মফিদুল হক
সন্জীদা খাতুন : সুরের স্পর্শে জাতির জাগরণ
প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০২৫ ১১:২৫
আপডেট:
৩১ মার্চ ২০২৫ ১২:২৬

সংগীত ছিল সন্জীদা খাতুনের ধ্যান-জ্ঞান, সংগীতের সুধারসে আপ্লুত ছিলেন তিনি জীবনভর। সংগীত বিশেষভাবে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চায় তার যে সিদ্ধি, সেটা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
সংগীতশিল্পী অভিধায় তাকে কেউ ভূষিত করেনি, সংগীতশিল্পী তিনি বটে, তবে সেইসাথে রয়েছে তার অন্যান্য আরও নানা পরিচয়, যেসব ক্ষেত্রে তার অর্জনও মহিমামণ্ডিত।
তিনি আজীবন অধ্যাপনা করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠদানে তার মতো শিক্ষক দ্বিতীয় আরেকজন ছিলেন না। অ্যাকাডেমিক সব অর্জন ছিল তার হাতের মুঠোয়, তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’ কালোত্তীর্ণ এক গ্রন্থ।
এরপর করেছেন ডি.লিট.। তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী থেকে। সেখানেও সন্জীদা খাতুনের উপস্থিতি ছিল কর্মচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ, চিন্তাশীল অনেক মানুষের সান্নিধ্যে ঋদ্ধ, তাদের সাথে ভাববিনিময় ও সংগীতসূত্রে প্রাণময়।
সন্জীদা খাতুন ছিলেন চিন্তাশীল অনেক গ্রন্থের প্রণেতা, কেবল রবীন্দ্রনাথ নয়, বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির নানামুখী বিশ্লেষণে তার প্রবন্ধাবলী ভাস্বর হয়ে আছে। দশক জুড়ে তিনি মেতেছিলেন নজরুল-চর্চায়, জসীমউদ্দীনও তাকে আকৃষ্ট করেছিল ভিন্নভাবে।
তবে ব্যক্তিগত অর্জনের এইসব পরিচয় ছাপিয়ে সংস্কৃতির ব্যাখ্যাতা, নির্মাতা ও রূপকার হিসেবে তার জীবনভর যে অবদান সেটা তো আরেক বিশাল দুনিয়া আমাদের সামনে মেলে ধরে। তিনি কর্মীব্যক্তিত্ব এবং এই কর্মসাধনা জীবনভর তিনি করেছেন পরম নিষ্ঠায়।
তার অন্তর্মুখী অর্জন ও বহির্মুখী কর্মধারা হাতে হাত ধরে চলেছে, দুই হাতে তিনি সমতালে বাজিয়েছেন কালের দুই মন্দিরা, মিলিয়েছিলেন ঘর ও বাহির।
তিনি বড় হয়েছেন আলোকিত, পারিবারিক পরিমণ্ডলে। পিতা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম রূপকার, শিখা গোষ্ঠীর সম্পাদক, নজরুলের প্রিয়সখা এবং ইন্ডিয়া স্ট্যাটিসকাল ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্র-সহচর প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের প্রিয়পাত্র, নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অধ্যাপক, বাংলাদেশের পরিসংখ্যানবিদ্যার জনক।
পিতার জীবন চেতনায় সম্মিলন ঘটেছিল বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির, কন্যা সন্জীদা খাতুন সংগীতের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে ছায়ানট, ১৯৬১ সালে সামরিক শাসন-পীড়িত পূর্ববাংলায় জাগরণের বার্তা নিয়ে যে সংগঠনের আবির্ভাব।
শাসকগোষ্ঠীর বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনের সামাজিক উদ্যোগ থেকে জন্ম নেয় ছায়ানট, গানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুক্তির আকুতি প্রকাশের অবলম্বন।
গান নিয়েই শুরু হলো ছায়ানটের জাগরণী প্রয়াস, গানের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সমাজকে আপন সত্তায় স্থিত ও একত্র করার আয়োজনে মূল তাগিদ ছিল নিজেকে চেনা, সংগীত-সম্পদের পরম্পরায় বাঙালি সত্তায় সংহত হওয়া।
সাংস্কৃতিক খরার রাজ্যে শিল্পী তৈরি করা ছিল জরুরি এবং সেই দায়িত্ব পালনের ব্রত নিয়ে যাত্রা শুরু করলো ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। সমবেত হলেন অনেক গুণী শিল্পী ও সমাজব্রতী, তবে একাধারে শিল্পী ও সমাজব্রত পালনের যোগ্যতম জুটি ছিলেন সন্জীদা খাতুন-ওয়াহিদুল হক।
ছায়ানটের কর্মকাণ্ডের আশ্রয় হয়ে উঠলো তাদের গৃহ এবং সন্জীদা খাতুন ধরলেন হাল, ঘর হলো বাহির, বাহির হয়ে উঠলো ঘর। জাতির জীবনের বিভিন্ন দুর্দিনে দুর্যোগে ছায়ানট জোগালো সাহস, যার অনুপম প্রকাশ ঘটলো বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রভাতী আয়োজনে, রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান জাতি বরণ করলো বিপুলভাবে, হয়ে উঠলো বাঙালি সত্তার মিলন ও মুক্তির আকুতিবহ প্রতিরোধী উদ্ভাসন।
সাংস্কৃতিক এই জাগরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগ্রামের সংহতিকরণ বাঙালিকে পৌঁছে দিলো মুক্তিযুদ্ধে, জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জনে, যেখানে দেখি সন্জীদা খাতুনের দৃঢ় ভূমিকা, দেশান্তরী শিল্পীদের একত্র করে দেশের গানের পরিবেশনায়।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিরোধ ও নির্মাণ, দুইয়ের সম্মিলনে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা পরিচালনা গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে এবং এক্ষেত্রে সন্জীদা খাতুন যে নিরলস ভূমিকা পালন করলেন তা জাতিকে যুগিয়েছে বিপুল সম্পদ।
নিজেকে তিনি সৃজনে, অধ্যয়নে, উপলব্ধিতে ক্রমে ঋদ্ধ করে চলেছেন, সংগীত ও সংস্কৃতির ব্যাখ্যাতা হিসেবে হয়ে উঠলেন অনন্য। একইসাথে সংস্কৃতির প্রসারে কর্ম ও সাধনার ক্ষেত্র করলেন আরও প্রসারিত।
নানা চড়াই-উতরাই উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলেছে এই অভিযাত্রা, কিন্তু আলোকবর্তিকার মতো তিনি সর্বদা জুগিয়েছেন পথের দিশা, নিজেকে ব্যাপৃত করেছেন বহুবিধ কর্মকাণ্ডে।
সন্জীদা খাতুন সাংস্কৃতিক বিকাশকে বিবেচনা করেছেন বৃহত্তর পটভূমিকায়, যার লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক উদার মানবিকতায় সমাজকে, বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মকে স্নাত করা। কৈশোরে তিনি ছিলেন ব্রতচারী দলের সদস্য, বাঙালির জীবনাদর্শে দীক্ষিত হওয়া ও সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার ব্রতধারী।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকালে ছায়ানট কণ্ঠে তুলে নিয়েছিল ব্রতচারীর গান। স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রতচারীর চর্চা আবার ফিরিয়ে আনতে তিনি হয়েছিলেন বিশেষভাবে উদ্যোগী। শিক্ষা নিয়ে তিনি সর্বদাই ছিলেন আলোড়িত, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বোধ করি তাকে এই দীক্ষা জুগিয়েছিল।
দেশজ জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসাধনে বিশ্বমানব হওয়ার সাধনা ছিল তার শিক্ষা দর্শনের কেন্দ্রে। পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে নৃশংস বোমা হামলায় তিনি বিচলিত হয়েছিলেন বটে, তবে কর্মপথে স্থিরপ্রত্যয়ী হয়ে শিক্ষার ওপর বাস্তব গুরুত্ব আরোপ করে প্রতিষ্ঠা করলেন নালন্দা বিদ্যালয়, ছায়ানটের সমন্বিত শিক্ষা-সংস্কৃতি কার্যক্রম।
আরও কতভাবেই-না নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সন্জীদা খাতুন। বাঙালি জীবনে হয়েছেন এক আইকন, সমগ্র জীবনসাধনা দ্বারা তৈরি করেছেন সমষ্টি মাঙ্গলিক সংস্কৃতির চর্চা ও বিস্তারে ব্যতিক্রমী উদাহরণ।
তিনি বাঙালি জাতির গৌরব, বাংলাদেশের গর্ব, তার অবদান ও শিক্ষায় চলবে আমাদের ভবিষ্যতের পথচলা।
মফিদুল হক ।। উপদেষ্টা, ছায়ানট
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: