বুধবার, ২৫শে জুন ২০২৫, ১১ই আষাঢ় ১৪৩২


মধ‍্যপ্রাচ‍্য পরিস্থিতি : যুদ্ধ নয়, শান্তিই একমাত্র পথ


প্রকাশিত:
২৫ জুন ২০২৫ ১০:৫৬

আপডেট:
২৫ জুন ২০২৫ ১৬:৫৯

ছবি সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজ করছে ভয়াবহ সামরিক পরিস্থিতি। ১৯৬৭ সালের ৬ দিন ব্যাপী যুদ্ধের পর এত ভয়ংকর বাস্তবতা আর কখনো দেখা যায়নি। ইরানে ইসরাইলের একতরফা ও আগ্রাসী হামলা বিদ্যমান ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও বিপজ্জনক করে তুলছে। সে সাথে ইরানের পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্কার বাসটার বোমা বর্ষণ আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে।

১৩ জুন ২০২৫ থেকে ইসরাইলের হামলা ও ইরানের পাল্টা আক্রমণ অর্থাৎ প্রতিরোধ যুদ্ধ ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমরবিদের নিঃসন্দেহে বিস্মিত করেছে, হতাশ করেছে। ইরানকে দুর্বল করে দেওয়া, সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং চাপ সৃষ্টি করে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে।

এখন একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা সত্যি, নাকি একটি নতুন তামাশা তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তবে যুদ্ধ বিরতি হোক বা না হোক ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে এবং এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে যদি এখনই সব পক্ষ শান্তির পথে না হাঁটে।

বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সংলাপভিত্তিক সমাধান যতটা প্রয়োজনীয়, ততটাই দুর্লভ হয়ে পড়েছে। পরাশক্তিগুলোর নীতিগত অবস্থান এবং সামরিক পদক্ষেপ আজ আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক রূপরেখাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

জাতিসংঘ সনদ বা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত যে ন্যূনতম নীতিগুলো—যেমন কোনো স্বাধীন দেশ দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত না হলে সেই দেশের ওপর সামরিক হামলা না চালানো, সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন—সেগুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থার ফলে শান্তির ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামো দিন দিন জটিলতর হয়ে উঠছে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সামরিক সমাধানের প্রবণতা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে দেশটি নিরাপত্তা নিশ্চিতের কৌশল হিসেবে বারবার সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করেছে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ ছিল এই ধারাবাহিকতার একটি বড় দৃষ্টান্ত।

রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে সংঘাত চলছে, চীন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, এবং ভারতও এই আন্তর্জাতিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করছে। এমন এক বহুমুখী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায়, কোনো একক রাষ্ট্রের পক্ষে আর আগের মতো একতরফাভাবে হস্তক্ষেপ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ নয়।
যদিও ইসরায়েল কিছু সাময়িক কৌশলগত সুবিধা অর্জন করেছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধ পরিস্থিতি একটি স্থায়ী শান্তি কিংবা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। বরং দেশটি একটি সামরিক নির্ভরতাপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ২০২৪ সালে ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলারে, যার মধ্যে শুধু ডিসেম্বরেই খরচ হয়েছে ৫.৭ বিলিয়ন ডলার। এটি ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় বার্ষিক বৃদ্ধির রেকর্ড, যা জিডিপির ৮.৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে এটি ছিল ৫.৪ শতাংশ, সেখান থেকে ১৩৫ শতাংশ বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল কিংবা তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের দিক থেকে একটি কার্যকরী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির নীতি প্রাধান্য পেয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আলোচনার গুরুত্ব বহুবার আলোচিত হলেও, তা বাস্তবে খুব কমই প্রতিফলিত হয়েছে।

১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হলেও, ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাদের স্বীকৃতি এখনো সুদূরপরাহত। জাতিসংঘে এমন প্রস্তাব এলে ভেটোর মাধ্যমে তা আটকে দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

যুদ্ধের মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জনের কৌশল কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়া—এই তিনটি দেশের অতীতের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সামরিক হস্তক্ষেপ ও সরকার পতনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এই দেশগুলোয় রাজনৈতিক শূন্যতা, গৃহযুদ্ধ এবং বহিঃশক্তির উপর নির্ভরতার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে এই প্রশ্নটি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক—সামরিক শক্তি প্রদর্শন আদৌ কি কোনো কার্যকর সমাধান?

বর্তমানে ইরানের প্রেক্ষাপটে একই পন্থা অনুসরণ করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছ। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বারবার বলেছে যে, তারা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (NPT)-এর সদস্য এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর পর্যবেক্ষণের আওতায় রয়েছে। দেশটি শান্তিপূর্ণ পরমাণু শক্তির ব্যবহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছে। কিন্তু তবুও ইরানকে কেন্দ্র করে সামরিক উত্তেজনা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা ভবিষ্যতে একটি বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারে।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট। ১৯৯০ ও ২০০০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যেসব সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতা ভিন্ন।

বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ কেবল একটি মুহূর্তের সমাধান দিতে পারে, কিন্তু তার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হয় প্রজন্মব্যাপী সংকট। গাজা উপত্যকার সাম্প্রতিক সংঘর্ষেও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে যেভাবে একতরফা সামরিক অভিযান পরিচালনা করে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে, তা শান্তির পথকে আরও জটিল করে তুলেছে।

বরং গণহত্যা ও ফিলিস্তিনি জাতিকে নিধনের নতুন খেলা শুরু হয়েছে। মানবিক বিপর্যয়, সামাজিক অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করেছে, যা কেবল গাজা নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের কারণ।

এছাড়া, যুদ্ধ বা সামরিক পদক্ষেপের প্রভাব শুধু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। উদ্বাস্তু সংকট, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, সন্ত্রাসবাদ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—এইসব কিছুই আধুনিক বিশ্বের অন্তঃস্থ ও বহিঃস্থ নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। শান্তির প্রশ্ন তাই কেবল মানবিক বিবেচনা নয়, বরং একটি বাস্তব কৌশলগত প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রতিশোধমূলক হামলা বা সামরিক শক্তির প্রদর্শন আদৌ কি ফলপ্রসূ হবে? ইতিহাস বলছে, এমন পদক্ষেপ কিছু সময়ের জন্য সাময়িক সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা নিরাপত্তা সংকট আরও জটিল করে তোলে। ইরানের সামরিক সক্ষমতা হয়তো সাময়িকভাবে কমানো সম্ভব, কিন্তু দেশটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম এবং তখন আরও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এর ফলে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, তা পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, সেখানে যুদ্ধ নয় বরং দ্রুত কূটনৈতিক সংলাপ, পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে সমাধানের খোঁজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। ইরান, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যেকোনো রাষ্ট্রেরই উচিত—আন্তর্জাতিক দায়িত্বশীলতা বজায় রেখে আলোচনার পথ খোলা রাখা। সহিংসতা, পাল্টা হামলা কিংবা হঠাৎ সামরিক পদক্ষেপ কখনোই দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বয়ে আনেনি।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এখন এমন একটি উদ্যোগের প্রয়োজন যা যুদ্ধের বিপরীতে সংলাপকে বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কূটনীতি, সহমর্মিতা এবং দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই শান্তির সন্ধান সম্ভব। রাষ্ট্রগুলোর উচিত হবে নিজেদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল বিশ্ব গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়া।

পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি আবার কার্যকর করা, অবিলম্বে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, গাজায় চলমান ইসরাইলের আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধ করা মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।

ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top