ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : পারমাণবিক ঝুঁকি ও বৈশ্বিক অস্থিরতার ছায়া
প্রকাশিত:
১৪ জুন ২০২৫ ১১:৫৪
আপডেট:
১৫ জুন ২০২৫ ০৩:১৭

মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট এমনিতেই জটিল ও অস্থির। দশকের পর দশক ধরে চলমান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জাতিগত বিভেদ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলকে একটি বিস্ফোরক রূপ দিয়েছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যে প্রত্যক্ষ সংঘাতের জন্ম হয়েছে, তা কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে সুসংগঠিত হামলা, সেই সাথে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার ঘটনা আঞ্চলিক সংঘাতের এক নতুন ও বিপজ্জনক মাত্রা উন্মোচন করেছে। এই আগ্রাসন পারমাণবিক ঝুঁকির এক নতুন ছায়া ফেলেছে এবং বিশ্ব শান্তিকে এক নজিরবিহীন সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকরা এই সংঘাতের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
১৩ জুন ২০২৫ ভোররাতে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের উপর এক বিশাল আকারের হামলা চালানো হয়। প্রাথমিক হামলার ঢেউ ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর, ১৩ জুন ২০২৫ দুপুরের দিকে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তাবরিজ শহরে একটি দ্বিতীয় ও পৃথক হামলার খবর স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে আসে। এই বহুমুখী হামলা ইরানের সামরিক সক্ষমতা ও পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর ইসরায়েলের সরাসরি আক্রমণের ইঙ্গিত দেয়।
ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে যে, ইসরায়েলের এই হামলায় অন্তত ৭০ জন নিহত এবং ৩২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। হামলার ছবি ও ভিডিওতে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলো থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে, যা আক্রমণের তীব্রতা ও ব্যাপকতা প্রমাণ করে। ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মধ্যে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন।
আল-জাজিরার তেহরান প্রতিনিধি তোহিদ আসাদি জানিয়েছেন যে, এই হামলায় ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (IRGC) কমান্ডার-ইন-চিফ হোসেইন সালামি এবং ইরানি সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হয়েছেন। এছাড়াও, ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা নুর নিউজ জানিয়েছে যে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলী শামখানি ‘মারাত্মকভাবে আহত’ হয়েছেন।
তাসনিম নিউজ অনুযায়ী, খাতাম আল-আনবিয়া সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর-জেনারেল গোলামালি রশীদও নিহত হয়েছেন। একইসাথে, দুটি শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরেদুন আব্বাসি ও মোহাম্মদ তেহরানচি লক্ষ্যবস্তু হত্যার শিকার হয়েছেন। আব্বাসি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ছিলেন, আর তেহরানচি ছিলেন ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ইরানের সামরিক ও বৈজ্ঞানিক সক্ষমতার ওপর ইসরায়েলের সরাসরি আঘাতের ইঙ্গিত দেয়, যা তেহরানকে কঠোর প্রতিশোধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এই সংঘাতের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো পারমাণবিক ঝুঁকি। পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা অপ্রত্যাশিত এবং ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে তেজস্ক্রিয় লিক, বিস্ফোরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ দূষণ।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি পূর্ব-রেকর্ডকৃত বার্তায় দাবি করেছেন যে, ১৩ জুন ২০২৫ ভোরবেলার এই হামলাগুলোর লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করা। তার মতে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা রোধ করা এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।
তিনি আরও বলেছেন যে, ইরান নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে এবং বিশাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে, যা কয়েক মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছাতে পারে। নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, ‘যখন শত্রু আপনাকে ধ্বংস করার ক্ষমতা তৈরি করে, তাকে থামান। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই হুমকির মধ্যে রেখে যেতে পারি না।’
তবে, ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের জবাবে তেহরান কঠোর প্রতিক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এই হামলার পর ইসরায়েলকে ‘তীব্র ও বেদনাদায়ক’ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায়, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিশালী হাত ইসরায়েলকে শাস্তি ছাড়া যেতে দেবে না।’
এই ধরনের কঠোর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের গভীর আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন যে, ওয়াশিংটন ইসরায়েলি হামলায় জড়িত ছিল না।
ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা জানিয়েছে যে, নাতানজ স্থাপনায় হামলার ফলে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় দূষণ সাইটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
তবে, একটি পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি সামরিক হামলা, এমনকি যদি তা সফলভাবে মোকাবিলা করাও যায়, তবুও তা পারমাণবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়।
