বাড়ছে কার্বন, শঙ্কা বিশাল অঞ্চল ডুবে যাওয়ার
প্রকাশিত:
১ মার্চ ২০২৫ ১১:৩৪
আপডেট:
১২ মার্চ ২০২৫ ১৭:১৯

সাম্প্রতিক অতীতে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের (CO₂) ঘনত্ব কখনো এত বেশি ছিল না। গবেষকদের মতে, বর্তমানের পরিবেশ প্রায় ৩০ লাখ বছর আগের অবস্থা প্রতিফলিত করছে। তখন গ্রিনল্যান্ড সবুজে আচ্ছাদিত ছিল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ছিল বর্তমানের তুলনায় প্রায় ২০ মিটার বেশি, আর অ্যান্টার্কটিকা ছিল গাছপালায় সমৃদ্ধ।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, মানুষের বসবাসহীন অঞ্চলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ২৮০ পিপিএম (ppm)-এর বেশি হওয়া উচিত নয়, অথচ বর্তমানে তা ৪১০ পিপিএম (ppm) ছাড়িয়ে গেছে। এটাই পরিবেশবিদদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্পখাত থেকে CO₂ নির্গমন ২০২২ সালে ছিল ৩৭.১৫ বিলিয়ন মেট্রিক টন (GtCO₂)।
২০২৩ সালে এটি আরও ১.১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে রেকর্ড ৩৭.৫ (GtCO₂)-তে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৯৯০ সালের তুলনায় বৈশ্বিক নির্গমন ইতিমধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জলবায়ু সংকটকে আরও গভীর করছে।
১৭৫০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানি দহন থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) নিঃসরণের বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ ৪২৬.৯ বিলিয়ন মেট্রিক টন নিঃসরণ করেছে। চীন দ্বিতীয় স্থানে (২৬০.৬ বিলিয়ন মেট্রিক টন), রাশিয়া ও জার্মানি যৌথভাবে তৃতীয় (৯৪ বিলিয়ন মেট্রিক টন)।
যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, ফ্রান্স, কানাডা, ইউক্রেন ও পোল্যান্ড পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশ্বের সর্বোচ্চ CO₂ নিঃসরণকারী দেশ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমাতে তাদের কার্যকর উদ্যোগ জরুরি। কিন্তু বাস্তবে তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, মোট কার্বন নিঃসরণের মধ্যে জ্বালানি ও শক্তি খাতের অবদান সর্বাধিক ৭৩.২ শতাংশ। এরপর কৃষি, বনজ সম্পদ ও ভূমি ব্যবহার খাত ১৮.৪ শতাংশ, শিল্প খাত ৫.২ শতাংশ, পরিবহন খাত ১৬.২ শতাংশ অবদান রেখেছে। অর্থাৎ, জ্বালানির বিকল্প ব্যবস্থা না হলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য সম্ভব নয়।
বর্তমানে কয়লা ও ডিজেলের ব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণকে ভয়াবহ মাত্রায় বাড়িয়ে তুলছে। যদি এটি কমানো না যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে একবার করে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ তাদের বসবাসের বিশাল অঞ্চল সমুদ্রের পানিতে হারাবে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত, যা একপ্রকার সুরক্ষা বর্মের মতো আমাদের পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। প্রধান গ্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ও হিলিয়াম। জীবজগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বায়ুমণ্ডলের ভূমিকা অপরিসীম। তবে দুশ্চিন্তার বিষয়, মানুষের অযাচিত কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডল দিন দিন তার স্বাভাবিক গুণাগুণ হারাচ্ছে এবং ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে।
প্রকৃতির নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম অংশ ওজোন স্তর, যা বায়ুমণ্ডলে দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম স্তর ট্রপোস্ফিয়ার, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০-১৬ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এতে ১০ শতাংশ ওজোন থাকে। দ্বিতীয় স্তর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, যা ১০-৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় বিস্তৃত এবং ওজোনের ৯০ শতাংশ এখানেই থাকে। এই স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে জীবজগতকে রক্ষা করে। তাই ওজোন স্তর যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করা আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হলে জীবজগতের ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। মানুষের ত্বকে ক্যান্সার, চোখে ছানি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। বিশেষ করে, শ্বেতাঙ্গদের ত্বকে ক্যান্সারের জন্য অতিবেগুনি রশ্মি অন্যতম কারণ। সামুদ্রিক প্রাণিরাও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে, যা সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে পারে, ফলে প্রোটিন সংকটও দেখা দেবে।
অতিবেগুনি রশ্মি উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে, শস্য উৎপাদন কমায় এবং বনাঞ্চল ধ্বংস করে। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে। বনাঞ্চল কমে গেলে বায়ুমণ্ডলে অপরিশোধিত কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে গিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত করে, যা পরিবেশকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ওজোন স্তর পুনরুদ্ধার করা জরুরি। এজন্য মন্ট্রিল প্রটোকলের নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। বিজ্ঞানীদের মতে, সঠিক পদক্ষেপ নিলে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি ওজোন স্তর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
মন্ট্রিয়াল চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা ওজোন স্তরকে ক্ষয়কারী পদার্থের উৎপাদন ও ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে গৃহীত হয়। পরিবেশ সংরক্ষণের ইতিহাসে এটি অন্যতম সফল চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC), হ্যালোন ও অন্যান্য ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থের ব্যবহার ধাপে ধাপে বন্ধ করা। ফলস্বরূপ, ওজোন স্তর ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হতে শুরু করেছে।
