হজরত বিলাল (রা.) যেভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন
প্রকাশিত:
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:১৪
আপডেট:
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:২৪

হজরত বিলাল ইবনে রাবাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু জন্মগ্রহণ করেন ৫৮০ খিষ্টাব্দে, মক্কার সারাত নামক স্থানে। তার পিতা রাবাহ ছিলেন হাবশি বংশোদ্ভূত একজন আরব ক্রীতদাস। মাতা হামামা ছিলেন একজন প্রাক্তন আবসিনিয় রাজকুমারী।
ভাগ্যের বিপর্যয় তাকে মক্কায় এনেছিল। ইতিহাস বলে, তিনি ছিলেন ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহার ভাতিজি। আমুল ফিলের ঘটনায় উমাইয়া ইবনে খালফ তাকে আটক করে দাসী বানিয়ে নেয়। একই দেশ ও একই মনিবের অধীনস্থ হয়ে রাবাহ এবং হামামা দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। হজরত বিলাল ছিলেন তাদের ঔরশজাত সন্তান।
হাবশি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তার গায়ের রং ছিল কুচকুচে কালো। এজন্য মক্কার লোকেরা তাকে ইবনুস সাওদা বা কালো মহিলার ছেলে বলে সম্বোধন করত। জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন উমাইয়ার ক্রীতদাস। প্রাথমিক জীবনে আবদুদ্দার গোত্রের কয়েকজন এতিম বালকের দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। বালকদের পিতা ইন্তিকালের আগে উমাইয়া ইবনে খালফকে তাদের অভিভাবক করে যায়। সেই থেকে বিলাল পাকাপাকিভাবে উমাইয়ার ক্রীতদাস হয়ে গেলেন।
গায়েগতরে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড শক্তিশালী। কাজকর্মে প্রচুর খাটনি দিতেন। যেজন্য অল্পসময়ের মধ্যে মনিবের একজন অনুগত দাস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু নিচুজাত এবং বর্ণবৈষম্যের কারণে মক্কার সমাজজীবনে তিনি কোনো প্রতিষ্ঠা পাননি।
ইসলাম গ্রহণ
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেদিন সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসীদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন, সেদিন হজরত বিলালও ছিলেন তাঁদর দলে। তিনি রাসুলকে বলতে শুনলেন—কোনো আরবি ব্যক্তি অনারবির ওপর এবং কোনো শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি কৃষ্ণাঙ্গের ওপর তাকওয়া ছাড়া আর কোনোদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের গর্ব করতে পারে না।
এই কথাটি বিলালের কাছে অবিশ্বাস্য লাগলেও অন্তর ছুঁয়ে গেলো। কেননা তিনি নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারেনি, কোনোদিন কোরায়শদের কারো থেকে এমন একটি কথা শুনবেন। কারণ তারা গোলাম আজাদের ব্যাপারে ছিল খুবই নির্দয়। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য ছিল, আমাদের ধনসম্পদের বিনিময়ে যে গোলাম কিনেছি, তাকে কেন বিনামূল্যে আজাদ করে দিব! বিলাল তাদের স্বরূপটা ভালো করে জানতেন। তাই মক্কার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী লোকটিকে যখন ‘গোলাম-মনিব সবাই আল্লাহর কাছে সমান’ বলতে শুনলেন, তখন তার প্রতি শ্রদ্ধায় মন নমিত হয়ে এলো।
অসংখ্য পাথুরে দেবদেবীর বদলে তিনি যখন এক আল্লাহর অস্তিত্বের পয়গাম শুনালেন এবং তার ওপর ঈমান আনার দাওয়াত দিলেন, তখন সেটা বিলালকে দারুণ আকৃষ্ট করল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মুহাম্মদের ধর্মমত গ্রহণ করে জাহিলিয়াতের জঞ্জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন।
যদিও বিলাল জানতেন তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি মনিব উমাইয়ার কানে গেলে জীবনে ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে, তবুও তিনি দমলেন না। তার হৃদয়ে ঈমানের যে সূর্যালোক ঝলক দিয়ে উঠেছিল, সেটাকে তিনি রাসুলের হাতে হাত রেখে কালিমায়ে শাহাদতের উচ্চারণে প্রদীপ্ত করে তুললেন।