পারমাণবিক স্থাপনার ওপর আক্রমণের ঘটনা পারমাণবিক অপ্রসারণের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে গুরুতরভাবে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। যদি ইরান অনুভব করে যে, তার পারমাণবিক কর্মসূচি সামরিক হামলার শিকার হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাহলে তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে।
এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে, যেখানে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোও নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করতে পারে। এমন পরিস্থিতি বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এক মারাত্মক হুমকি। একটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী মধ্যপ্রাচ্য কেবল আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিই বাড়াবে না বরং সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর হাতে পারমাণবিক উপকরণ পড়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পাবে।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতাকে আরও জটিল করে তুলবে। এই সংঘাত আঞ্চলিক জোটগুলো নতুন করে সাজাতে পারে এবং পরাশক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের ঘটনা নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, তবে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে ওয়াশিংটনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখে আসছে এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি বড় আকারের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি দ্বিধা রয়েছে, বিশেষ করে ইরাক ও আফগানিস্তানে তাদের পূর্ববর্তী সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর।
ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি অনুসরণ করেছে, যা পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা এবং নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে। এই নীতি ইরানের অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে, কিন্তু একই সাথে তেহরানকে আরও আক্রমণাত্মক হতে উৎসাহিত করেছে।
এই সংঘাত আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়াকেও প্রভাবিত করবে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও, একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই দেশগুলো এখন একটি কঠিন ভারসাম্যের মুখোমুখি।
একদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে সমর্থন করা অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এড়ানো। জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বনেতারা ইতিমধ্যে সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং যেকোনো মূল্যে বড় ধরনের সংঘাত এড়াতে বলছেন। তবে, এই আহ্বানগুলো কতটা কার্যকর হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পর বিশ্বশান্তির ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চিত ভারসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই নতুন উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে তা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন, জ্বালানি বাজার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, হরমুজ প্রণালী, যা বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, সেখানে যেকোনো সামরিক উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো, সব পক্ষকে চরম সংযম প্রদর্শন করা এবং প্রতিশোধের চক্র ভেঙে আলোচনা ও কূটনীতির পথ বেছে নেওয়া। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, এই সংঘাত নিরসনে একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি আলোচনা অসম্ভব মনে হলেও, তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা, যেমন ওমান বা অন্যান্য নিরপেক্ষ দেশগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
পারমাণবিক অপ্রসারণ চুক্তি মেনে চলার জন্য ইরানের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, কিন্তু একই সাথে তেহরানের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। ইসরায়েলকেও তার নিরাপত্তা উদ্বেগের সমাধান শান্তিপূর্ণ উপায়ে খুঁজে বের করতে হবে, সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে নয়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সর্বশেষ উত্তেজনা মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর পরিস্থিতি এবং বিশ্বশান্তির জন্য এর গভীর প্রভাবের এক স্পষ্ট সতর্কবার্তা। পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা এবং বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনা এই সংঘাতকে এক নতুন বিপজ্জনক স্তরে নিয়ে গেছে।
বিশ্ব আরেকটি বড় যুদ্ধের বোঝা বহন করতে পারবে না। এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত, সমন্বিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যদি এখনই সংযম ও কূটনীতির পথ বেছে নেওয়া না হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের আগুন বৈশ্বিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বিশ্বকে এক অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। পারমাণবিক ঝুঁকির এই সময়ে, প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নেওয়া জরুরি, যাতে বিশ্ব শান্তির দুর্বল সুতোটি ছিঁড়ে না যায়।
ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: