বুধবার, ৯ই এপ্রিল ২০২৫, ২৫শে চৈত্র ১৪৩১


চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাগত সম্পর্ক ভালো নয়


প্রকাশিত:
২০ জুলাই ২০২৩ ১৯:২২

আপডেট:
৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:৪৬

প্রতিকী ছবি

চিকিৎসক ও সাংবাদিক এমন দুটি পেশাগোষ্ঠী যারা স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য তথ্যকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই তাদের মধ্যে পেশাগত আন্তরিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অথচ দেশের এই দুই পেশাজীবী গোষ্ঠীর মধ্যে সামগ্রিকভাবে পেশাগত সম্পর্ক ভালো নয়; উভয়েই একে অপর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন যা জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা।

তবে চিকিৎসকগণ সাংবাদিক সম্পর্কে তুলনামূলক বেশি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। দেশের ৮৯.৫% চিকিৎসক মনে করেন যে, দেশের চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের মাঝে সম্পর্ক ভালো নয়। অন্যদিকে ১৮.৫% সাংবাদিক মনে করেন এই সম্পর্ক ভালো নয়।

‘প্রফেশনাল রিলেশনশিপ বিটুইন ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড জার্নালিস্টস: ওয়েব-বেইজ ক্রস-সেকশনাল স্টাডি’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা বিষয়ক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ইন্টারঅ্যাক্টিব জার্নাল অব মেডিকেল রিসার্চ’-এ সম্প্রতি গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা দলে ছিলেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর সিঙহেলথ ডিউক-এনইউএস গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌফিক জোয়াদার, মনো মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জামিলুর রহমান ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে স্বাস্থ্য অর্থনীতি শাখার পরামর্শক মো. গোলাম রাব্বানী।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণায় মোট ৪১৯ জন চিকিৎসক ও সাংবাদিক অংশ নেন। তাদের মধ্যে ২১৯ জন ছিলেন চিকিৎসক ও ২০০ জন ছিলেন সাংবাদিক।

বেশ কয়েকটি সূচকের ভিত্তিতে গবেষকগণ সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের পারস্পরিক ধারণা বোঝার চেষ্টা করেন। সূচকগুলো হলো সামগ্রিকভাবে দুই পেশার মানুষের মাঝে পারস্পরিক আস্থা, পেশা ও পেশাগত দক্ষতার প্রতি বিশ্বাস, পরস্পরের পেশাদারিত্ববোধের মনোভাব, পেশাগত জায়গা থেকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, পরস্পরের পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও সততার প্রতি আস্থা এবং নিজ পেশাকে অন্য পেশার তুলনায় উন্নততর মনে করা।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারী চিকিৎসকদের ৫৩.৪ শতাংশই জানান যে সাংবাদিকদের পেশাগত কাজের জায়গা ও দক্ষতা প্রতি তাদের আস্থা খুবই কম। অন্যদিকে চিকিৎসকদের প্রতি ৪৩.৫% সাংবাদিকদের আস্থা কম। আর ৫৬.২% চিকিৎসক মনে করেন দেশের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের মান খুবই নিচু। অন্যদিকে চিকিৎসকদের পেশাদারিত্বের মান খুবই নিচু বলে মনে করেন ৩২.৫ শতাংশ সাংবাদিক।

শতকরা ৫০.৭ ভাগ জানান যে, পেশাদার গোষ্ঠী হিসেবে সাংবাদিকদের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নাই। অন্যদিকে ১০.৫ শতাংশ সাংবাদিক পেশাদার গোষ্ঠী হিসেবে চিকিৎসকদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নাই বলে জানান।

৫১.৬ শতাংশ চিকিৎসক মনে করেন যে, সাংবাদিকরা চিকিৎসকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও পেশাগত সততার প্রতি কোনো আস্থা রাখে না। অন্যদিকে ৪.৫% সাংবাদিক মনে করেন যে, চিকিৎসকরা তাদের পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও পেশাগত সততার প্রতি আস্থা রাখে না।
৮৬.৮% চিকিৎসক মনে করেন যে, সাংবাদিকরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ পেশাজীবী মনে করে। অন্যদিকে ১৯.০% সাংবাদিক মনে করেন যে, চিকিৎসকরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ পেশাজীবী মনে করে।

৮২.২% চিকিৎসক মনে করেন যে, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, স্বাস্থ্যখাত নিয়ে প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা কোনো বিশেষ বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই কাজ কর, সত্য তুলে ধরার জন্য নয়। অন্যদিকে ১.০% সাংবাদিক মনে করেন যে চিকিৎসকরা মূলত ঔষধ কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রেসক্রাইব করে।

গবেষকগণ দেখতে পান যে, সাংবাদিকদের সম্পর্কে পুরুষ ও তরুণ চিকিৎসকদের ধারণা তুলনামূলক বেশি নেতিবাচক। গবেষকগণ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এই নেতিবাচক ধারণার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের এমন একটা ধারণা দেওয়া হয় যে, তারা অন্য যেকোনো পেশার লোকজনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এছাড়া গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে তরুণ চিকিৎসকদের তুলনামূলক কম অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকে। অন্যদিকে সাংবাদিকগণও সিনিয়র চিকিৎসকদের প্রতি তুলনামূলক কম সমালোচনাত্মক হন। কেননা দীর্ঘদিন এক ধরনের কাজের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
গবেষণা আরও দেখা যায় যে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তুলনায় মেডিকেল অফিসারগণ সাংবাদিকদের প্রতি বেশি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।

গবেষণায় দেখা যায়, চিকিৎসকগণ সাংবাদিকদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। অন্যদিকে সাংবাদিকগণ চিকিৎসকদের যোগাযোগ দক্ষতার প্রতি স্বাচ্ছন্দ্য সন্দিহান। গবেষকগণ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, চিকিৎসকদের যোগাযোগ দক্ষতা কম থাকার পেছনে অন্যতম কারণ হলো দেশের মেডিকেল কলেজগুলো আচরণ বিজ্ঞান ও যোগাযোগ বিদ্যা বিশের করে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সম্পর্কে পঠন-পাঠনের সুযোগ না থাকা।

স্বাস্থ্যখাত ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাংবাদিকদের ঠিক মত বুঝিয়ে বলতে না কারণে সাংবাদিকগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে থাকতে পারেন। এছাড়া মেডিকেল ও স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকার কারণেও সাংবাদিকরা গুণগতমান সম্পন্ন সংবাদ প্রতিবেদন লিখতে পারেন না।

সাংবাদিকগণ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ করেন। তাড়াহুড়া করে প্রতিবেদন করতে গিয়ে সংবাদ শিরোনামে অতিরঞ্জন করে থাকেন বলে চিকিৎসকগণ মনে করেন। গবেষকরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জনস্বাস্থ্য তথ্য জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো দেশের চিকিৎসক সাংবাদিকদের মাঝে পর্যাপ্ত পেশাগত যোগাযোগ না থাকা, একে অপরের কাজের সংস্কৃতি না বোঝা।
বেশিরভাগ চিকিৎসকদের দ্বিমত হলো সাংবাদিকরা প্রায়শই আগেই নিজেদের মত প্রতিবেদন তৈরি করে ফেলে তারপর চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকরা স্বাস্থ্য ও মেডিকেল বিষয়সমূহকে চাঞ্চাল্যকরভাবে তুলে ধরে; পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা না করে কিংবা বিস্তারিত তথ্য না জেনেই “ভুল চিকিৎসা” শব্দবন্ধ ব্যবহার করে। পর্যাপ্ত যাচাইবাছাই না করেই স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করে।

অন্যদিকে, সাংবাদিকদের অভিযোগ হলো তথ্য সংগ্রহের জন্য চিকিৎসকদের কাছে গেলে বেশিরভাগ চিকিৎসা পর্যাপ্ত সময় দেন না; চিকিৎসা ও রোগ সম্পর্কে বলতে গেলে এমন শব্দ ব্যবহার করেন যা সাধারণ আদও বুঝবে না; সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় সাংবাদিকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করেন; নিজেদের শ্রেষ্ঠতর মনে করার কারণে চিকিৎসকগণ গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলেন।

সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের মাঝে নিয়মিত পেশাদার যোগাযোগের দরকার আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ৮৫% চিকিৎসক জানান তারা একমতও নন, দ্বিমতও নন। অন্যদিকে ৫৩% সাংবাদিক জানান তারা কিছুটা একমত।

এই দুই পেশাদার গোষ্ঠীর মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে ৯০% চিকিৎসক জোরালোভাবে একমত যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের দরকার আছে। অন্যদিকে ৫০% সাংবাদিক কিছুটা একমত।

দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে যোগাযোগ দক্ষতা ও গণমাধ্যমকে মোকাবেলার দক্ষতা বিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা এবং সাংবাদিকতা শিক্ষা বিভাগগুলোতে চিকিৎসা সম্পর্কিত মৌলিক পাঠদানের ব্যবস্থার জোর দেওয়ার কথা বলা হয়।

গণমাধ্যম কর্মীগণ অভিযোগ করেন যে, চিকিৎসকগণ রোগ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়সমূহ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এরকমভাবে বলতে পারে না; তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে গেলে তারা এমন আচরণ করে যেন তারাই সবকিছু বোঝে; সাংবাদিকতা পেশা ও সাংবাদিকদের দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না; সাংবাদিকদের পেশাগত কাজের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে; এবং নিজস্ব এজেন্ডা বা স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্যই সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতিবেদন রচনার জন্য তথ্য সংগ্রহের জন্য গেলে প্রয়োজনীয় সহায়তা করে না।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ হলো সাংবাদিকগণ প্রায়শই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়সমূহ খুবই পক্ষপাতমূলক, চাঞ্চাল্যকর ও বেঠিকভাবে উপস্থাপন করে। তারা স্বাস্থ্য সেবার প্রক্রিয়া ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জটিলতা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা রাখে না।

সাংবাদিকগণ প্রায়শই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করে এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ভুলভাবে উদ্ধৃত করে। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যম দেশের স্বাস্থ্যখাত ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে; এবং অতিরঞ্জিত শিরোনাম ব্যবহার করে।

গবেষণাপত্রটির লিড অথর আমিনুল ইসলাম বলেন, দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী মারা গেছে। এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়েই বর্তমান গবেষণাটির চিন্তা মাথায় আসে। বাস্তবতা হলো, চিকিৎসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকার কারণে সাংবাদিকগণ স্বাস্থ্যসেবা খাত সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রতিবেদন করে থাকেন।

তিনি বলেন, গণমাধ্যম স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জটিল বিষয়সমূহ, স্বাস্থ্যনীতি, ঔষধ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারসমূহকে সহজ সরলভাবে তুলে ধরে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য আচরণ, বিশ্বাস, মনোভাব ও স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান সম্পর্কে জনগণের ধারণা ও জনস্বাস্থ্য নীতি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে গণমাধ্যম।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top