শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১


কালো-সাদা-হলুদ ছত্রাক বা ফাঙ্গাস ভীতি নয়, প্রতিরোধ


প্রকাশিত:
৩০ মে ২০২১ ০৫:৩৩

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৫০

গত ২৫ মে যখন বারডেম হাসপাতালে ২ জন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১ জন মারা গেলেন তার আগে বাংলাদেশে এই রোগের সংক্রমণ বা মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু ততোদিনে ভারতে প্রায় ১০০০০ আক্রান্ত রুগী আর প্রায় ২৫০ জনের মৃত্যু ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে ভারত জুড়ে এক আতংকের নামে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সহ ৬ টি প্রদেশে এই রোগকে মহামারী ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি ভারতের কোন কোন জায়গায় দেখা দিচ্ছে সাদা ও হলুদ ছত্রাকের সংক্রমণ। একই রকম আবহাওয়া আর ভৌগোলিক কারনে আমাদের দেশেও এই রোগের বিস্তার হওয়া অসম্ভব নয়।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি?
এটা একটা ছত্রাকজনিত রোগ। যা মিউকরমাইকোসিস নামের বিশেষ ধরনের অনুবীক্ষনিক ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে হয়। এর মধ্যে রাইজোপাস প্রজাতি হ’ল সবচাইতে বেশি দায়ী, তবে অন্যান্য জীবানু যেমন মিউকর, কানিংহামেলা, অ্যাফোফিজোমাইসেস, লিচথিমিয়া, সাকসেনিয়া, রাইজোমুকর এবং অন্যান্য প্রজাতিও এই রোগের কারন।

এই ছত্রাক সর্বব্যাপী – মাটি, পানি, বাতাস, পঁচা বাসি খাবার বিশেষত রুটি ইত্যাদিতে ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু এর সংক্রমণ ক্ষমতা এতই কম যে ১ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ১-২ জনের এই জীবানু সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু কোন কারনে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই কেবল এই সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে- যেটা ১ লাখে ২০ থেকে ৩০ জন বা আরও বেশি হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগী, বিশেষত যারা কিটো অ্যাসিডোসিস এ আক্রান্ত হয় তাদের ঝুঁকি খুব বেশি। তাছাড়া ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, অতিরিক্ত ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, অত্যধিক স্টেরয়েডস গ্রহণ করা, কিডনি বা অন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা রোগী এবং চরম অপুষ্টিজনিত রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ হতে পারে। চামড়ার গভীর ক্ষত ও পোড়া ঘায়েও এই রোগ হতে দেখা যায়।

মিউকর পরিবেশে মোল্ড হিসাবে থাকলেও শরীরের অভ্যন্তরে ঢুকে হাইফা বা তন্তু আকারে পরিণত হয়। এগুলি বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে ছত্রাকের হাইফাগুলি রোগীর রক্তনালীতে আক্রমণ করে, যা থেকে থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বেঁধে টিস্যু ও অঙ্গে ইনফার্কশন, নেক্রোসিস এবং পরিশেষে গ্যাংরিন তৈরি হতে পারে। সুস্থ মানুষের রক্তের শ্বেতরক্তকণিকা বা নিউট্রোফিল এই ছত্রাকের বিরুদ্ধে মূল প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকে। সুতরাং, সংখ্যায় বা ক্ষমতায় এই শ্বেতরক্তকণিকা কমে গেলে (যেমন, ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড ব্যবহার) এই ছত্রাক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। একই কারনে এইডস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এই সংক্রমণের হার বেশি দেখা যায়।

আক্রান্ত অঙ্গের উপর ভিত্তি করে মিউকরমাইকোসিস রোগটি ৬ ধরনের হতে পারে। যথা: (1) রাইনো সেরেব্রাল- নাক, নাকের ও কপালের সাইনাস, চোখ ও ব্রেইন বা মস্তিষ্কে সংক্রমণ করে(2) ফুসফুসীয় (3) আন্ত্রিক- বা খাদ্য নালী(4) ত্বকীয় বা চামড়ায় (5) অভ্যন্তরীণ বা ডিসেমিনেটেড এবং (6) অন্যান্য ।

এই ছত্রাক মানুষের শরীরে শ্বাসনালী ও নাকের মধ্য দিয়ে, খাবারের সাথে বা ত্বকের কোন ক্ষত বা প্রদাহের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে থাকে। জ্বর, ক্ষুধামন্দা, মাথা ও চোখে ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, আক্রান্ত অঙ্গের ব্যথা ও কালো রং ধারণ করা, কাশি, কফ, নাকের পানি বা কফের সাথে কালো রক্ত বের হওয়া, পেটের ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। নাকের শ্লেষ্মা, কফ, চামড়া ও চোখ কালো রং ধারণ করে বলে একে কালো ছত্রাক নামে ডাকা হয়।

রোগের গতিবিধি, ভোগান্তি ও মৃত্যুহার
সুস্থ সবল একজন লোকের তার সারা জীবনে একবারও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বলতে গেলে শুন্যের কোঠায়। কিন্তু যখন তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তখন এর আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা শুরু না করলে চোখ নাক বা অন্য কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার জীবন বাঁচাতে শরীরের কোন অংশ অপারেশন করে ফেলেও দিতে হতে পারে। এই রোগে মৃত্যুহারও উদ্বেগজনক ভাবে বেশি। সঠিক চিকিৎসার অভাবে ৫০% থেকে ৮০% রোগী মৃত্যু বরন করতে পারে। আর অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ হলে মৃত্যুর হার ১০০% এর কাছাকাছি।

কোভিড মহামারীর সাথে সম্পর্ক

সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে কোভিড মহামারী দেখা দেওয়ার আগে কেউ এই রোগের নাম কমই জানত। এমনকি ভারতের বাইরে এখন পর্যন্ত অন্য কোথাও এই রোগীর খবর পাওয়া যায় নাই। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে দুজন রোগীর সম্পর্কে জানা যায় যারা বারডেম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা যান।

কোভিড ভাইরাসে আক্রান্ত কোন কোন রোগী দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকতে পারে। এতে যেমন তার অপুষ্টি হতে পারে তেমন তার শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যেতে পারে। তার উপর যোগ হয় অনেকদিন বা অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের ব্যবহার। ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট কিছু ঔষধের প্রয়োগ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অপরিচ্ছন্ন বা একই ফেসমাস্ক বারবার ব্যবহার করা, দীর্ঘ সময় অক্সিজেন এর হিউমিডিফায়ার আর ভেন্টিলেটর এর সঙ্গে থাকাও এই রোগের কারন হতে পারে। কোভিড এর চিকিৎসা চলাকালীন বা আরোগ্য হওয়ার সময়ে পোস্ট-কোভিড সিন্ড্রোমের অংশ হিসাবেই এই ছত্রাকের সংক্রমণ বেশি ঘটতে দেখা যায়।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
এই রোগ যেহেতু স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের হয়না, তাই জনমনে আতংক সৃষ্টি করা উচিত নয়। কোভিড, ডায়াবেটিস বা অন্য কোন কারণে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমতে দেয়া যাবে না। এন্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড এর ব্যবহারে খুব যত্নশীল হতে হবে। বিনা কারনে আর বেশিদিন এগুলি ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে। ডায়াবেটিসকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিকল্প নেই। পঁচা বাসি খাবার খাওয়া বা ঘরে রাখা যাবে না। আবাসস্থল বা হাসপাতালের বেড বা কেবিনকে নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে। পরিস্কার মাস্ক পরতে হবে, একই মাস্ক বারবার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ন রোগীদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের শুরুতে রোগ সন্দেহ করা ও নির্ণয় করা অত্যাবশ্যক। রোগী এবং চিকিৎসকের মনে রাখতে হবে এটা একটা রিপোর্টেবল ডিজিজ। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হবে। রক্ত পরীক্ষা, বুকের ও সংশ্লিষ্ট অঙ্গের এক্সরে, আল্ট্রাসনো, শ্লেষ্মা, চামড়া ও মাংসের টিস্যু বায়োপসি, সিটি স্ক্যান ও এম আর আই পরীক্ষা করাতে হতে পারে।

উচ্চ মৃত্যু হারের ভয় থাকায় সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা শুরু অত্যাবশ্যক। হাসপাতালে ভর্তি করে মাল্টিডিসিপ্লিনারি এপ্রোচ বা বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বোর্ডের মতামতের ভিত্তিতে চিকিৎসা করতে হবে। এক্ষেত্রে ছত্রাক বিরোধী ঔষধ বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ড্রাগ জরুরিভাবে শুরু করা ছাড়া উপায় নেই। মুখে খাওয়ার ঔষধ কার্যকরী না হওয়ায় ইঞ্জেকশন হিসাবে লাইপোসোমাল অ্যাম্ফোটেরিসিন বি ব্যবহার করতে হয়। পাশাপাশি ঝুঁকিসমূহ যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে আক্রান্ত অঙ্গে সার্জারী করতে হতে পারে বা কোন কোন সময়ে তা কেটে ফেলে দিয়ে জীবন রক্ষা করতে হতে পারে।

ইদানিং ভারতের মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রদেশে মারাত্মক কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যে নতুন করে দেখা দিচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস। দীর্ঘদিন রোগভোগ, অতিরিক্ত স্টেরয়েড ও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার, জলবায়ু ও অপরিচ্ছন্নতা এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করা হয়। ভারতজুড়ে আতংক সৃষ্টি হলেও শুরুতেই ভালোমতো চিকিৎসা করলে এই রোগকে দমন করে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। গত সপ্তাহে ভারতে কোভিড রোগীদের হোয়াইট বা শ্বেত ছত্রাক এবং ইয়েলো বা হলুদ ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দেয়ায় বাড়তি আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। কালো ছত্রাকের মতো শ্বেত বা হলুদ ছত্রাকের উপসর্গ ও চিকিৎসা একইরকম হলেও এগুলি আরও বেশি সংক্রামক ও ক্ষতিকারক। এব্যাপারে আতংকিত না হয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি বেসরকারি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশে ভারতের মতো ব্ল্যাক, হোয়াইট বা অন্য কোন ফাঙ্গাসের কোন মহামারীর কোন আশংকা আছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগা বা ঢিলেমি দেওয়া উচিত নয়। জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, অহেতুক গুজব বা আতংক ছড়ানো যাবে না। আশা করি সতর্কতা অবলম্বন করলে এই রোগ থেকে সবাই নিরাপদ থাকতে পারবে। তারপরও যদি সংক্রমণ ঘটে ভয়ের কোন কারন নেই। এই রোগের ঔষধ আমাদের হাতে রয়েছে, সঠিক ভাবে প্রয়োগ করে আমরা রোগীর আরোগ্য নিশ্চিত করতে পারব।

সহকারী অধ্যাপক
কার্ডিওলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top