মঙ্গলবার, ১৫ই এপ্রিল ২০২৫, ২রা বৈশাখ ১৪৩২


ব্যাটারি রিকশায় ৩২ শতাংশ দুর্ঘটনা, বিকল্প যা হতে পারে


প্রকাশিত:
৯ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২২

আপডেট:
১৫ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:১৪

ছবি সংগৃহীত

আমরা আসলে জানি না আমাদের কী প্রয়োজন। এক সময় বাটন ফোন ছিল, আমরা তাতেই খুশি ছিলাম কিন্তু যখন স্মার্টফোন আসলো আমরা তাতেই অভ্যস্ত হলাম—হারিয়ে গেল বাটন ফোন, এমনকি বন্ধ হলো অনেক কোম্পানি।

মোবাইল ফোনের ক্যামেরার কারণে হারিয়ে গিয়েছে রিল ক্যামেরা আর হারাতে বসেছে ডিজিটাল ক্যামেরাও। এভাবে নতুন নতুন উদ্ভাবন মানুষের সামনে আসে আর আমরা ক্রমান্বয়ে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। এই যে পরিবর্তন এটা কিন্তু গ্রাহক চায়নি বরং আমাদের সামনে যখন উপস্থাপন করা হলো তখন আমরা জড়িয়ে গেলাম একটার পর একটা আয়েশি প্রক্রিয়ায়।

এ ঘটনা থেকে আমাদের একটা শিক্ষা নেওয়ার আছে আর তা হলো, কোনো একটা সিস্টেমকে দুইভাবে থামানো যায়, প্রথমত তা বন্ধ করে দিয়ে দ্বিতীয়ত তার চেয়ে ভালো কিছু নিয়ে এসে। আপনি কি খেয়াল করেছেন ঠিক এমন একটা ব্যাপার কিন্তু আমাদের সড়কে ঘটে যাচ্ছে।

ঢাকা শহরে এক সময় রিকশার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল কিন্তু ৬/৭ মাসে মহামারি আকারে ব্যাটারি রিকশা চলে আসাতে প্যাডেল রিকশার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে আর যাত্রীও কিন্তু রাস্তায় প্যাডেল রিকশার চেয়ে ব্যাটারি রিকশাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে। ঢাকা শহরে যানজট ও পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ হলো ব্যাটারিচালিত রিকশা। এগুলো বিদ্যুতের অপচয় করছে, যত্রতত্র সড়কে ঢুকে পড়ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে।

ব্যাটারি রিকশা এমনভাবে বাড়ছে যে, আমি প্রায় নিশ্চিত একে আর কেউ থামাতে পারবে না, থামাতে চাইবেও না। বর্তমান সরকার থামায়নি। এই নীরবতার সুযোগে এটা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আর রাজনৈতিক সরকারের ঘাড়ে এসে যখন এই দায়িত্ব পড়বে ততদিনে এর শেকড় চলে যাবে অনেকদূর।

ঈদের ছুটির চার দিনে দেশের ১০টি বড় সরকারি হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় আহত হন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের করা ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ঈদুল আজহায় সড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল মোটরসাইকেল; ৫১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এবার মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা প্রায় সমান।

এই রিকশাকেন্দ্রিক অনেক ধরনের ব্যবসা তৈরি হচ্ছে এবং হবে যার সাথে প্রভাবশালী অনেক মহলের স্বার্থ ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে। এখন সমস্যা হচ্ছে যদি জোর করে এদের বন্ধ করা হয় তাহলে তারা আন্দোলন করে রাস্তা বন্ধ করবে আর চলতে দিলে যানজট তৈরি করে রাস্তা বন্ধ করবে। তার মানে আমরা সাধারণ যাত্রীরা পড়ে গিয়েছি ব্যাটারিচালিত রিকশার গোলক ধাঁধায়।

তবে উপায় চাইলে এই গোলক ধাঁধাঁ থেকে বের হওয়া যাবে আর তা হলো মানুষের সামনে যদি আমরা ব্যাটারির রিকশা বা রিকশার চেয়ে ভালো, নিরাপদ, অন্য একটা মাধ্যম নিয়ে আসতে পারি। আর এমন একটি মাধ্যম যা ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত তা হলো বাইসাইকেল।

যে মানুষ ৫ থেকে ১০ কিমি যেতে রিকশা খোঁজে তাকে যদি একটা সাইকেলবান্ধব শহর দেওয়া যায় সে সাইকেলকে বেছে নেবে এটা প্রমাণিত, এমনকি আরও দূরের যাত্রায় সাইকেল হবে তার পছন্দের বাহন। অন্যদিকে, সাইকেল একটি পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত ও সাশ্রয়ী পরিবহন মাধ্যম। ঢাকাকে সাইকেলবান্ধব শহরে রূপান্তর করতে গেলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তবে এর সাথে কিছু সুবিধা, অসুবিধাও জড়িত।

প্রথমত, সাইকেলবান্ধব শহর গঠনে যে কাজগুলো করা দরকার তা হলো আলাদা সাইকেল লেন নির্মাণ। ঢাকার প্রধান সড়কগুলোয় আলাদা সাইকেল লেন তৈরি করতে হবে, যাতে সাইকেল আরোহীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারে। এটি দুর্ঘটনা কমাবে এবং সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত করবে।

দ্বিতীয়ত, সাইকেল পার্কিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। শপিং মল, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে সাইকেল পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে নিরাপদে সাইকেল রাখা যায়।

তৃতীয়ত, এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সাইকেলের সুবিধা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রচারণা চালাতে হবে। স্কুল-কলেজে সাইকেল চালানোর উপকারিতা নিয়ে সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।

চতুর্থত, সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। সাইকেল ক্রয়-বিক্রয় করমুক্ত করা বা সাশ্রয়ী মূল্যে সাইকেল বিতরণের মতো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, অফিসগামী মানুষকে সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ইনসেনটিভ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি রাতে সাইকেল চালানোর জন্য রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে সাইকেল আরোহীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সাইকেলবান্ধব এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে মানুষ ক্রমান্বয়ে এই নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাহনে শিফট করবে আর এতে করে রিকশা বা ব্যাটারি রিকশার ব্যবহার কমে যাবে। সাইকেলবান্ধব শহর তৈরির কাজটি কিন্তু কঠিন নয়। কারণ পৃথিবীর অনেক দেশ, এমনকি যারা গাড়ি আবিষ্কার করছে, গাড়ির বহুল উৎপাদন করছে, তারাও তাদের শহরকে গাড়ি মুক্ত করতে সাইকেলবান্ধব শহর নির্মাণ করছে।

ইউরোপের অনেক দেশ, যেমন নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইডেন, তাদের শহরগুলো সাইকেলবান্ধব করে গড়ে তুলেছে। সাইকেলকে তারা শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম হিসেবেই নয় বরং টেকসই নগর উন্নয়ন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে।

ইউরোপীয় শহরগুলোয় সাইকেল চালানোর জন্য পৃথক লেন, সাইকেল পার্কিং এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন, নেদারল্যান্ডসে প্রায় ৩৫,০০০ কিলোমিটার সাইকেল লেন রয়েছে, যা সাইকেল চালকদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। ডেনমার্ক (কোপেনহেগেন), ‘সাইকেল সুপার হাইওয়ে’ নির্মাণ করছে যা শহরতলিকে মূল শহরের সাথে সংযুক্ত করে।

জার্মানি (বার্লিন, মিউনিখ) এর প্রধান সড়কগুলোয় লাল রঙের সাইকেল লেন চিহ্নিত করা আছে, যা অন্য ট্রাফিক থেকে আলাদা। ইউরোপের অনেক শহর সাইকেলের জন্য উন্মুক্ত কিন্তু গাড়ি চলাচল সীমিত। তাদের সাইকেলের জন্য রয়েছে আলাদা ট্রাফিক লাইট আর অনেক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট (বাস, ট্রেন) এমনভাবে ডিজাইন করা যে চাইলে সাইকেল বহন করা যায়।

সেখানে সাইকেলের জন্য একদিকে যেমন ভর্তুকি দেওয়া হয় অন্যদিকে গাড়ির ওপর আরোপ করে উচ্চ কর। অনেকক্ষেত্রে সাইকেল আরোহীদের ইনস্যুরেন্স ফ্রি করা আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সেখানে শহরের মেয়র থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক সবাই সাইকেল চালায় যাতে অন্যরা মোটিভেশন পায়। ইত্যাদি অনেক পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেছে যার ফলে একসময় তাদের শহরেও আমাদের মতো যানজট থাকলেও এখন তা দেখা যায় না।

তবে সাইকেল চালানোর জন্য আমাদের দেশের আবহাওয়ার বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশেষ করে গরম বা বৃষ্টির সময়। তবে এই সমস্যা অন্য মোডেও অনুভূত হয়। ঢাকা শহরে অনেকের সাইকেল আছে এবং তারা নিয়মিত তা ব্যবহার করলেও অফিস বা অন্য কাজে যাওয়ার সময় ব্যবহার করে না কারণ সেখানে নিরাপদে রাখার জায়গা নেই আর রাস্তায় চলাচলের জায়গা নেই।

সাইকেল চালানোয় উৎসাহিত করার চেষ্টা যে একেবারে হয়নি তা নয়। কিছু সাইকেল লেন করা হয়েছিল আবার কিছু কোম্পানি সাইকেল শেয়ার সিস্টেমও চালু করেছিল। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হয়নি কারণ সেগুলো ছিল সামগ্রিক পরিকল্পনাহীন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

তাছাড়া সাইকেল চুরি ঠেকানো যাচ্ছিল না ফলে অনেক উদ্যোক্তারা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। সাইকেল চুরি রোধে জি পি এস ট্র্যাকার লাগানো যাবে কিন্তু সবচেয়ে বড় যে বিষয় তা হচ্ছে, সরকারকে সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার যদি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঠিক করে দেয় আমি নিশ্চিত অনেক বিনিয়োগ এই খাতে আসবে।

সরকার যদি বিভিন্ন দেশের উদাহরণকে অনুসরণ করে সাইকেলবান্ধব শহর নির্মাণ করে তখন এর ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে আর এতে করে রিকশা বা ব্যাটারির প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। এভাবেই এক সময় সব ধরনের রিকশা থেকে ধাপে ধাপে বিনা বল প্রয়োগে আমরা একটি স্বাস্থ্যকর বাহনে ট্রান্সফার হতে পারব, একটা স্বাস্থ্যবান সড়ক যেমন পাবো তেমনি পাবো স্বাস্থ্যবান নাগরিক।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top