেনমার্কে ধর্ষণ প্রতিরোধে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন, আইনি সহায়তা প্রদান এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা। এছাড়াও ডেনমার্ক সরকার ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণা চালায়।
আইসল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোয় সমাজ নারীবান্ধব হওয়ায় এবং লিঙ্গসমতা বজায় থাকায় ধর্ষণের হার তুলনামূলকভাবে কম। এসব দেশে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে এবং কোনো হয়রানির সম্মুখীন হলে তাৎক্ষণিক সহায়তা পায়। অপরদিকে, অনেক উন্নয়নশীল দেশে ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সামাজিক লজ্জা, দুর্বল আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পেতে বাধাগ্রস্ত করে।
যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জার্মানির মতো দেশগুলোয়ও কিশোরীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন নীতিমালা কার্যকর রয়েছে। যেমন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ব্যবস্থা, দ্রুত বিচার কার্যক্রম, আইনি সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু রয়েছে। এছাড়া এই দেশগুলোয় মিডিয়া এবং সোশ্যাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানো হয়।
ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোও ধর্ষণ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ জার্মানিতে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ হটলাইন চালু করা হয়েছে, যেখানে তারা বিনামূল্যে আইনি ও মানসিক সহায়তা পেতে পারে। এছাড়া, জার্মান সরকার ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম চালায়।
ফ্রান্সে ধর্ষণ প্রতিরোধে একটি জাতীয় ক্যাম্পেইন চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে জনগণকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতন করা হয় এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা প্রদান করা হয়। উত্তর আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা ধর্ষণ প্রতিরোধে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ প্রতিরোধে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন, আইনি সহায়তা প্রদান এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা।
এছাড়া মার্কিন সরকার ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। কানাডায় ধর্ষণ প্রতিরোধে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, যা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য দ্রুত ও কার্যকরী সহায়তা প্রদান করে।
এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলের উন্নত দেশগুলোও ধর্ষণ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে ধর্ষণ প্রতিরোধে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন, আইনি সহায়তা প্রদান এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা।
এছাড়া জাপান সরকার ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় ধর্ষণ প্রতিরোধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য দ্রুত ও কার্যকরী সহায়তা প্রদান করে।
উল্লিখিত উন্নত দেশে কিশোরী মেয়েদের ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে আইনের সহায়তা অত্যন্ত সংবেদনশীল, সুশৃঙ্খল এবং সহানুভূতিশীলভাবে প্রদান করা হয়, যা ভুক্তভোগীদের মানসিক, শারীরিক ও আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রথমত, অধিকাংশ উন্নত দেশে ধর্ষণের শিকার কিশোরীদের জন্য বিশেষায়িত হটলাইন ও জরুরি সেবা চালু থাকে, যা ২৪/৭ কার্যকর থাকে এবং যেখানে ভুক্তভোগীরা গোপনীয়তা বজায় রেখে সাহায্য পেতে পারেন।
একবার অভিযোগ দায়ের করা হলে, পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে এবং ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে বিশেষ প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্সদের দ্বারা ফরেনসিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এই পরীক্ষাগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে পরিচালিত হয়, যাতে কিশোরী কোনো অতিরিক্ত মানসিক আঘাত না পায়।
অধিকাংশ উন্নত দেশে ধর্ষণের শিকার কিশোরী ও তাদের পরিবারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়, যা সরকারি ও বেসরকারি আইনজীবীরা পরিচালনা করেন। এসব আইনি সহায়তা কেবল মামলা পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়াও সহজ করতে বিশেষ ব্যবস্থার ব্যবস্থা করা হয়, যেমন ভিডিও সাক্ষ্য বা গোপন শুনানি, যাতে ভুক্তভোগীকে অভিযুক্ত ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হতে না হয়।
এছাড়া অনেক দেশে কিশোরী ধর্ষণের শিকার হলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ট্রমা কাউন্সিলিং, সাইকোথেরাপি এবং মানসিক সুস্থতার জন্য নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম চালু থাকে, যাতে তারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। অনেক দেশে ধর্ষণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট গঠন করা হয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত না হয় এবং ভুক্তভোগী দ্রুত ন্যায়বিচার পান।
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ধর্ষণের ঘটনার প্রমাণ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও উন্নত দেশগুলো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। ডিএনএ বিশ্লেষণ, সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল প্রমাণ এবং অন্যান্য ফরেনসিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশ অপরাধীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী মামলা দাঁড় করাতে পারে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে কিশোরী মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উন্নত দেশগুলোয় ধর্ষণ পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অত্যন্ত কার্যকর। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করা হয়, যাতে তারা নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারে। অনেক দেশে ‘#মি টু (#MeToo)’ এবং অন্যান্য নারীবাদী আন্দোলনের ফলে আইন আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ হয়েছে।
ধর্ষণের শিকার কিশোরী যেন সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন না হয়, সে জন্য আইনগতভাবে তার পরিচয় গোপন রাখা হয় এবং গণমাধ্যমেও তার ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। বিশেষত স্কুল ও কর্মস্থলে যাতে তারা বৈষম্যের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন নীতিমালা ও সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় বিশেষ পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হয়, যেখানে ভুক্তভোগীরা শারীরিক ও মানসিক সহায়তা পান এবং নতুন জীবনের প্রস্তুতি নিতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে কেবল অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করাই নয় বরং ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে একটি নিরাপদ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিশোরী ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য উন্নত দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য এবং অধিকভাবে কার্যকর মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে নারী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্কুল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কিশোরী ধর্ষণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: