শনিবার, ৮ই নভেম্বর ২০২৫, ২৪শে কার্তিক ১৪৩২


দেশে দেশে পুলিশ সংস্কার


প্রকাশিত:
৮ নভেম্বর ২০২৫ ১৫:১৬

আপডেট:
৮ নভেম্বর ২০২৫ ১৭:৩৫

ছবি : সংগৃহীত

বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে জনমুখী, জবাবদিহিতামূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা বাস্তবায়নের নামই সংস্কার। বাংলাদেশে পুলিশে সংস্কার একটি কাঙ্ক্ষিত ও বহুল প্রতীক্ষিত অধ্যায়। পুলিশ বাহিনীকে সংস্কারের লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রবিধান, কমিটি, রিপোর্ট ও কমিশন ইতিপূর্বে গঠিত হয়েছে।

কমিশনগুলো যাচাই বাছাই ও জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তাদের রিপোর্ট প্রদান করা সত্ত্বেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার হার যথার্থ নয়। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের জনগণ একটি জনমুখী ও আধুনিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে পুলিশ সংস্কারের প্রশ্নে মতামত প্রদান করে।

সম্প্রতি গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করেছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন বেশকিছু সুপারিশমালা প্রদান করেছে। কার্যকরভাবে প্রণয়নকৃত সুপারিশমালা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে সেটি সময়ই বলে দেবে তবে দেশের অধিকাংশ জনগণই ইতিবাচক সংস্কারের লক্ষ্যে তাদের রায় প্রদান করেছে। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংস্কার কার্যক্রম চলমান, বাংলাদেশেও সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। পুলিশর প্রচলিত ধারায় পরিচালিত যেসব কর্মপরিধি অসত্য, ভুল এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সেসব বিষয়ের ওপর সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য সংস্কার পরিচালিত হয়ে থাকে। আমেরিকার পুলিশ সংস্কার প্রক্রিয়ার আন্দোলনের একটি দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস রয়েছে। ১৯০০ সালের শুরুর দিকে আমেরিকাতে আধুনিক পুলিশিং এর যাত্রা শুরু হয়। অগাস্ট ভলমারকে (August Vollmer) আধুনিক পুলিশিং এর জনক বলা হয়। তিনি সর্বপ্রথম সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পুলিশের পেশাদারিত্বের উপর জোর প্রদান করেন।

তার সংস্কার প্রস্তাবনার উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ ছিল, প্রশিক্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি ও নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর গুরুত্বারোপ, অপরাধ শনাক্ত ও প্রতিরোধের জন্য আধুনিক ও অভিনব এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর জোর প্রদান, পুলিশ অফিসারদের জনগণের সেবক হওয়ার মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাদি।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩০ সালে উইকারশ্যাম কমিশন (Wickersham Commission in the 1930s) কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প সফলতা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে পুলিশের বর্ণবাদী নীতি, সহিংস আচরণ, দুর্নীতিপরায়ণতা ইত্যাদি কারণে পুলিশি ব্যবস্থা অকার্যকর প্রমাণিত হয় তখন নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

একুশ শতকের পুলিশিং ব্যবস্থাপনাকে সংস্কারের জন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়ালসের সরকার পার্লামেন্টের নিকট উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। ইংল্যান্ডের পুলিশিং ব্যবস্থাকে ক্রিয়াশীল ও কার্যকর করতে প্রস্তাবনাগুলো সংসদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।

প্রস্তাবনাটির সারমর্ম এমন—

স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদার ভিত্তিতে অপরাধকে মোকাবিলা করার জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার প্রদান করতে হবে। পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাকে স্থির রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

পুলিশ কর্মকর্তাকে তার অধীনে থাকা জনবলকে যথাযথ কাজে লাগানোর স্বাধীনতা দিতে হবে। অপরাধ দমনের জন্য কারিগরি সহায়তা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় টুলস নিশ্চিত করতে হবে। মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য যথার্থ পুলিশ কর্তৃপক্ষ তৈরি করতে হবে।

ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় জনগণকে কেন্দ্র করে পেট্রোলিংসহ পুলিশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়; পুলিশ-পাবলিকের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে প্রত্যেক জনগণ পুলিশকে তথ্য প্রদান করে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সহযোগিতা করে থাকে। 

শ্রীলঙ্কার পুলিশিং ব্যবস্থাকে সংস্কারের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা পুলিশ, জাতীয় পুলিশ কমিশন, একাডেমিয়া এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পুলিশ রিফর্ম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল, পেশাগত মান বৃদ্ধি করা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, মানবাধিকারকে সম্মান প্রদর্শন করা, অপরাধ প্রতিকারের পাশাপাশি ভয়ের সংস্কৃতি হ্রাসে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, পুলিশের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও মর্যাদাকে বৃদ্ধি করা।

এছাড়াও জেন্ডার বেজড ক্রাইমকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে শক্তিশালী ডাটাবেইজ তৈরি, নারী ও শিশু ডেস্ক স্থাপন, পরস্পর পরস্পরের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জোর সুপারিশ করা হয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী অপরাধীদের রাখার জন্য নারী পুলিশ স্টেশন স্থাপিত হয়েছে এবং এ ধরনের পদক্ষেপ কারাগার পরবর্তী সময়ে সমাজের সাথে অপরাধীর খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার পুলিশ রিফর্মে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, কমিশন অপরাধ প্রতিরোধে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশ সদস্যগণ যদি সঠিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে তাহলে অপরাধ সংঘটনের হার অনেকাংশেই কমে আসে। নিয়মিত পেট্রোলিং, সচেতনতামূলক উদ্যোগ, উঠান বৈঠক, কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে জোরদার করা ইত্যাদির মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধে যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

The Police Reform Committee of Japan (2000) জাপানের পুলিশিং ব্যবস্থাকে সংস্কারের জন্য উল্লেখযোগ্য সুপারিশমালা প্রণয়ন করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; লাল ফিতা অপসারণ করা, জনগণের অভিযোগগুলো অত্যন্ত মনোযোগের সাথে মূল্যায়ন করা, পুলিশ সদস্যরা প্রত্যেকে নিজেরা নিজেদের তদারকি/নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি।

জনগণের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে, শৃঙ্খল হতে হবে; কমিউনিটির/সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হতে হবে অর্থাৎ জনগণের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে খাপ খাওয়ানোর লক্ষ্যে পরিবর্তিত পুলিশিং করতে হবে ইত্যাদি।

জাপানের সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে জনগণ ও পুলিশের মধ্যে একটি মজবুত ও টেকসই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়াও পুলিশের সংস্কারের জন্য The Charter of Police Reform নামে সনদের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে জবাবদিহিতা ও আত্ন-উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে; এর অধীনে রয়েছে সত্য উন্মোচন, জনগণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যথাযথ তদন্ত করা ইত্যাদি।

এছাড়া জনগণের জন্য পুলিশকে সর্বসময়ের জন্য নিযুক্ত করা; এর অধীনে রয়েছে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে জোরদার করা, যাবতীয় বিষয়ে জনগণের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। অন্যদিকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধ, সাইবার অপরাধ ইত্যাদির বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক পাঁচ ধাপে বল প্রয়োগের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।

নারী আসামীকে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে শালীনতার সাথে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। রাতের বেলায় গৃহ তল্লাশি করার ক্ষেত্রে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাবতীয় অভিযোগ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করার জোর সুপারিশ করা হয়েছে।

নিরপেক্ষ পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করে কমিশন। থানায় জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক, এফআইআর গ্রহণে বিলম্ব করা যাবে না। পুলিশ আইন ১৮৬১ এর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন অথবা নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

পুলিশের দুর্নীতিরোধে ‘ওয়াচডগ বা ওভারসাইট কমিটি’ গঠন করা যায়। শিশু আইন ২০১৩ এর বিধানসমূহ পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। পুলিশের গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য Centre for Police Research and Development (CPRD) প্রতিষ্ঠার জন্য নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়। অর্থাৎ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো অত্যন্ত ইতিবাচক ও অর্থবোধক। ইতিবাচক সুপারিশমালার কারণেই সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব পুলিশের পেশাদারিত্বের মর্যাদাকে একটি সুগঠিত কাঠামোতে দাঁড় করানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

একটি নির্দিষ্ট সময়কালে পুলিশের কার্যক্রমে মানুষের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি হলে সংস্কারের প্রয়োজন হয়। সংস্কার হয় ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে। তদুপরি দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় সংস্কার কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

সংস্কার কার্যক্রম ব্যাহত হলে বিভিন্ন কারণে মানুষের মনে অসন্তোষ কিংবা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে আবারও কোনো না কোনোভাবে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠিত হয় জনগণের ইচ্ছার প্রেক্ষিতে। কিন্তু কমিশনের সুপারিশগুলো পূর্বের ন্যায় সামান্য বাস্তবায়িত হলেও অধিকাংশই বাস্তবায়নের বাইরেও থেকে যায়। ফলশ্রুতিতে জনগণ আবারও আশাহত হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনমন ঘটে, পুলিশ ও জনগণের আন্ত:সম্পর্কে ফাটল ধরে।

মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top