এই চুক্তি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত এবং বিশ্বব্যাপী ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সাহায্য করেছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু এসব ক্ষতিকর পদার্থ গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবেও কাজ করে, তাই এগুলোর ব্যবহার কমানোর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়ও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে। কিয়োটো প্রোটোকল গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে গৃহীত হয়, যা পরবর্তীতে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়। প্যারিস চুক্তির প্রধান লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। একইভাবে, রামসার কনভেনশন আর্দ্র ভূমির সুরক্ষা নিশ্চিত করে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য।
এইসব আন্তর্জাতিক চুক্তির বাস্তবায়নের প্রতিফলন হলো তিন শূন্য রূপকল্প। শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের প্রবক্তা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মূলত এই ধারণার প্রবর্তক। ২০১৭ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ A World of Three Zeros: The New Economics of Zero Poverty, Zero Unemployment, and Zero Net Carbon-এ তিনি এই রূপকল্পের ধারণাটি বিশদভাবে উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বব্যাপী গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDGs) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এটি একটি যুগান্তকারী ধারণা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
তিন শূন্য রূপকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শূন্য কার্বন নীতি, যা পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শূন্য কার্বন বলতে এমন একটি অবস্থাকে বোঝায় যেখানে বায়ুমণ্ডলে নিট কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা হয়। অর্থাৎ, বায়ুমণ্ডলে নির্গত ও শোষিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
এই রূপকল্পের সফল বাস্তবায়ন বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গঠনে সহায়ক হতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার শূন্য কার্বন রূপকল্পে বিভিন্ন কৌশল ব্যাখ্যা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ প্রদান। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎ এবং ভূ-তাপীয় শক্তির মতো পরিষ্কার শক্তির উৎসে স্থানান্তর এবং শক্তি উৎপাদনে দক্ষতা বাড়ানো। এতে ভবন, পরিবহন এবং শিল্পে শক্তি দক্ষতা বাড়িয়ে খরচ কমানো সম্ভব।
এছাড়া কার্বন ক্যাপচার ও স্টোরেজ (CCS) পদ্ধতি গড়ে তোলা যাতে শিল্প প্রক্রিয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ভূগর্ভে সঞ্চয় করা যায়। বিশ্বব্যাপী টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা বৈদ্যুতিক যানবাহন, গণপরিবহন ও সাইক্লিংয়ের প্রসার ঘটিয়ে পরিবহন খাত থেকে নিঃসরণ কমাবে। জঙ্গল রোপণ এবং পুনর্জাগরণও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, যাতে গাছের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শোষণ করা যায়। এছাড়া টেকসই কৃষি ও ভূমি ব্যবহার প্রচলন, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করে।
শূন্য কার্বনের লক্ষ্য অর্জন একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য এবং এই পথে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো—
১. নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন এবং কার্বন ক্যাপচারের মতো ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এখনও চলমান। এই প্রযুক্তিগুলো আরও দক্ষ, কম খরচে এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহারযোগ্য করার জন্য আরও গবেষণা এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন।
২. অর্থনৈতিক চাপ। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে পরিবর্তন একটি বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের জন্য বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন এবং কিছু শিল্পের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
৩. পরিবর্তন প্রতিরোধ। অনেক মানুষ এবং সংস্থা নতুন প্রযুক্তি এবং নীতি গ্রহণে অনিচ্ছুক হতে পারে। এই পরিবর্তন প্রতিরোধ শূন্য কার্বনের লক্ষ্য অর্জনে একটি বাধা হতে পারে।
৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা, এবং এর সমাধানের জন্য সকল দেশের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব শূন্য কার্বনের লক্ষ্য অর্জনে একটি বড় বাধা।
৫. ভৌগোলিক অবস্থান এবং সম্পদ। বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে শূন্য কার্বন অর্জনের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলি সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য আরও বেশি সংবেদনশীল। এছাড়াও, শূন্য কার্বনে পৌঁছানো বৈজ্ঞানিকভাবেও অসম্ভব হতে পারে।
শূন্য কার্বন অর্জন একটি জটিল চ্যালেঞ্জ, তবে এটি অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জীবনমানের উন্নতির সুযোগও সৃষ্টি করে। এটি অর্জনের জন্য সবার যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং সরকার, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সবাইকে এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে হবে।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: