বৃহঃস্পতিবার, ১২ই জুন ২০২৫, ২৯শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস, আমাদের ঝুঁকি কতখানি?


প্রকাশিত:
১১ জুন ২০২৫ ১০:৪১

আপডেট:
১২ জুন ২০২৫ ২০:৪২

ছবি সংগৃহীত

রাহুল, একজন স্কুলশিক্ষক। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ হাঁচির শব্দে পেছন ফিরে তাকায়—তার ছোট মেয়ে তানি কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তাপমাত্রা একটু বেশি। ‘এত ঠান্ডা লাগলো কী করে?’ রাহুল জিজ্ঞাসা করল।

‘স্কুলে অনেকেই সর্দি-কাশি নিয়ে এসেছিল বাবা। ক্লাসেও মাস্ক পরেনি কেউ।’

রাহুলের বুকের মধ্যে কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো।

সেদিন রাতেই খবরের ভেসে উঠে—‘নতুন রূপে আবার ফিরে এসেছে করোনাভাইরাস। ঢাকা শহরের বেশ কিছু এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। কিছু রূপ আগের চেয়ে বেশি সংক্রামক হলেও উপসর্গ মৃদু।’

রাহুলের স্মৃতিতে ফিরে এলো ২০২০ সালের দিনগুলো। লকডাউন, বাজারের দীর্ঘ লাইন, পিপিই কিটে ঢেকে থাকা ডাক্তাররা, অক্সিজেনের অভাব—সবকিছু যেন দুঃস্বপ্নের মতো। তবে এবারের করোনা আগের মতো হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ছে না, বরং নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে, চুপিসারে ছড়িয়ে পড়ছে। যেন ছায়া।

পরদিন সকালেই তানি’র করোনা পরীক্ষা করানো হলো। রিপোর্ট পজিটিভ। রাহুল জানে, এখন ভয় না পেয়ে সচেতন হতে হবে। তানির স্কুলে ফোন করে জানাল, আবার যেন সবাইকে মাস্ক পরতে বলা হয় এবং যারা সর্দি-কাশি হয়েছে তারা যেন বাসায় থাকে।

এরপর সে নিজেই একটা ছোট পোস্টার বানিয়ে স্কুলের গেটের সামনে লাগিয়ে দিলো:

‘করোনা আবার ফিরছে, কিন্তু আমরা প্রস্তুত। মাস্ক পরুন, দূরত্ব বজায় রাখুন। নিজেকে আর আশেপাশের মানুষকে নিরাপদ রাখুন।’

গল্পটা ছোট, কিন্তু বাস্তব। কারণ, করোনা নামক ছায়াটা আবারও ঘনিয়ে আসছে। আমরা যদি আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার সতর্ক থাকি—তবে আগামীর ছায়া থেকে নিজেকে আর আমাদের সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব।

অন্যান্য ভাইরাসের মতোই করোনাভাইরাস মিউটেশন করে প্রতিনিয়ত তার রূপ পাল্টাচ্ছে। আর এর ফলে নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্প্রতি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) NB.1.8.1 নামক একটি নতুন কোভিড ভেরিয়েন্টকে ‘ভেরিয়েন্ট আন্ডার মনিটরিং’ (VUM) হিসেবে ঘোষণা করেছে।

NB.1.8.1 (কোড নাম ‘Nimbus’) হলো অমিক্রন সাবভেরিয়েন্ট JN.1-এর পরবর্তী বা উপধরন নতুন রূপ। প্রথমে চীনের কিছু অঞ্চলে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও বর্তমানে এটি সারা বিশ্বে তার উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। VUM মানেই যে মারাত্মক বা খুব বিপজ্জনক এমনটা নয় বরং এটি WHO -র ‘ওয়াচলিস্ট’ বা পর্যবেক্ষণ ক্যাটাগরি। এর সম্ভাব্য সংক্রমণ ক্ষমতা, রোগলক্ষণ, রোগের তীব্রতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন।

তবে এখনো পর্যন্ত NB.1.8.1 ভেরিয়েন্ট অন্যান্য অমিক্রন স্ট্রেনের তুলনায় মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও কিছু দেশে এই ভেরিয়েন্টের সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব।

এটা প্রথম শনাক্ত হয় ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে। বর্তমানে ২০টিরও বেশি দেশে শনাক্ত (UK, USA, China, India, Thailand এবং অন্যান্য) শনাক্ত হয়েছে।

এই ভেরিয়েন্ট অত্যন্ত সংক্রামক, দ্রুত ছড়াচ্ছে কারণ গবেষণা বলছে, এটি মানুষের ACE2 রিসেপ্টরের সাথে শক্তভাবে যুক্ত হতে পারে বলেই যথেষ্ট সংক্রমণ বাড়াতে সক্ষম। বেশি সংক্রামক হলেও এখন পর্যন্ত গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুর হার বেশি বলে জানা যায়নি।

ভেরিয়েন্ট নতুন হলেও কোভিডের আগের মতোই সাধারণ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এবারও। গলা ব্যথা, জ্বর, ক্লান্তি, কাশি, শরীর ব্যথা। এর সাথে কারও কারও বমি, ডায়রিয়া বা হজমজনিত সমস্যাও দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ এবং আশেপাশের দেশগুলোয় অমিক্রনের কয়েকটা সাব-ভেরিয়েন্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

JN.1—BA.2.86 থেকে উদ্ভূত, শক্তিশালী সংক্রমণ ক্ষমতা আছে। হালকা থেকে মাঝারি জ্বর, সর্দি, নাক বন্ধ, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, অতিরিক্ত ক্লান্তি ও হজম সমস্যা দেখা যায়।

XFG, XFC, LF.7—এগুলোও JN.1-এর উপধরন শ্রেণির সাব-ভেরিয়েন্ট যা বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে XFG ও XFC বেশি সংক্রমণ ক্ষমতা যুক্ত।

বাংলাদেশেও আইসিডিডিআরবি এবং আইইডিসিয়ার এর গবেষকেরা করোনার নতুন ধরন শনাক্তের কথা বলছেন। এর নাম এক্সএফজি। এর পাশাপাশি এক্সএফসি ধরনটিও পাওয়া গেছে। দুটোই করোনার শক্তিশালী ধরন অমিক্রনের জেএন-১ ভেরিয়েন্টের উপধরন। তবে নতুন এ ধরন নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যেকোনো ভাইরাসের ধরন পরিবর্তন হয় দ্রুত। তারাও বলছেন, সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। আগের মতোই সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক সতর্কতা জোরদার করা হচ্ছে। বেনাপোলে স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং চেকপোস্ট পুনঃসক্রিয় করা হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া ভারতে না যাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। কারণ করোনা বাড়ছে ভারতে।

করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে আগের মতোই কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

—টিকা ও বুস্টার: আপনার সর্বশেষ টিকার ডোজ নিয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত করুন।

—জনসমাগমে মাস্ক পরিধান করুন।

—হাত ধোয়া ও জীবাণুমুক্ত হাত নিশ্চিত করুন। এক্ষেত্রে সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।

—হাত না ধুয়ে চোখ-নাক-মুখে হাত দেবেন না।

—কারও রোগলক্ষণ দেখা দিলে ৩ ফিট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।

—উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত কোভিড টেস্ট করুন। ১–২ দিন বাড়তেই আইসোলেশনে বাড়িতেই থাকুন।

—জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল এবং ঠান্ডা-কাশির জন্য এন্টিহিষ্টামিন জাতীয় ওষুধ বাড়িতেই খাওয়া যাবে।

—তবে বেশি বয়স্ক বা যাদের ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, এইডস, কিডনি বা লিভারের সমস্যা এবং যারা আগে থেকেই দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন তাদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।

—বেশি অসুস্থ হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।

রোগনির্ণয়ের জন্য আগের মতোই এবারেও প্রথমে RT PCR বা Rapid Antigen টেস্টের মাধ্যমে সক্রিয় কোভিড ১৯ পজিটিভ রোগীদের থেকে নাসোফ্যারিঞ্জিয়াল সোয়াব বা গলা–নাকের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন আসছে আগের টিকা কি নতুন করোনার ভেরিয়েন্টকে প্রতিরোধ করতে পারবে? বা পারলে কতটুকু? নতুন করোনা ভেরিয়েন্ট NB.1.8.1 বা JN.1-এর মতো উপধরনীর বিরুদ্ধে আগের টিকা (যেমন ফাইজার, মডার্না, সিনোফার্ম, অ্যাস্ট্রাজেনেকা) অনেকটাই কার্যকর।

WHO বলছে, পুরোনো টিকা (Original COVID Vaccines) মূল টিকাগুলো তৈরি হয়েছিল ২০২০-২১ সালের মূল ভাইরাস স্ট্রেইনের জন্য। এরপরের বুস্টার ডোজ (especially Omicron-adapted bivalent boosters) অমিক্রনের বিভিন্ন ভেরিয়েন্ট (BA.4/BA.5) লক্ষ্য করে তৈরি।

NB.1.8.1 ও JN.1-এর মতো নতুন ভেরিয়েন্টগুলোয় অনেক স্পাইক মিউটেশন দেখা যাচ্ছে, যা ভাইরাসটি ইমিউন সিস্টেম থেকে আড়াল করতে কিছুটা সহায়তা করে। তবে গবেষণা বলছে, আগের টিকা সম্পূর্ণভাবে সংক্রমণ রোধ করতে না পারলেও গুরুতর অসুস্থতা, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু ঝুঁকি অনেক কমিয়ে দেয়।

বুস্টার ডোজ (বিশেষ করে Omicron-adapted বা XBB.1.5 ভিত্তিক) নতুন ভেরিয়েন্টে পুরোপুরিভাবে না হলেও স্ট্রং সুরক্ষা প্রদান করে।

তবে মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ভিড় এড়িয়ে চলা—সবচেয়ে ভালো প্রতিরোধের উপায়।

সারাংশ হলো, জীবন রক্ষা করতে পুরানো টিকা এখনো যথেষ্ট কার্যকর, বিশেষ করে যদি বুস্টার নেওয়া থাকে।

তবে নতুন ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সুরক্ষার জন্য আপডেটেড বুস্টার নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

সর্বশেষ তথ্য পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নতুন NB.1.8.1 উপধরন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। যদিও বাংলাদেশে এখনো বেশি নেই। তবে JN.1 ও XFG/XFC-এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। তাই সতর্ক থাকা, টিকা নেওয়া ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলাই বর্তমানে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।

ডা. কাকলী হালদার ।। সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top