মঙ্গলবার, ১৫ই এপ্রিল ২০২৫, ২রা বৈশাখ ১৪৩২


ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও আমাদের প্রস্তুতি


প্রকাশিত:
৮ এপ্রিল ২০২৫ ১০:১২

আপডেট:
১৫ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:১৬

ছবি সংগৃহীত

‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’—এই স্লোগানে চেপে আমেরিকায় দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট পদে বসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুরু থেকেই যে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের কথা বলে এসেছেন তিনি। ২ এপ্রিল সেই শুল্ক চাপিয়ে তার কথা মাফিক কাজ করেছেন তিনি। ট্রাম্পের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ হলো যে দেশ আমেরিকার পণ্যে যতটা শুল্ক চাপাবে, সেই দেশের পণ্যে পাল্টা তার উপযুক্ত পরিমাণ শুল্ক চাপাবেন তিনি।

২০২৪ সালের নভেম্বরে নির্বাচন জিতে মসনদে বসেই এই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তিনি। এই শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরপরই বিশ্ব দেখলো ভিন্ন একটি চিত্র। প্রবল ধাক্কা খেয়েছে আমেরিকার শেয়ার বাজার, শঙ্কিত হয়েছে বাণিজ্য মহল ও কালো ছায়া পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। মনে হচ্ছে রীতিমতো শুল্কযুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্প ট্যারিফ বা শুল্ক কী?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর রকমের পণ্য যায় আমেরিকায়। সেই সব পণ্যের উপর ধার্য হয় আমদানি শুল্ক। যা ইমপোর্ট ডিউটি নামেও পরিচিত। এবার সেই শুল্কই বৃদ্ধি করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন যে শুল্ক চাপানোর ঘোষণা তিনি দিয়েছেন মূলত তাই হলো ট্রাম্প ট্যারিফ। শুল্ক বাবদ আদায় হওয়া টাকা যাবে মার্কিন কোষাগারে। ট্রাম্প প্রশাসনের ধারণা এর জেরে আমেরিকার সরকারের আয় বাড়বে বহুগুণ।

শুল্ক আরোপ নিয়ে ট্রাম্পের যুক্তি:

১. বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মার্কিনি পণ্যে যে হারে কর চাপায় তা অন্যায্য। কারণ ওই সব দেশের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো আমদানি শুল্কের হার অনেক কম। এই দূরত্ব ঘোচাতেই রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বসাচ্ছেন বলে দাবি ট্রাম্পের।

২. আমেরিকার ঘরোয়া উৎপাদন বা ডোমেস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং বাড়ানোর উদ্দেশ্যেও এই শুল্ক চাপানোর কথা সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক বার বলে বেড়িয়েছেন ট্রাম্প। বিদেশি পণ্যে শুল্ক বসানোর জেরে সেগুলোর দাম বেড়ে যাবে মার্কিন বাজারে। এর জেরে আমদানি কমিয়ে আমেরিকার অভ্যন্তরে বেশি পণ্যের উৎপাদনের চেষ্টা চলবে, এটাই ট্রাম্পের ইচ্ছা।

৩. আমদানি শুল্ক বসানোর মাধ্যমে সরকারের আয় বাড়াতে চাইছেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। শুল্কের মাধ্যমে আয় বাড়িয়ে নাগরিকদের আয়কর-এ ছাড়ের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনার কথাও শুনিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্পের ট্যারিফ ঘোষণার পেছনে আরও একটি উদ্দেশ্য রয়েছে তা হলো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সংক্রান্ত রফা করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা। শুল্ক চাপিয়ে মূলত তিনি আগে থেকে বিভিন্ন দেশের ওপর পরোক্ষ চাপ তৈরি করতে চান।

শুল্ক নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া:

ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে তুমুল সমালোচনা করেছে আমেরিকার একাধিক ‘বন্ধু’ দেশ। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স তাদের মধ্যে অন্যতম। তারা মনে করছে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব সুদূর প্রসারী পড়বে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আমেরিকার বন্ধু দেশও প্রতিক্রিয়া দিয়েছে মার্কিন শুল্ক নিয়ে।

তবে এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আবার আমেরিকার ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ড’ হিসেবে সবসময় প্রথম সারিতে থাকে ইসরায়েল ওপরেও শুল্ক চাপিয়েছে ট্রাম্প। এর দ্বারা মূলত একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন তিনি তা হলো আমেরিকার প্রয়োজনে কোনো বন্ধুকে ছাড় নয়। সে যে-ই হোক না কেন।

মার্কিন সমাজে শুল্কের প্রভাব:

৯ এপ্রিল থেকেই এই শুল্ক কার্যকর হবে। আর এই পরিস্থিতিতে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় বাজারমুখী মার্কিন নাগরিকেরা। রীতিমতো ব্যাগ ভর্তি করে দোকানে দোকানে তাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে তাদের। উদ্দেশ্য একটাই মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় আগে থেকেই বাজার শেষ করা। এই দৃশ্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে শুল্ক-কাঁটায় ঘায়েল হতে ভয় পাচ্ছেন খোদ মার্কিন নাগরিকরাও।

মার্কিন নাগরিকদের শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ:

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে আমেরিকার রাজপথে নেমেছে মানুষ। নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলস থেকে হিউস্টন—সর্বত্রই একই দৃশ্য। হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছেন পথে। হাতে প্ল্যাকার্ড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১২০০-র বেশি জায়গায় দেখা গিয়েছে এই ‘হ্যান্ডস অফ’ প্রোটেস্ট। দেড়শোরও বেশি সংগঠন রয়েছে এই বিক্ষোভ-মিছিলের নেতৃত্বে।

যার মধ্যে মানবাধিকার সংগঠন যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে আন্দোলনকারী, শ্রমিক ইউনিয়ন ইত্যাদি। সবারই দাবি, ‘আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হারাচ্ছি।’ তাদের গর্জন, ‘ট্রাম্প একজন বদ্ধ উন্মাদ। উনি আমাদের বিশ্বব্যাপী মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।’

শুল্ক আরোপ বাজারে কী প্রভাব ফেলবে?

১. শুল্ক বৃদ্ধির অর্থ জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া। জিনিসের দাম বাড়লেই বিভিন্ন ভাবে তা ব্যবসাকে প্রভাবিত করে।

২. কোনো পণ্যের দাম বাড়লে বিক্রিতে তার প্রভাব পড়ে। তা সে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যই হোক বা বিলাসী দ্রব্যই হোক। এর জেরে কিন্তু বিক্রি কমার আশঙ্কা থাকে।

৩. করের সঙ্গে দ্রব্যের দামের মোকাবিলা করতে গিয়ে কোম্পানি অনেক সময় জিনিসের দাম বাড়ায় না। এর জেরে কোম্পানি প্রফিট প্রভাবিত হতে পারে। ব্যবসা চালানোর খরচ এর জেরে বেড়ে যেতে পারে।

৪. কোনো এক পণ্যের দাম বৃদ্ধি অন্য এক পণ্যের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করে গ্রাহকদের। কোম্পানিগুলো যে দেশের পণ্যে শুল্ক বেশি, তা না এনে যে দেশের পণ্যে আমদানি শুল্ক কম, সে দেশের পণ্য বেশি আমদানি করা শুরু করে। এর জেরে মার্কেট শিফ্টিংয়ের মতো ঘটনা দেখা দিতে পারে।

সব মিলিয়ে ট্রাম্পের এই ট্যারিফ বা শুল্ক ঘোষণার রেশ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বিশ্ববাণিজ্যের আঙিনায়। ট্রাম্পের এই রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বিশ্বকে বাণিজ্য যুদ্ধের দিকেও ঠেলে দেবে। এই ট্যারিফ আমেরিকার বাজারেও কঠিন মন্দার পরিস্থিতি তৈরি করবে।

বাংলাদেশে ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাব:

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন 'রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ' নীতির অংশ হিসেবে শতাধিক দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছে। তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উপর ধার্য করেছে ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক। এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ।

আমরা জানি বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে যার মধ্যে তৈরি পোশাকের পরিমাণ ছিল ৭৩৪ কোটি ডলার। নতুন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ধাক্কা খাবে এটা সুনিশ্চিত ভাবে বলা যায়।

শুল্কের বিপরীতে এলএনজি ফ্যাক্টর:

বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনার কথা বলেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (বিডা)। এটা নিঃসন্দেহে ভালো একটি প্রস্তাব। বলা ভালো যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস কিনলে আরোপিত শুল্কের প্রভাব মোকাবিলার পাশাপাশি জ্বালানির উৎসের বহুমুখীকরণও হবে। এতে আমারাও সরাসরি লাভবান হবো।

উল্লেখ্য যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি থেকে ইতিমধ্যে এলএনজি কেনা শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। সর্বশেষ ১১ মার্চ বাংলাদেশ সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ওই কোম্পানি থেকে প্রায় ৬৬৪ কোটি ৪০ টাকা ব্যয়ে এক কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দেয়। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের মার্কেটটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে জ্বালানি সরবরাহের এই যে সংকট বা ঘাটতি আছে, সেটাকে আমরা মেটাতে পারবো।

শুল্ক মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি:

যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তাতে করে চীন, কানাডাসহ বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোও পাল্টা পদক্ষেপ ইতিমধ্যে নেওয়া শুরু করেছে। এতে করে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের নাড়াচাড়া খাবে এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ এবং আরও বেশি বাজার সুবিধা (মার্কেট এক্সেস) পাওয়া।

যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে আমেরিকায় বাজার। যা প্রতিযোগিতায় ঠাসা। এই বাজারে কম শুল্কে প্রবেশ করাটা সহজ বিষয় না। আমরা জানি ব্যবসায় অনেক বেশি নন-ট্যারিফ বেরিয়ার থাকে। সেগুলো যাতে না থাকে সেই পদক্ষেপ আমদের সুকৌশলে নিতে হবে।

ভ্যালু চেইনে যে করটা বাড়ানো হলো এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে তাদের ভোক্তাদের ওপরেও পড়বে। বায়িং হাউজের ওপর পড়বে। আমাদের ওপর কতটুকু পড়বে সেটা আরেকটু বোঝাপড়া হতে হবে। আমরা শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন জায়গায় আছি, এর থেকে আর কমানো যাবে না। এর জন্য প্রয়োজনে এখনই ভিন্ন কৌশল নেওয়া। এখনই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে আমাদের সরকারকে। সর্বোপরি আমাদের স্বার্থ বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক মূল্যায়ন করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের শুল্ক মোকাবিলায় আমাদের যে উল্লেখযোগ্য প্রস্তুতি আছে তা কিন্তু এক বাক্যে বলার মতো এখনো সময় আসেনি। তবে আমাদের শক্তির জায়গা যেমন আছে, ঠিক সামর্থ্যের জায়গাও আছে। এখন আমাদের এত বড় ধাক্কা মোকাবিলায় আরও বেশি কূটনৈতিক পারদর্শী হতে হবে। দর-কষাকষির জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে হবে।

প্রয়োজনে বাজারে টিকে থাকতে দ্বৈত নীতি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই বিষয় নিয়ে বেশ আন্তরিকতা দেখা যাচ্ছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতৃত্ব আমাদের আছে। এটাই আমাদের বড় শক্তি। তার ব্যক্তিগত ইমেজকে আমরা চাইলে কাজে লাগাতে পারি। এতে করে এই সমস্যার কিছুটা হলেও আমরা সমাধান করতে পারবো।

প্রশান্ত কুমার শীল ।। শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top