ইসলামকে কবুল করে বিলালের মতো এক কালো মানব হয়ে উঠলেন মুসলিম মিল্লাতের আলোকবর্তিকা। ইসলাম গ্রহণকারীদের তালিকায় তার স্থান হলো নবম। আর যারা মক্কার প্রতিকূল পরিবেশে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিয়ে লিল্লাহি বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন, বিলাল হলেন সেই সাতজনের একজন।
মুশরিকদের নির্যাতন
বিলালের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি এক কান দুকান হয়ে মনিব উমাইয়ার কানে গেলো। এটা শুনে উমাইয়া গরম তাওয়ায় সেঁকা রুটির মতো তেতে ওঠল। সে ছিল মক্কার একজন কট্টরপন্থী মুশরিক নেতা। আবু জাহল, উতবা, শায়বা, ওয়ালিদ প্রমুখের সাথে মিলে মক্কার সমাজে মাতব্বরি করত। শুরু থেকেই সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াতি কাজের বিরোধিতা আরম্ভ করল।
অধীনস্থ গোলামের ইসলাম গ্রহণের খবর তার বিরোধিতার আগুনকে আরও তাতিয়ে তুলল। সে এই আগুনের দাহ্য বানাল হজরত বিলালকে। কারণ মক্কার সমাজে বিলাল ছিলেন একেবারে নিরীহ এবং নির্বান্ধব একজন মানুষ—এরওপরে তার ক্রীতদাস। তার ওপর নির্যাতনের খড়গ চালালে বাধা দেয়ার মতো কেউ নেই।
উমাইয়া মক্কার অন্য মুশরিক নেতাদের সাথে মিলে এই সুযোগটাকে কাজে লাগাল। বিলালের মতো ইসলাম গ্রহণকারী এরকম নিরীহ যারা ছিল, তাদের ওপর শুরু করল অমানুষিক নির্যাতন।
তাওহিদ ও রিসালাতের ওপর ঈমান আনায় বিলালের জীবনে নেমে এলো বিপর্যয়ে খড়গ। উমাইয়ার অনুগত লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে গেলো বাতহা উপত্যকায়। সেখানে তার ওপর শুরু হলো নির্বিবাদ নিপীড়ন। মুশরিকদের চেলারা জোরজবরদস্তি করে তার গায়ের কাপড় খুলে নিত। উত্তপ্ত বালির ওপর তাকে চিত করে শুইয়ে বুকের ওপর চাপিয়ে দিত বিশাল ওজনের পাথর। রোদের প্রখরতা আর বালির উত্তাপে পিঠে ফোস্কা পড়ে যেত। পাথরের ভারে নিশ্বাস আটকে থাকত নাকের ডগায়।
আবু জাহল যখন বলত, বিলাল, মুহাম্মদের ধর্ম ছেড়ে দাও। লাত ও উজ্জার ধর্মে ফিরে আসো। বিলাল তখন আহত কণ্ঠে বিশ্বাসের ধার তুলে বলতেন, আহাদুন আহাদ—আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, অবিনশ্বর... আবু জাহল অগ্নিশর্মা হয়ে ধাতানি দিত, নিকৃষ্ট গোলাম, মুহাম্মদকে পরিত্যাগ করো, লাত ও উজ্জাকে গ্রহণ করো। আমরা তোমাকে মুক্তি দিব।
বিলাল তখনো বিশ্বাসের দৃপ্ততায় বলতেন, আহাদুন আহাদ—আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, অবিনশ্বর... মুশরিক নেতারা তার প্রতি খেদ ঝাড়ত, বিলাল, তুমি আমাদের কথাগুলো বলছো না কেন?
বিলাল তখন বিদ্রূপের স্বরে বলতেন, তোমাদের কথাগুলো ঠিক আমার গলা দিয়ে আসতে চায় না! এ কথায় তারা বিলালের ওপর শাস্তির মাত্রা দ্বিগুণ করে দিত। উমাইয়া তাকে শাস্তি দেয়ার নতুন নতুন কৌশল বের করত। কখনো জ্বলন্ত অঙ্গার এনে রেখে দিত তার পিঠের নিচে। সেটা পিঠের চামড়া পুড়িয়ে নিজ থেকে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। কখনো গলায় রশি বেঁধে তাকে ছেড়ে দিত উচ্ছৃঙ্খল ছেলেদের হাতে। তারা তাকে নিয়ে মক্কার অলিগলিতে টানাহেঁচড়া খেলত।
কখনো কাঁচা চামড়ায় মুড়ে বা উটের পেছনে রশি দিয়ে হাত বেঁধে ছেড়ে দেয়া হত কাঁকুরে পথ-প্রান্তরে। এভাবে তারা বিলালের শাস্তি প্রদর্শন করিয়ে যারা ঈমান আনতে চাইত, তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিত।
কিন্তু শত নির্যাতনেও তারা বিলালকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি; পারেনি তার বিশ্বাস থেকে চুল পরিমাণ টলাতে। এত অবর্ণনীয় কষ্টের পরও বিলাল অটল রইলেন তাঁর দীনের ওপর। মুশরিকদের খড়গের নিচে থেকেও ঈমানের সারাবান তাহুরায় গলা ভিজিয়ে তিনি গেয়ে যেতেন আল্লাহপ্রেমের পরম পঙক্তি—আহাদুন আহাদ—আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়,
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: