ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখতে বাঁচতে চান শহীদ আবু সাঈদের বাবা-মা
প্রকাশিত:
১৬ জুলাই ২০২৫ ১১:২৯
আপডেট:
১৬ জুলাই ২০২৫ ২২:৩৬

১৬ জুলাই ২০২৪। সময় দুপুর দেড়টা। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) এক নম্বর ফটকের সামনে জমায়েত হন ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। শুরু করে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল ছোড়া। পুলিশের সঙ্গে যোগ হয় ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীরা। ভয়ে সবাই দৌড়ে পালাতে থাকে দিকবিদিক। শিক্ষার্থীদের দমনে পুলিশ প্রায় ২০০ রাউন্ড গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। কিন্তু একজন দাঁড়িয়ে থাকে বুক টান করে, দুই হাত প্রসারিত করে, তার নাম আবু সাঈদ। মুহূর্তেই তার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায় পুলিশের গুলিতে।
তখন ঘড়ির কাটায় ২টা বেজে ১৭ মিনিট। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে ন্যুয়ে পড়ে। সড়কের একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতেই ঢলে পড়েন সেখানে। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সময় ছিল বিকেল ৩ টা ৫ মিনিট। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গুলির সামনে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠা আবু সাঈদের মৃত্যুর আগ মুহূর্তের বিরল সেই ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। দৃশ্যটা হয়ে ওঠে প্রতীবাদের প্রতীক। সেদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হয়_‘এটাই তো সাহস। সে মাথা নিচু করেনি।’
আজ তার শাহাদৎ বরণ করে নেওয়ার এক বছর। এই ৩৬৫ দিনে বাংলাদেশ পেয়েছে নতুনত্ব। আবু সাঈদের মৃত্যুতে অগ্নিগর্ভে রূপ নেয় কোটা আন্দোলন। কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্র-জনতার গণপ্রতিরোধের মুখে ৫ আগস্ট টানা ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আবু সাঈদকে স্মরণের মধ্যদিয়ে নতুন বাংলাদেশ সংস্কারে শুরু হয় নানা কার্যক্রম। কিন্তু এখনো বিচার এখনো অধরা। গ্রেপ্তার হয়নি আবু সাঈদ হত্যা মামলার মূলহোতারা। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী ও শিক্ষকসহ সকলের একটাই প্রশ্ন_‘বিচার হবে তো?’
মেধার স্বাক্ষরে অনন্য নাম আবু সাঈদ
আবু সাঈদ ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেরোবি সমন্বয়ক ছিলেন। এই আন্দোলনের প্রথম শহীদও তিনি। বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে। বাবা মকবুল হোসেন একজন কৃষক ও মা মনোয়ারা বেগম গৃহিণী। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল সাঈদ।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন আবু সাঈদ। তাকে ঘিরে আকাশসম স্বপ্ন ছিল দরিদ্র মা-বাবার। গ্রামের জুনুদেরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন আবুু সাঈদ। পরে এলাকার খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রংপুর সরকারি কলেজে। সেখান থেকেও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বপ্ন দেখতেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যোগ দেবেন।
হতদরিদ্র পরিবারের ভরসা ছিলেন তিনি। কিন্তু কোটার মারপ্যাচে যাতে মেধাবীরা বঞ্চিত না হয়, সেজন্য হাজারো শিক্ষার্থীর সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যুক্ত হয়েছিলেন ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে’। মৃত্যুর পরও আবু সাঈদের মেধার স্বাক্ষর উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। আবু সাঈদ সিজিপিএ ৩.৩০ পেয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করে।
নিহতের পরিবার ও শিক্ষার্থীদের দাবি
নিহতের পরিবার অভিযোগ করেন, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালিয়েছে। ঘটনার পরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিচার দাবি করা হলেও দীর্ঘ সময় কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। আবু সাঈদ হত্যা মামলার মাত্র ৪-৬ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখনো অনেক আসামি স্বপদে বহাল রয়েছে বলে ক্ষুব্ধ আবু সাইদের পরিবারের সদস্য ও সহযোদ্ধারা।
শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, এক বছর হয়ে গেল, অথচ আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার পাইনি। এখন পর্যন্ত মাত্র ৪-৬ জন আসামিকে ধরা হয়েছে। মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। বিচার কার্যক্রমের অগ্রগতি জানতে আমরা ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলাম। আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে সব শহীদের হত্যার বিচার সম্পূর্ণ হবে। আমরা সেই বিচার দেখার অপেক্ষায়।
আর আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ঘটনার সময় নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে। তারা আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন।
শহীদ আবু সাঈদের বোন সুমি খাতুন বলেন, আমরা সাদামাটা জীবনযাপন করতাম। আমাদের খুব কম ছিল, কিন্তু ভাইদের সঙ্গে সবকিছু ভাগাভাগি করে আমরা অনেক সুখী ছিলাম। এখন হয়তো অনেক কিছু আছে, কিন্তু কোনো কিছুতে সুখ নেই। আমি খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
স্মৃতিচারণ করে জুলাই যোদ্ধা শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়া শহীদ আবু সাঈদের কথা স্মরণ হলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। সে তো সাহসের বাতিঘর, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম প্রতিবাদের প্রতীক। তাকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে, পুরো বিশ্ব দেখেছে। কিন্তু আমাদের আইন আদালত এত জটিলতায় চলে গেছে। যার কারণে বিচারিক কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। এখনো মূলহোতারা ধরা ছোয়ার বাইরে।
ছুটি হলে মায়ের কোলে ছুটে আসতেন আবু সাঈদ
আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল প্রশাসনিক ক্যাডারে যোগ দিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ছেলে হারিয়ে আজও আমি আদালতের দোরগোড়ায় ঘুরছি। বিচার চাই, শুধু আমার ছেলের না, সেই দিনের সকল শিক্ষার্থীর হত্যার বিচার চাই। আল্লাহ্ যেন আমার ছেলে হত্যার বিচার না দেখিয়ে মৃত্যু না দেন। আমি বিচার দেখার জন্য বাঁচতে চাই।
ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ছেলে হারানোর বেদনা কোনোভাবে সহ্য করা যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবো।
ছেলেকে হারানোর এক বছর পেরিয়ে গেলেও মা মনোয়ারা বেগম সেই দিনটার কথা ভুলতে পারেননি। ভুলতে পারেননি ছেলের নিথর দেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ির দুয়ারে আসার সেই ক্ষণের কথা। যেই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে ছুটে আসতেন মায়ের কোলে। সেই মায়ের চোখের সামনে এখন ভেসে বেড়ায় ১৬ জুলাই পুলিশের গুলির সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা সেই শেষ দৃশ্যটা। যা ক্যামেরাবন্দি হয়ে কোটি মানুষের অন্তরে গেঁথে আছে।
মা মনোয়ারা বেগমও জীবদ্দশায় হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখতে চান। চান সকল হত্যার ন্যায় বিচার। তিনি বলেন, ও আমাকে বলেছিল, আর কষ্ট করতে হবে না। আমি চাকরি করব, তোমাদের সব দায় আমি নেব। আজ সেই ছেলে নেই। আর স্বপ্নও নেই।
তিনি আরও বলেন, আমার বুকের সন্তান আর কখনো ফিরে আসবে না, এটা বুঝি। তবু বারবার মনে হয়, ওই দরজাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসবে, বলবে—‘মা, খাইছো? আমি এখন কিছুতেই মন দিতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই সেই মুখটা দেখি, যে মুখে কোনো ভয় ছিল না, শুধু বিশ্বাস ছিল।
শিক্ষার্থীদের কাছে আবু সাঈদ সাহসের অনুপ্রেরণা
বেরোবির শিক্ষার্থীরা ১৬ জুলাইকে শহীদ আবু সাঈদ দিবস হিসেবে পালন করছেন। পুরো ক্যাম্পাসে কালো ব্যানার, স্মরণসভা, কবিতা পাঠ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ নানা আয়োজনে তাকে স্মরণ করা হচ্ছে।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল বলেন, ‘সাঈদ ভাই আমাদের আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ছিলেন। এখন তিনি ইতিহাস হয়ে আছেন। আমরা তার সাহস মনে রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকব।’
বেরোবিতে আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রহমত আলী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে অভিযোগ গঠন করেছে ও বিচার কাজ শুরু করেছে। আমরা দ্রুত রায় চাই। এই বিচার এমন একটি দৃষ্টান্ত হোক, যা প্রমাণ করবে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।
বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন আশা প্রকাশ করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে। তিনি বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলে, তা হবে একটি জাতীয় মাইলফলক।
আবু সাঈদ হত্যা মামলা ও আসামি
পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় গত বছরের ১৮ আগস্ট মামলা করেন তার বড় ভাই রমজান আলী। ওই মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়। পরে আসামির তালিকায় নতুন আরও ৭ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক উপাচার্য, সাবেক প্রক্টর, সাবেক ১১ জন পুুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের আসামি করা হয়। এখন পর্যন্ত এ মামলায় দুই পুলিশ সদস্য, এক শিক্ষক ও একজন ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে।
এর আগে, আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৭ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতিভূষণ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। সে মামলায় আসামি করা হয়েছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। কোটা আন্দোলন চলাকালে আবু সাঈদ হত্যা মামলায় কলেজছাত্র আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে (১৬) গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরবর্তীতে সমালোচনার মুখে তাকে জামিন দেন আদালত। এদিকে একই সঙ্গে পুলিশ ও নিহতের পরিবারের দায়ের করা এ দুটি মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রংপুর পিবিআইকে।
আবু সাঈদ হত্যা ও ট্রাইব্যুনাল
শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গত ৩০ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ প্রসিকিউশন থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। এ মামলায় ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এর মধ্যে চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন পুলিশের সাবেক এএসআই আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোক্টর শরিফুল ইসলাম ও ছাত্রলীগ নেতা ইমরান আকাশ। এছাড়া রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ নামের দুজন আসামি বর্তমানে অন্য মামলায় কারাবন্দি, যাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়।
বাকি ২৪ জন পলাতক আসামিকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এজন্য বাকি পলাতক ২৪ জন আসামির বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য আদেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী রেজিস্ট্রার অফিস ব্যবস্থা নেবে। পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে ২২ জুলাই। সেদিন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি হয়ে তারা আসবে। যারা পলাতক থাকবে তাদের জন্য রাষ্ট্র আইনজীবী নিযুক্ত করবে। তারপর মামলা অভিযোগ গঠনের দিকে যাবে।
তদন্ত ও বিচারিক অগ্রগতি
২০২৫ সালের ২৪ জুন তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে হত্যাকাণ্ডকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রতিবেদনে উঠে আসে, ওই সময় পুলিশের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু ব্যক্তিও হামলায় পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। গত ৩০ জুন আবু সাইদ হত্যা মামলায় অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বর্তমানে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিচারাধীন রয়েছে।
প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন সাবেক এসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম ও ছাত্রলীগ কর্মী ইমরান চৌধুরী আকাশসহ আরও অনেকে সহায়তা ও উসকানি দিয়েছেন।ওই চার আসামি অন্য মামলায় আগে থেকেই গ্রেপ্তার ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ
ঘটনার পরের মাসগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বৈঠকে দুইজন শিক্ষক ও সাতজন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড ছিল বেরোবির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা চাই, দোষীদের দ্রুত বিচার হোক।
হত্যার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছে তার বিভাগের শিক্ষকরা। তারা বলছেন, গোটা জাতি দেখেছে পুলিশ নিরস্ত্র আবু সাঈদকে বন্দুকের নলের সামনে থেকে গুলি করেছে। আমরা আশা করছি ও অনুরোধ জানাচ্ছি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা কোনো অবহেলা না করে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী বলেন, আবু সাঈদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত সদস্য। তাঁর সর্বোচ্চ ত্যাগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি এনে দিয়েছে। তাঁর হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার শুধু তাঁর পরিবার নয়, জুলাই শহীদদের পরিবার এবং পুরো জাতিকেই শান্তি দেবে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
নিরস্ত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনার পরপরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সারা দেশে আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগরসহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ক্লাস বর্জন ও মানববন্ধনের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একাধিক বিবৃতিতে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করে।
আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর ১৭ জুলাই থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ট্রেজারারসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ হতে অন্তত ৪০ জন পদত্যাগ করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী দায়িত্ব গ্রহণের পর তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
বেরোবিতে পালিত হবে ‘জুলাই শহীদ দিবস’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) আজ বুধবার পালিত হবে ‘জুলাই শহীদ দিবস’। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, দিবসটির কর্মসূচিতে অংশ নিতে ক্যাম্পাসে আসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা। তারা হলেন- আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, পানিসম্পদ ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মুক্তিযুদ্ধ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বীরপ্রতীক।
বুধবার (১৬ জুলাই) সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে কবরে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যদিয়ে দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টায় কবর জিয়ারত শেষে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে কালো ব্যাজ ধারণ ও শোক র্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ আবু সাঈদ তোরণ ও মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ১০টা ১৫ মিনিটে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে আলোচনাসভা।
বিকেল সাড়ে ৩টায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং বাদ আসর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে শহীদ আবু সাঈদের বাবা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। শহীদ পরিবারের আরো ২১ জন প্রতিনিধি মঞ্চে থাকবেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের এবং ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. তানজীমউদ্দীন খান।
ডিএম /সীমা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: