আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ছে, প্রতিরোধে করণীয় কী?
প্রকাশিত:
১৩ মার্চ ২০২৫ ১১:০৭
আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৪:৪৭

জীবন মানেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনের এক অনিবার্য সত্য হলো মৃত্যু। জন্মের মুহূর্ত থেকেই মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে। জীবন এবং মৃত্যু একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যেখানে মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক সমাপ্তি নির্দেশ করে। তবে আত্মহত্যা হলো এই প্রক্রিয়ার একটি ব্যতিক্রম, যা অনেক সময় মানসিক যন্ত্রণা বা হতাশা থেকে মুক্তির চেষ্টায় ঘটে।
এটি মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের একটি প্রতিফলন হতে পারে। আত্মহত্যার চিন্তা একজন মানুষের মনের গভীরে অনেক সময় ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়। আত্মহত্যা হলো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন সমাপ্ত করার একটি প্রক্রিয়া। এটি কোনো একক ঘটনা নয় বরং মানসিক চাপ, একাকীত্ব, সম্পর্কের সমস্যাগুলো কিংবা জীবনের নানা হতাশার প্রভাব থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে।
যখন কেউ নিজের জীবনের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে, তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি বা শূন্যতা তৈরি হয় যা তাদের আত্মহত্যার চিন্তায় আক্রান্ত করে। বিশেষ করে, দীর্ঘস্থায়ী হতাশা বা মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা যেমন, উদ্বেগ, বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন) বা বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা যখন গভীর হয়ে যায়, তখন ব্যক্তি মনে করেন তার এই কষ্টের কোনো শেষ নেই।
এছাড়া বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা বা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের অভাবও আত্মহত্যার চিন্তাকে আরও তীব্র করতে পারে। কেউ যখন অনুভব করেন যে তার সমস্যা বা কষ্টে কেউ আগ্রহী নয় বা সাহায্য করতে পারবে না, তখন তা তাকে একেবারে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় করে তোলে।
প্রিয়জনের মৃত্যু বা সম্পর্কের বিচ্ছেদও আত্মহত্যার চিন্তা উৎপন্ন করতে পারে, যেখানে মানুষ মনে করে আর কিছুই পাল্টাতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার চিন্তা তাদের কাছে কিছুটা সমাধান মনে হতে পারে, কিন্তু এটা কোনো সঠিক সমাধান নয়।
বাংলাদেশে আত্মহত্যা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। প্রতি বছর বাংলাদেশে ১০,০০০ থেকে ১৪,০০০ মানুষ আত্মহত্যা করেন, যা সড়ক দুর্ঘটনার পরে দেশের দ্বিতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ । বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী ও নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৫৬ জন আত্মহত্যা করেন (WHO)। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ বাংলাদেশে। এছাড়া, ২০২৪ সালে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে ২০২৩ সালে দেশে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যার মধ্যে ৬১ শতাংশ নারী (Achol Foundation)।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুঃখজনকভাবে ৪৯.৪ শতাংশ (৩১০ জন) ছিলেন স্কুল শিক্ষার্থী। এই পরিসংখ্যানগুলো নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সচেতনতা এবং কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি।
আত্মহত্যার পেছনে একাধিক মানসিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো—বিষণ্নতা (Depression), উদ্বেগজনিত সমস্যা (Anxiety Disorders), বাইপোলার ডিসঅর্ডার (Bipolar Disorder), সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia), সামাজিক ও ব্যক্তিগত চাপ, পারিবারিক বা সম্পর্কজনিত সমস্যা, আর্থিক সংকট, কর্মক্ষেত্রের চাপ, একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আঘাতমূলক অভিজ্ঞতা (Traumatic Experiences), শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন, প্রিয়জনের মৃত্যু বা বিচ্ছেদ, মাদক ও অ্যালকোহলের আসক্তি।
কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যার চিন্তা করছেন কিনা, তা বোঝার জন্য কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যেমন একাকীত্ব বেছে নেওয়া, স্বাভাবিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকা, প্রিয়জনদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া, হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবে শান্ত হয়ে যাওয়া (যা আত্মহত্যার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিতে পারে), দীর্ঘমেয়াদি হতাশা বা দুঃখবোধ, তীব্র অপরাধবোধ বা মূল্যহীনতা অনুভব করা, আত্মহত্যার ইঙ্গিতমূলক কথা বলা, যেমন ‘আমি বেঁচে থেকে কী লাভ?’, ‘আমার মরে যাওয়া উচিত’, ‘সবাই ভালো থাকবে যদি আমি না থাকি’, বিপজ্জনক বা আত্মবিধ্বংসী কাজ করা, সম্পদ বা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র দান করে দেওয়া, ঘুমের ওষুধ বা বিষাক্ত কিছু সংগ্রহ করা ইত্যাদি।
