বৃহঃস্পতিবার, ৮ই মে ২০২৫, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩২


ট্রাম্পের ১০০ দিন যেমন ছিল, ভবিষ্যৎ যেমন যাবে


প্রকাশিত:
৭ মে ২০২৫ ১০:৩৫

আপডেট:
৮ মে ২০২৫ ০৩:১৯

ছবি সংগৃহীত

ডোনাল্ড ট্রাম্প মসনদে প্রত্যাবর্তনের ১০০ দিন পার করেছেন নানা নাটকীয়তায়। আর সেই আনন্দে নেচে মাতালেন পুরো মার্কিন সাম্রাজ্যকে। পুরোপুরি ভিন্ন মেজাজে দেখা গেল এবার তাকে। এই যেন চির অচেনা ট্রাম্প। সতের দশকের বিখ্যাত মার্কিন ডিস্কো গ্রুপ ‘ভিলেজ পিপল’-এর ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হিট গান ‘ওয়াইএমসিএ’-র তালে তালে রীতিমতো কোমর দুলিয়ে মুগ্ধ করেছেন ভক্তদের। যদিও তার এই নাচের ভিডিওটি ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। কিন্তু এত সব সমালোচনাতেও যে ট্রাম্প খুব বেশি বিচলিত নন, তা প্রায় নিয়মিতই বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি। যা তার ‘পারফরম্যান্সে’ প্রমাণ মিলছে।

দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হতে না হতেই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন ট্রাম্প। পাশাপাশি শুরু করে দিয়েছেন ‘শুল্ক যুদ্ধ’ও। গোটা পৃথিবীতে তাকে নিয়ে চর্চার শেষ নেই। এমনকি, আমেরিকাতেই তার বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন বহু মানুষ। তোপ দেগেছেন ‘একনায়ক’ বলে। কিন্তু সেই সব সমালোচনা যে তাকে একটুও প্রভাবিত করেনি। বুঝিয়ে দিলেন, বিতর্ক-সমালোচনা-‘একনায়ক’ তোপ এসবের পরোয়া না করে ট্রাম্প রয়েছেন ট্রাম্পেই।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এবারের ক্ষমতায় ফিরে একের পর এক আদেশ জারি করেছেন। পরিষ্কার জানিয়েছেন, জন্মসূত্রে আর মিলবে না মার্কিন নাগরিকত্ব। যা নিয়ে আদালতের ভর্ৎসনার মুখেও পড়েছেন তিনি। চলছে মামলাও। এছাড়া একাধিক জায়গায় স্বাস্থ্যখাতে অনুদান বন্ধ করে দিয়েছেন। মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রেও কাটছাঁট করেছেন। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চমক নয়া শুল্কনীতি। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বিশ্ব বাণিজ্যে। ‘জেদি’ ট্রাম্পের এই সব পদক্ষেপেই বেজায় চটেছে বিরোধীরা।

কেবল বিরোধী নেতারাই নন, এই মাসের শুরুতেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকার রাজপথে নামে হাজারো মানুষের ঢল। নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলস থেকে হিউস্টন- সর্বত্রই একই দৃশ্য দেখা গেছে। দেড়শোরও বেশি সংগঠন ছিল এই বিক্ষোভ-মিছিলের নেতৃত্বে।

যার মধ্যে মানবাধিকার সংগঠন যেমন ছিল, তেমনই ছিল আন্দোলনকারী, শ্রমিক ইউনিয়ন ইত্যাদি। সবারই দাবি, ‘আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হারাচ্ছি।’ তাদের গর্জন, ‘ট্রাম্প একজন বদ্ধ উন্মাদ। উনি আমাদের বিশ্বব্যাপী মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।’

ট্রাম্পের ১০০ দিন কেমন ছিল? তা নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই। এর উত্তর হয়তো এক বাক্যে দেওয়াও মুশকিল। ভবিষ্যৎ হয়তো এর যথার্থ উত্তর দিতে পারবে। এবারে তার শাসনামলে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক।

বিনোদন জগতে শুল্ক আরোপ:

শুল্ক আর শুল্ক! দ্বিতীয়বার আমেরিকার ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের লক্ষ্য এখন শুধুই অন্যের ওপর শুল্কের বোঝা চাপানো। এবার তার এই খামখেয়ালিপনায় বিপদের মুখে পড়তে চলেছেন বিনোদন জগতও। আমেরিকার বাইরে প্রযোজিত যেকোনো সিনেমা মুক্তিতে এবার ১০০ শতাংশ কর দিতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান বন্ধ:

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যা আনুমানিক ২২০ কোটি ডলারের মতো। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রশাসনের একাধিক দপ্তরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ। যদিও এসব মাথায় না নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আবার ঘোষণা দিলেন, শুধু অনুদান বন্ধ নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের করছাড়ের মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। অর্থাৎ এবার থেকে অবশ্যই কর দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।

সম্প্রসারণবাদী বক্তব্য:

গ্রিনল্যান্ড দ্বীপ ও পানামা খাল কিনতে চেয়েও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি ক্ষমতায় বসার আগে থেকেই কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য করার আশা ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্পের এই সম্প্রসারণবাদী বক্তব্যেও বিশ্বে ওয়াশিংটনের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে। ট্রাম্পের আসল চেহারা সামনে আসতেই জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতি:

ক্ষমতায় বসার পর যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছেন ট্রাম্প। সিএনএনের তথ্য থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কর্মচারী বরখাস্ত করেছে তার প্রশাসন।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে অপসারণ:

সিগনাল গ্রুপ চ্যাট কেলেঙ্কারিতে আলোচিত মাইক ওয়াল্টজকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে আপাতত সেই দায়িত্ব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য তিনি ওয়াল্টজকে একেবারে বিদায় করে দেননি। তাকে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করার কথা জানিয়েছেন।

বেফাঁস মন্তব্য :

ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের মধ্যে গাজা ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে সেখানে বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার কথাও বলেছেন। ট্রাম্পের এই নাটকীয়ভাবে অবস্থান বদলানো ও বেফাঁস মন্তব্যে অবাক হয়েছে পুরো বিশ্ব।

টালমাটাল মার্কিন অর্থনৈতিক ভিত্তি:

কেবল ইলন মাস্কের ক্ষেত্রেই নয়, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের ১০০তম দিন পার হতে না হতেই অনেক বিলিয়নিয়ারের জন্যই মলিন সংবাদ তৈরি হয়েছে। তাদের সম্পদের পরিমাণ অবিশ্বাস্যভাবে পতন হয়েছে। অনেকে আবার হারিয়েছে ধনকুবের তকমা। তার ওপরে ৫০ বছরের মধ্যে মার্কিন শেয়ারবাজারে সবচেয়ে খারাপ সূচনা দেখেছে বিশ্ব। শুল্কযুদ্ধের কারণে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ ও ডাউ জোন্স উভয় সূচক প্রায় ৮ শতাংশ পড়ে গেছে।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি:

ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি মিত্রদের দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং প্রতিপক্ষদের সাহস জুগিয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে নেটো মিত্রদের উপেক্ষা করে রাশিয়ার বক্তব্যকেই সমর্থন দিয়েছে।

ট্রাম্পের পোপ হওয়ার শখ:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্যাথলিক ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি পোপ হতে চাই।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই নিয়ে বেশ হাসির রোলও পড়ে গেছে। অধিকাংশের দাবি ট্রাম্প আন্তরিকভাবে এই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেননি বরং রসিকতার ছলেই এই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন।

পেঙ্গুইনের দ্বীপে শুল্ক:

অ্যান্টার্কটিকার কাছে বরফে ঢাকা, জনশূন্য আগ্নেয়গিরিময় দ্বীপগুলোর উপরও আরোপ হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের কোপ। এসব দ্বীপে বসবাস করে কেবল পেঙ্গুইন। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অপরিপক্কের মতো এসব দ্বীপের উপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন।

বাংলাদেশের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক:

বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার বিগত ১০০ দিনের সম্পর্ক আগে যা ছিল, এখনো তাই আছে। পররাষ্ট্রনীতির তেমন কোনো পার্থক্য ঘটেনি। ভবিষ্যতে হবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের পণ্যের উপর নতুন শুল্ক আরোপে নতুন সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে তুলসী গ্যাবার্ডের বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যে সম্পর্কের উষ্ণতায় কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলছে।

এতকিছুর মাঝে ট্রাম্প অবশ্য তার কঠোর অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে আসতে দেখা গেছে। যেমন শুল্ক আরোপের সময়সূচি ও মাত্রা। তবে এটা ঠিক ট্রাম্পের নাটকীয়ভাবে অবস্থান বদলানোর সম্ভাবনা খুব কম। এমনকি, তৃতীয় দফার জন্য নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখার ইচ্ছাও যে তার রয়েছে সেটাও অস্বীকার করেননি তিনি।

যদিও দু’বারের বেশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। তবু আইনে বদল এনে এটা করা যায়, এমন ইঙ্গিতও দিতে দেখা গেছে এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতাকে। হয়তো এটা সম্ভবও হতে পারে শুধু ট্রাম্প বলেই। বিগত ১০০ দিনের খতিয়ান যেমন ছিল হুমকি ও আতঙ্কের বক্তব্য তেমনি আছে আগামী ১০০ দিন কেমন যাবে তার ও ইঙ্গিত। পরিশেষে আমাদের চাওয়া, বিশ্ব নিরাপদ ও সবার বসবাসের উপযোগী হোক।

প্রশান্ত কুমার শীল ।। শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top