রবিবার, ৮ই জুন ২০২৫, ২৫শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


চলচ্চিত্রের তিন জানালা, দুটি বন্ধ প্রায়


প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২৫ ১২:০৪

আপডেট:
৮ জুন ২০২৫ ১৫:৫৭

ছবি সংগৃহীত

বর্তমান বিশ্বে চলচ্চিত্র দেখার মূলত তিনটি বৈধ উপায় রয়েছে—প্রেক্ষাগৃহ, ওটিটি প্লাটফর্ম ও টেলিভিশন। বাংলাদেশের মানুষও এই তিন বৃত্তের বাসিন্দা হয়েছে বহুদিন হলো। ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো প্রথমে দেখানো হচ্ছে সিনেমাহলে, এরপর সেসব ছবি যাচ্ছে ওটিটি প্লাটফর্ম ও পর্যায়ক্রমে টেলিভিশনে। এখন প্রশ্ন হলো চলচ্চিত্র দেখার জন্য এই তিন মাধ্যমের মধ্যে কোনটিকে দর্শক বেশি পছন্দ করছে, বা উপযোগী মনে করছে?

সারা দুনিয়ার সাথে তুলনা করলে হবে না, বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিঞ্চিত ভিন্ন। কারণ যত দিন যাচ্ছে ঢাকা ততই ‘নরকে’ পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ এখানে মানুষ স্বাভাবিক ও জরুরি কাজটিই করতে পারে না ঠিক সময়ে। কারণ ঢাকা এখন ‘আন্দোলন ও অবরোধের নগরী’। যেকোনো সময়ে যেকোনো চৌরাস্তা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে, প্রশাসন অসহায়।

মানুষ তারচেয়েও বেশি অসহায় ও দুর্ভাগা। যেখানে মানুষ তার অতি জরুরি কাজই করতে পারছে না যথা সময়ের মধ্যে, সেখানে কি সে দুই আড়াই ঘণ্টার চলচ্চিত্র দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যাবে? যানজটের কারণে অতিরিক্ত আরও তিন ঘণ্টা খরচ করে? পুরো একটা বেলাই তো নাই হয়ে গেল তাহলে। সমাধান হতে পারে মেট্রোরেল।

প্রথম কথা, সেটি তো কেবল উত্তর-দক্ষিণে রয়েছে, তাছাড়া, সেখানেও ইদানীং দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হচ্ছে। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে টিকিট ব্যবস্থাপনা আর শুরুর দিককার মতো কাজ করছে না। বলা যেতে পারে, যে লাউ সেই কদু। যেহেতু প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখা শুধুমাত্র দর্শকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, তাই বর্তমান পরিস্থিতির কারণে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখার আগ্রহে ভাটা পড়েছে।

ঈদ, পূজা বা যেকোনো উৎসবের সময়টা শুধু রাজধানী ঢাকা নিঃশ্বাস নিতে পারে। তাই মানুষও বিনোদনের জন্য সিনেমাহলে যায় এবং এই সময়টাতে, উৎসবভাতা পাওয়াতে, লোকজনের হাতে কিছুটা অর্থ থাকে বিনোদনের পেছনে খরচ করার জন্য। নয় তো দ্রব্যমূল্যের যা অবস্থা, কষ্ট করে উপার্জিত টাকা তারা সহজে সিনেমা দেখার কাজে ব্যয় করতে চায় না।

মূল কথা, উৎসবে অর্থ ও রাস্তাঘাট দুটোর অবস্থাই ভালো থাকে। তাই মানুষ ছবি দেখে। বাংলাদেশের দর্শককে কিন্তু একটা বিষয়ে বাহবা দিতেই হয়, চলচ্চিত্রের গল্প মোটামুটি ধরনের হলে, একটু গিমিক থাকলে, তারা সিঙ্গেল ও মাল্টিস্ক্রিনে ভিড় করে।

তবে সামনের দিনগুলোয় এই প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা আরও কমে আসবে। উৎসবকেন্দ্রিক দেশি চলচ্চিত্র ও হলিউড থেকে আমদানিকৃত ‘টেন্টপোল ফিল্ম’ ছাড়া সিঙ্গেল ও মাল্টিস্ক্রিনের কোনো গতি নেই। টেন্টপোল ফিল্ম বলতে বড় বাজেট, বড় তারকা, সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজি, জনগণের মনে আগ্রহ জাগানিয়া ছবি।

সুপারহিরো দিয়ে আর কত? সেটি দিয়ে এখন আর মানুষকে খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারছে না তারা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে পরিচালক এনে নতুন ধরনের, নতুন গল্পের ছবি বানানোর চেষ্টা করছে হলিউড। তাতেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক বং জুন-হো (Bong Joon Ho)-কে দিয়ে ‘মাইকি সেভেনটিন (Mickey 17)’ বানালো, খুব কি ব্যবসা করেছে? করেনি।

অপরদিকে, যে টেলিভিশন একসময় প্রেক্ষাগৃহের হুমকি হয়ে উঠেছিল, সেই টিভি এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে ব্যাপক কোণঠাসা হয়ে আছে। বর্তমানে খেলাধুলা ও ঘটনা-দুর্ঘটনার লাইভ প্রচার করা ছাড়া আর কোনো গুরুত্ব নেই টেলিভিশনের। কারণ গতানুগতিক টিভি চ্যানেলগুলোর কন্টেন্ট মানুষ যতটা না ঘরে রাখা টিভিতে দেখছে, তারচেয়ে বেশি দেখছে ইউটিউব ও ফেসবুকে।

এমন পরিস্থিতিতে টিভি চ্যানেলগুলো এত বড় সেটআপ নিয়ে থাকবে কি না, নাকি নিউ মিডিয়ার মতো কম খরচে কাজ করতে শুরু করবে, তার হিসাবনিকাশ আসলে দশ বছরের ভেতরেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার ধারণা, পাঁচ বছরের ভেতরেই দেখা যাবে, টিভি শুধু কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে, ‘খাদ্য’ সরবরাহ করে যাচ্ছে সামাজিকমাধ্যমগুলো। টিভি চ্যানেল খোলা আর শ্বেতহস্তী পালা সমার্থক হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে।

টিভি চ্যানেলের তুলনায় বরং আপাতদৃষ্টিতে ওটিটি প্লাটফর্ম অনেক বেশি লাভজনক। যদিও এই পরিসরেও কম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই নেই। স্থানীয় ওটিটিগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ আরও কয়েকগুণ বেশি। তাদের নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, ডিজনি ইত্যাদি ভিনদেশি ওটিটির সাথে তো লড়তে হচ্ছেই, পাশাপাশি বাংলা ভাষায় কন্টেন্ট তৈরি করে এমন ভারতীয় ওটিটির সাথেও টেক্কা দিতে হচ্ছে। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হলো, বাংলাদেশে যারা নামকরা তারকা, তাদের কাস্ট করা হচ্ছে ভারতীয় বাংলা কন্টেন্ট বানানো ওটিটি প্লাটফর্মগুলোর প্রোডাকশনে।

দেশি ওভার-দ্য টপ (ওটিটি মিডিয়া সার্ভিস-ওটিটি) প্ল্যাটফর্মের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে ২০২৫-২০২৬ সালের বাজেট। এই বাজেটে ওভার-দ্য টপ (ওটিটি মিডিয়া সার্ভিস-ওটিটি) প্ল্যাটফর্ম পরিষেবাগুলোয় ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অতএব, ওটিটি ব্যবহারকারীদের পরিষেবা ব্যয় বাড়ছে। এমনিতেই মানুষজন ইন্টারনেটে টাকা দিয়ে ছবি দেখতে চায় না, বাংলাদেশে পাইরেসি করেই লোকজন ছবি দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেখানে যদি এক, দুই, তিন নয়, একেবারে দশ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে ব্যবহারকারীদের অনেকটা বাড়তি টাকা গুণতে হবে সাবস্ক্রিপশনে। প্রশ্ন হলো, যা চোরাই বাজারে ফ্রি পাওয়া যায়, তা লোকে এতদিন যাও বৈধ উপায়ে কিনে নিয়ে দেখত, খরচ বেড়ে যাওয়াতে সেটি কি আর কিনে দেখবে?

ওটিটি ভিত্তিক কন্টেন্টগুলো এমনিতেই একঘেয়ে ধাঁচের, মানে থ্রিলার-ভায়োলেন্স-সেক্স ইত্যাদি দিয়ে ঠাসা। এসব মশলা দেশি কন্টেন্টে মেশানো হলেও, আরও বিচিত্র উপায়ে, বেশি বেশি করে সেসব উপস্থাপনের জন্য আমাদের ভালো নির্মাতা নেই। হাতেগোনা কয়েকজনই কাজ করছে। কাজেই এখানেও বড় সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। নিজেদের মতো করে গল্প বলার স্বাধীনতা ওটিটিতে ধীরে ধীরে অনেক কমে এসেছে, যেহেতু প্রতিযোগিতা ভীষণরকম, সবাই চায় নিশ্চিত ব্যবসা। এর ভেতর যদি শুল্ককর দশ শতাংশ বাড়ে, সেটি ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’ বৈ আর কী?

যে হারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে বা দেশি দর্শক যেভাবে হলিউড ও বলিউডের মতো প্রোডাকশন দেখতে চায় দেশের ইন্ডাস্ট্রির কাছ থেকে, তার সাথে আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা কুলিয়ে উঠতে পারবেন না, স্বাভাবিক। এমন অসম প্রতিযোগিতার ভেতর যেখানে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন দেশি চলচ্চিত্র বা দৃশ্যমাধ্যম কারখানার মানুষেরা, সেটা সরকারকে অনুধাবন করতে হবে।

ঘরে ঘরে এখন স্মার্ট টিভি, লোকে টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান না দেখলেও, স্মার্ট টিভিতে ওটিটি প্লাটফর্মের কন্টেন্ট দেখা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি ইতিবাচক দিক। যেকোনো সংস্কৃতিবান্ধব ও চলচ্চিত্রের ব্যাপারে সিরিয়াস সরকার এই ইতিবাচক দিকটি উৎসাহ দেবে।

সবশেষে এটাই বলব, চলচ্চিত্র এমন এক শিল্পমাধ্যম, মানুষের কাছে আসবেই। শত বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে হলেও বড় পর্দার সামনে সে বসবে একটি চমৎকার গল্প দেখবে বলে। চলচ্চিত্রের সাথে বড় পর্দার ঐতিহ্য জড়িয়ে, মানুষ বড় পর্দাতেই ছবি দেখতে চায়, কিন্তু বাস্তবতা তাদের বাধ্য করছে বলেই ওটিটির দিকে ধাবিত হচ্ছে তারা।

মানে বিষয়টি আরেকভাবে দেখলে দাঁড়ায়—প্রেক্ষাগৃহ ও টিভি সময় ধরে ছবি দেখায়, কিন্তু তাদের সাথে ঘড়ি মিলিয়ে নেওয়ার দায় অতটা আর অনুভব করছে না দর্শক। তারা এখন স্বাধীন। তাই ওই দুটির তুলনায় ওটিটির সম্ভাবনা অনেক বেশি। সম্ভাবনা বেশি বলেই, একে বেড়ে ওঠার পরিবেশ করে দিতে হবে। কিন্তু আমরা সবসময়ই দেখি উল্টোটা, যেখানেই সম্ভাবনা, সেখানেই করের বোঝা চাপিয়ে গোটা বিষয়টি গলা টিপে হত্যার তোড়জোড় শুরু হয়। এটা সত্যি দুঃখজনক।

বিধান রিবেরু ।। চলচ্চিত্র গবেষক ও শিক্ষক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top