ক্রিকেটে যেভাবে ‘বন্ধু থেকে শত্রু’ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা
প্রকাশিত:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:৪৬
আপডেট:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:৩৫

বর্তমান বিশ্বে যেকোনো খেলাতেই রাইভালরি বা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি স্বাভাবিক বিষয়। ক্রিকেটে রাইভালের কথা উঠলেই চলে আসে ভারত-পাকিস্তান অথবা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের কথা। এই দেশগুলোর মাঝে খেলা মানেই প্রতি পরতে পরতে উত্তেজনার ছাপ। যেখানে খেলাটা শুধু খেলার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি হয়ে দাঁড়ায় দুই দেশের মান-সম্মানের লড়াই।
সাধারণত দুই দেশের মাঝে অতীত ইতিহাস, সামাজিক ও অন্যান্য নানা কারণে তৈরি হওয়া তিক্ততা থেকেই রাইভালরির সূত্রপাত ঘটে। তবে এসবের বাইরে ব্যতিক্রম হিসেবে সম্প্রতি আরও দুই দেশের মাঝে ক্রিকেটে রাইভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যার পেছনের কারণ পুরোটাই ক্রিকেটীয়।
শুরুর দিকে বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কার মাঝে সম্পর্ক ছিল শিক্ষার্থী আর শিক্ষকের মতো। একসময় যা দাঁড়ায় অনেকটা বন্ধুর মতো সম্পর্কে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি রূপ নিয়েছে উত্তেজনায় পরিপূর্ণ এক ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এই দ্বন্দ্ব এখন শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ নেই। এর প্রভাব দেখা যায় ভক্তদের আবেগ, মিডিয়া হাইপ, এমনকি খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষাতেও।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ যখন আইসিসি ট্রফি জিতে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়, তখন শ্রীলঙ্কা ছিল সদ্য বিশ্বকাপজয়ী দল। ঠিক আগের বছরই সবাইকে চমকে দিয়ে বিশ্বকাপ জেতা শ্রীলঙ্কাকে সেই সময় বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা দেখতো সম্মান আর প্রেরণার চোখে। বাংলাদেশের প্রথম একাধিক ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই।
দূরত্ব তুলনামূলক কম হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অনেক ক্রিকেটারই নিয়মিত ঢাকা লিগে খেলতে আসতেন। লঙ্কান খেলোয়াড়রাও সে সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সহযোগিতাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেন। ফলে দারুণ এক হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে দুই দলের ক্রিকেটাররা লড়তেন। আন্তর্জাতিক ম্যাচে সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনে, দিলশানদের কাছ থেকেও অনেক কিছুই শিখেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
সময় সবসময় একরকম থাকে না। দুই দেশের মাঝে তিক্ততার সূত্রপাত ২০১২ সালের এশিয়া কাপে। সেবার জিতে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ। যা ছিল লাল-সবুজদের জন্য অনন্য এক অর্জন। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশি খেলোয়াড়রা উল্লাসে মাতেন ঠিকই। তবে এর মাঝে ড্রেসিংরুমে উদযাপনের সময় ক্রিকেটাররা কিছু বাজে শব্দ করেন যা শ্রীলঙ্কার অনেক খেলোয়াড় ও কোচদের কাছে অপমানজনক মনে হয়েছিল।
সেই ঘটনা এরপর বেশিদূর এগোয়নি। কয়েক বছর সব ভালোভাবেই চলছিল। দুই দেশের মাঝে বৈরি সম্পর্ক শুরুর সবচেয়ে বড় সূচনা হয় ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফিতে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে অনুষ্ঠিত এই ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনালের আগে অলিখিত সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই দল। সেখানে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে বেশ কিছু আক্রমণাত্মক কথা বলেন দুই দলের খেলোয়াড়রা।
ম্যাচের মাঝেও ছিল উত্তেজনা। ম্যাচের শেষ ওভারে আম্পায়ারদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। আম্পায়াররা নো বল না দেওয়ায় বাংলাদেশের তৎকালীন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ডাগআউট থেকে মাঠে প্রায় ঢুকে পড়ে ক্রিজে থাকা খেলোয়াড়দের মাঠ ছাড়তে বলেন। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বুদ্ধিমত্তায় যদিও সেটি আর হয়নি।
এরপর রিয়াদ বীরত্বে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। জয়ের আনন্দে সকল খেলোয়াড়রা মাঠের মাঝেই সম্মিলিতভাবে ‘নাগিন ডান্স’ দেয়। যা শ্রীলঙ্কান ভক্তরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও চূড়ান্ত অপমান হিসেবে দেখে। সেই ম্যাচে বাংলাদেশের এক খেলোয়াড় উত্তেজনার একপর্যায়ে শ্রীলঙ্কান ড্রেসিংরুমের দরজাও ভেঙে ফেলেন।
এদিকে বাংলাদেশের কাছে হেরে ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হওয়া শ্রীলংকার সমর্থকরা শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ভারতকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয় ও তাদের জয় উদযাপন করে। এই ম্যাচের পর থেকেই বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার রাইভালরি রীতিমতো ক্রিকেট ইতিহাসে স্থান পায়। পরবর্তী বছরগুলোতে মাঠে নানা ঘটনায় উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মাঝে একাধিক সিরিজে, বিশেষ করে বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপে বারবার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশকে কটাক্ষ করে নানা সময় কথা বলেছেন শ্রীলঙ্কার সামারাবিক্রমা, মেন্ডিস, থিসারা পেরেরা প্রমুখ খেলোয়াড়রা। বাংলাদেশও পিছিয়ে ছিল না। সাকিব, তামিম, লিটন, মুশফিকরা নিজেদের পারফরম্যান্স ও শরীরী ভাষা দিয়ে উত্তর দিয়েছেন লংকানদের।
দুই দেশের রাইভালরির ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। সেবার দুই দলের লড়াইয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টাইমড আউটের ঘটনা দেখে ক্রিকেটবিশ্ব। যা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সমর্থকরাও। সেই ম্যাচেই সাকিবকে আউট করে ঘড়ির দিকে ইঙ্গিত করেন টাইমড আউটের শিকার হওয়া অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ।
পরবর্তীতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারিয়ে শ্রীলঙ্কার পুরো দল মিলে টাইমড আউট ভঙ্গিমায় ছবি তুলে উদযাপন করে। ঠিক এরপর অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজ জিতে শ্রীলঙ্কার সেই উদযাপনের উত্তর দিয়ে আরেকটি উদযাপন করে বাংলাদেশ। অর্থাৎ দুই দেশের মাঝে সেই দ্বন্দ্ব কমেনি, বরং দিনে দিনে আরও বেড়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, ক্রিকেটীয় ঐতিহ্যে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে থাকলেও কেন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা এত তীব্র? এখানে প্রথমেই আসে ‘বেবি টিম’ ট্যাগ। শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপজয়ী দল। অন্যদিকে বড় মঞ্চে বাংলাদেশের তেমন কোনো সাফল্য নেই। এমনকি অতীতে বাংলাদেশকে বড় বড় ব্যবধানে হেসেখেলে হারিয়েছে লংকানরা।
এ কারণে শ্রীলঙ্কার অনেক ক্রিকেটারই বাংলাদেশকে অনেকতা ‘ছোট ভাই’ বা ‘অযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী’ ভাবত। আর এই ভাবনা মেনে নিতে চায় না বাংলাদেশ। একদিকে ক্রিকেটে দিনে দিনে উন্নতি করেছে টাইগাররা, অন্যদিকে সোনালি সময় হারিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে গেছে লংকানরা। দুই দলের লড়াই হয় হাড্ডাহাড্ডি, ফলে উত্তেজনাও থাকে বেশি।
এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের যুদ্ধও এই রাইভালরি বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম বড় কারণ। ফেসবুক, ইউটিউব থেকে শুরু করে টুইটারে পর্যন্ত দুই দেশের সমর্থকরা একে অপরকে ট্রল করে, উত্তপ্ত বাক্য ছুঁড়ে দেয়। যা প্রতিটি সিরিজ বা ম্যাচকে অনেকটা ‘যুদ্ধের মঞ্চ’ বানিয়ে তোলে।
সবমিলিয়ে এখন বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার প্রতিটি ম্যাচ মানেই বাড়তি উত্তেজনা, বাড়তি চ্যালেঞ্জ, বাড়তি আবেগ। প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়তো শুরু হয়েছে একে অপরকে হেয় করার মধ্য দিয়ে, কিন্তু এটি এখন উভয় দলের ক্রিকেট উন্নয়নের বড় অনুঘটক। আর বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার এই দ্বৈরথ এখন আর শুধুই খেলার নয়, এটি হয়ে উঠেছে মর্যাদার লড়াই।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: