রবিবার, ১লা জুন ২০২৫, ১৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


শিশু শিক্ষা ও বাজেটের গুরুত্ব


প্রকাশিত:
৩১ মে ২০২৫ ১১:২৭

আপডেট:
১ জুন ২০২৫ ২১:৫৫

ছবি সংগৃহীত

গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা গেছে ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য গত বছরের তুলনায় কম অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি আছে। সেটা বাজেটের প্রস্তাব পাস হওয়ার পর আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।

বাজেটের বড় একটা অংশ আসে মানুষের কর থেকে। কাজেই সুচিন্তিত বাজেট যাবে সাধারণের পক্ষে। আর যদি ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে এর বড় চাপ এসে পড়বে সাধারণের উপরেই।

আমার মনে পড়ে শৈশবে পরীক্ষায় রচনা, বাগধারা আসলে ক্ষেত্র বিশেষে প্রায়ই লিখতাম, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। সত্যি বলছি সে সময় এতটুকু বুঝিনি যে শিক্ষাকে বিশেষভাবে মেরুদণ্ড বলার কারণ কী বরং এটা খুব ভালো মাথায় ঢুকেছিল যে, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। শিক্ষার গুরুত্ব তখনো ছিল এবং এখনো আছে তবে ঠিক অন্যভাবে এবং অন্য অর্থে।

বিংশ শতাব্দীর শিক্ষা, জ্ঞান মূলত ছিল শিল্প কাজের জন্য প্রস্তুতির উপরে নির্ভরশীল। লক্ষ্য ছিল কারখানা, অফিস এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কর্মী তৈরি করা। একুশ শতকের কেন্দ্রে রয়েছে টেকনোলজি। চারপাশের সব কিছু দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। একটা স্কিল দিয়ে আর চাকরি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক রকমের কাজ একসাথে করার দক্ষতা এখন ‘মার্কেট ডিমান্ড’!

এ অবস্থায় বাজেটে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন ক্ষেত্রে বরাদ্দ রাখার সময় যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। বেশিরভাগ উন্নত দেশ শিক্ষায় জিডিপির ৪-৭ শতাংশ এবং গবেষণা ও প্রযুক্তিতে ২-৫ শতাংশ বরাদ্দ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষায় জিডিপির ২.৫ শতাংশ এর কম এবং গবেষণা ও প্রযুক্তিতে ০.৫শতাংশ এর কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

উদ্ভাবনে উৎকর্ষ অর্জনকারী দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। যদি সেটা না হয় তাহলে স্বল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দক্ষতার অভাব আধুনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বেকারত্ব বাড়বে, উৎপাদনশীলতায় প্রভাব পড়বে। উদ্ভাবন দক্ষতা কমে যাবে। বিশ্বব্যাপী বৈষম্য বাড়বে এবং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ব্রেইন ড্রেইন বৃদ্ধি পাবে।

দেশ স্বাধীনের পর, বাংলাদেশের প্রথম বাজেট (৭৮৬ কোটি) পেশ করেন তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৭২ সালে। ১৯৭৫-৭৬ সালে সেই বাজেট বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় ১৫,৪৯০,০০০,০০০ কোটিতে। ১৯৮৭-৮৮ সালে বাজেট পেশ হয় ৮৫,২৭০,০০০,০০০ কোটি টাকার। ২০২৪-২৫ সালের বাজেট পেশ হয় ৭,৯৭০,০০০,০০০ কোটি টাকার। এখন আমরা তাকিয়ে আছি ২০২৫-২৬ সালের বাজেট এর দিকে।

১৯৭২ সালে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের হিস্যা ছিল ২২ শতাংশ। ২০২১-২০২৪ সালে শিক্ষায় জিডিপির ২.০৯ বরাদ্দ দেওয়া হয়, ২০২২-২৩ সালে জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ সালে জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দেখা যায় শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ অনেক কম! বরাদ্দ কম হলে কি হয় তা সামগ্রিকভাবে উপরে উল্লেখ করেছি। কিন্তু কেবলমাত্র যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখি তাহলে কী পাই?

১) শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে:

শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। বড় শ্রেণিকক্ষের তুলনায় অপ্রতুল শিক্ষক, একই সাথে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, সত্যিকার অর্থে কারিকুলামে সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা ও সৃজনশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে যেসব শিক্ষকদের একাধিক শ্রেণির ক্লাস নিতে হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে!

২) দুর্বল শিক্ষার ফলাফল:

বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে সাক্ষরতা, সংখ্যাজ্ঞান, পঠন ও বোঝার দক্ষতা, লেখার দক্ষতা ‘নিম্ন স্তরের’। দেখা যায় যে শিক্ষার্থীরা মৌলিক দক্ষতা অর্জন ছাড়াই প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পঞ্চম শ্রেণির শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণির একটা সাধারণ বাংলা পাঠও পড়তে পারে না বা গণিতের খুব সাধারণ সমস্যার সমাধান করতে পারে না!

৩) শৈশব এর শিক্ষায় কম বরাদ্দ:

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এখনো উন্নত এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। একই সাথে শিক্ষকদের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও উপযুক্ত শিখন উপকরণের অনেক অভাব। একটা ফলাফল খুব স্পষ্টভাবে আমরা দেখি যে শিক্ষার্থীরা কম বা কোনো রকমের প্রস্তুতি ছাড়াই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবেশ করে।

৪) অপর্যাপ্ত অবকাঠামো:

কোভিডের সময়ের কথা আমরা মনে করতে পারি। এ সময়টায় আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালু রাখা চ্যালেঞ্জিং ছিল! কারণ ঠিকঠাক অনলাইন শিক্ষা সবার জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

৫) কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অবহেলা:

একটা উদাহরণ দেওয়া যায়; পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি এবং নির্মাণের মতো খাতে ক্রমবর্ধমান চাহিদা সত্ত্বেও, মাত্র ১-২ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে!

৬) ঝরে পড়ার হার:

মাধ্যমিক পর্যায়ে এখনো ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য এবং বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার বেশি।

STEM (সায়েন্স, টেকনোলোজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত) এখনো এ দেশে ঠিকঠাক প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। যখনই বাংলাদেশে নতুন কোনো কারিকুলামের পরিকল্পনায় আসে তখন প্রধানতম ভাবনা এটাই হয় যে, আমাদের টেকনোলজিক্যাল তেমন প্রস্তুতি নেই! কিন্তু টেকনোলজিক্যাল প্রস্তুতি নিশ্চিত করে তারপর কারিকুলাম তৈরি করার ভাবনা কারও মাথায় আসে না!

শিক্ষার্থীরা বাস্তব বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে কি চিন্তা করার সুযোগ পায়? সুযোগ পায় সেগুলো হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখার বা সমাধান নিয়ে চিন্তা করার? কেবল পাঠ্য বইয়ের উপরে ভিত্তি করেই চলছে শিক্ষাব্যবস্থা! ফলাফলের বাইরে বেরিয়ে পৃথিবীকে দেখার, শেখার, বোঝার আধুনিক সব প্রস্তুতির সেখানে বড় অভাব!

৮) নিম্ন বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিং এবং এসডিজি:

নিম্ন বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিং-এর খবর গণমাধ্যমে আসে। আমরা দেখি, পড়ি। চুরি বিদ্যার মাধ্যমে গবেষণাপত্র প্রকাশের খবরও আসে। পেছনের দরজা দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার খবরও প্রকাশিত হয়! গবেষণা ক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ এতটাই কম যে গবেষণাকে খুব যেনতেন ভাবে দেখিয়েই সবাই গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে ফেলতে পারে!

এটা স্পষ্ট যে বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ কম। অনেক কম! বাজেটে গবেষণা, সৃজনশীলতা, নতুন কিছু আবিষ্কার, STEM একেবারেই পাত্তা পায় না! সামনে আসছে এআই এর যুগ! এআই নিয়ে চারপাশে অনেক কথা হচ্ছে কিন্তু এআই-কে স্বাগতম জানানোর আগে আমাদের পূর্বের প্রস্তুতিগুলো কিন্তু বেশ দুর্বল!

আমাদের স্কুল, কলেজগুলোয় যদি দেখি, সব প্রতিষ্ঠানেই কি মানসম্মত ল্যাবরেটরি আছে? আবার ল্যাব থাকলেও যে প্রশিক্ষিত শিক্ষক কি আছে?

একটু অন্যভাবে ভাবি:

দেশে মানুষের নানা রকমের পেশার আগ্রহকে স্বাগত জানানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। যে যা চায় তাই হতে পারার সুযোগ বিশেষ করে গবেষণার সুযোগ যদি না দেওয়া হয় তাহলে পাস করে সবাই প্রবাসে থেকে গবেষণা করবে এটাই স্বাভাবিক। একই সাথে রাজনৈতিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপরে যদি চলমান সরকারের মতাদর্শের আধিপত্য স্পষ্ট থাকে তাহলে আর যাই হোক পড়া হবে, লেখাও হবে কিন্তু শেখা হবে না! বাজেট বাস্তবায়ন করাও সম্ভব হবে না।

বাজেট একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। পেশ করা সহজ কিন্তু অর্জন করা কঠিন! এটা আরও কঠিন হয় যখন ‘উন্নত হতে হবে’, ‘বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে হবে’ বলে গান বাজতে থাকে কিন্তু সেই বাজনার সাথে মিলিয়ে প্রয়োগ করার মতো অর্থ বরাদ্দ রাখা না হয়! কাজেই ‘আমাদের হতে হবে’ এই পুরোনো গান বন্ধ রাখি।

ফারহানা মান্নান ।। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top