তাই যখন কেউ এই ধরনের চিন্তা করে, তখন তাকে দ্রুত সহায়তা প্রদান করা উচিত। সামাজিকভাবে বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে খোলামেলা আলোচনা অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। এছাড়া প্রিয়জনদের কাছে থাকা, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং নিজেদের অনুভূতির প্রতি যত্নশীল হওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, মানসিক সুস্থতা যেকোনো শারীরিক অসুস্থতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি চিকিৎসা ও সহায়তার মাধ্যমে পুনরুদ্ধার সম্ভব।
কীভাবে আত্মহত্যা চেষ্টাকারী ব্যক্তিকে সহায়তা করা যায়—
১. যখন একজন ব্যক্তি বলে যে সে আত্মহত্যা সম্পর্কে চিন্তা করছে, তখন এ ধরনের কথা গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। আত্মহত্যা করতে চেষ্টাকারী ব্যক্তিকে সামলানো সহজ কথা নয়। তাই যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যায় সেখানে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করতে হবে।
২. এমন আচরণ ব্যক্তির সাথে না করা যাতে সে আরও কষ্ট পায়। বরং তার কষ্টটা অনুভব করার চেষ্টা করে সহমর্মিতা প্রকাশ করে দ্রুত সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করা।
৩. আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তিকে নিজে নিজে মানসিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করা ঠিক নয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাজীবী ছাড়া কাউন্সিলিং করা অনুচিত। একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা ব্যক্তির চিন্তা ও অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করবেন এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকর কৌশল প্রদান করবেন।
৪. কেন কেউ আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন, তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে উৎসাহিত করতে হবে। এতে মানসিক চাপ অনেকটা কমে যায়।
৫. একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে মিলে একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করা। এই পরিকল্পনায় জরুরি যোগাযোগের নম্বর, মানসিক চাপ মোকাবিলার কৌশল, কখন এবং কোথায় সহায়তা নেওয়া হবে তা নির্ধারণ করা।
৬. মন এবং শরীরকে ব্যস্ত রাখতে এমন কাজে যুক্ত হতে হবে যা আত্মহত্যার চিন্তা থেকে মন সরিয়ে রাখে। পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, প্রকৃতিতে হাঁটা, প্রিয় বই পড়া, সংগীত শোনা—এসব কাজে যুক্ত থাকা মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে।
৭. যদি কেউ আত্মহত্যার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হন, তবে যতক্ষণ না তিনি চিকিৎসার আওতায় আসেন, ততক্ষণ তাকে একা রাখা যাবে না। আশেপাশে বিশ্বাসযোগ্য কাউকে রাখুন এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নিন।
আত্মহত্যার প্রচেষ্টার সময় ব্যক্তি প্রায়ই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন—বেঁচে থাকবেন না মারা যাবেন, এ নিয়ে তারা দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। আত্মহননের আগে অনেক ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে সংকেত দিয়ে থাকেন এবং সাহায্যের প্রত্যাশা করেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির পাশে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন থাকেন না, যারা তাদের আবেগগত সমর্থন দিতে পারেন। তাই উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও আত্মহত্যা প্রতিরোধ কেন্দ্র গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
এসব কেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, সাইকোথেরাপিস্ট এবং প্রশিক্ষিত কাউন্সিলরদের সার্বক্ষণিক সহায়তা নিশ্চিত করা উচিত। সংকটাপন্ন সময়ে তারা আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে আবেগগত সহায়তা দিতে পারেন। ২৪ ঘণ্টা টেলিফোন হেল্পলাইন সেবা চালু থাকলে অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ‘কান পেতে রই’ (একটি মানসিক সহায়তা হেল্পলাইন) এবং ‘মনের বন্ধু’ (অনলাইন মানসিক সহায়তা প্ল্যাটফর্ম)-এর মতো সংগঠনগুলো এই ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করছে। এসব সংগঠন বিপদাপন্ন ব্যক্তিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক চিকিৎসা, সামাজিক সহায়তা এবং পারিবারিক সমর্থন অপরিহার্য। আত্মহত্যার চিন্তা অনেক সময় নীরবভাবে মানুষের জীবনে প্রবেশ করে, যা বাইরের দৃষ্টিতে অদৃশ্য থাকতে পারে। তবে সাহায্য চাওয়া, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হওয়ার এই তিনটি ধাপ কাউকে আবার জীবনের নতুন পথ দেখাতে পারে।
আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, তাদের একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে উৎসাহিত করাও অত্যন্ত জরুরি। সরকারের উচিত আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা, যার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ এবং সামাজিক সহায়তা নিশ্চিতকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এই ধরনের পদক্ষেপ আত্মহত্যার ঝুঁকি কমাতে কার্যকর হতে পারে। কেউ যদি আত্মহত্যার প্রবণতায় ভুগে থাকেন, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, সহায়তা চাওয়া কোনো দুর্বলতার পরিচয় নয়, বরং জীবনের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ।
ড. জেসান আরা ।। সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: