রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


হাশরের দিনের গরম কেমন হবে


প্রকাশিত:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫৮

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ০৫:২৮

ছবি- সংগৃহীত

হাশর অর্থ সমবেত হওয়া, মহাসমাবেশ ইত্যাদি। কেয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হয়ে পৃথিবীর আদি-অন্ত সব মানুষ যে মাঠে সমবেত হবে ওই মাঠকে হাশরের মাঠ বা কেয়ামতের ময়দান বলা হয়। শরিয়তের পরিভাষায় কেয়ামত’ বলা হয় ওই দিনকে, যেদিন সৃষ্টিকুল ধ্বংস হবে, যেদিন লোকেরা তার রবের সামনে দাঁড়াবে। (রুহুল মাআনি: ৫/১২২)

কেয়ামত শুরু হবে আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে। প্রথম ফুৎকারে সব সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ফুত্কারের পর হাশর ও নশর তথা পুনরুত্থান ও মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হবে। এদিনই শেষ বিচারের দিন। সবাইকে এমন একটি ময়দানে সমবেত করা হবে, যেখানে সবকিছুই পরিবর্তিত। অথচ এই ময়দানটি হবে পৃথিবী। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর উপরিভাগে একটি চাদর আছে, একে পার্শ্ব ধরে টান দেওয়া হবে। ফলে গাছপালা, পাহাড়-পর্বত সাগরে পতিত হবে। অতঃপর সমতল হয়ে যাবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি (আল্লাহ) জমিনের উপরিভাগকে (বিচার দিবসে) উদ্ভিদশূন্য মাটিতে পরিণত করে দেব।’ (সুরা কাহাফ: ৮)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশও (পরিবর্তিত হবে) আর মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সামনে—যিনি এক, পরাক্রমশালী।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪৮)

সেদিন সূর্যকে এত কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে, প্রচণ্ড উষ্ণতায় কেউ কেউ তাদের ঘামের মধ্যে হাবুডুবু খাবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন মানুষের ঘাম ঝরবে। এমনকি তাদের ঘাম জমিনে ৭০ হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে এবং তাদের মুখ পর্যন্ত ঘামে ডুবে যাবে; এমনকি কান পর্যন্ত। (সহিহ বুখারি: ৬৫৩২)

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, মিকদাদ (রা.) বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, কেয়ামত দিবসে সূর্যকে মানুষের এত কাছে আনা হবে, তা মাত্র এক অথবা দুই মাইল ব্যবধানে থাকবে। সুলাইম ইবনু আমির (রহ.) বলেন, আমি জানি না উক্ত মাইল দ্বারা জমিনের দূরত্ব জ্ঞাপক মাইল বোঝানো হয়েছে, না চোখের সুরমা লাগানোর শলাকা বোঝানো হয়েছে। তিনি বলেন, সূর্য তাদের গলিয়ে দেবে। তারা তখন নিজেদের আমল (গুনাহ) অনুপাতে ঘামের মধ্যে হাবুডুবু খাবে। আর তা কারো পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত এবং কারো মুখ পর্যন্ত ঘাম পৌঁছে লাগামের মতো বেষ্টন করবে। এ কথা বলার পর রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর হাত দ্বারা মুখের দিকে ইশারা করেন, অর্থাৎ লাগামের মতো বেষ্টন করাকে বোঝালেন। (তিরমিজি: ২৪২১)

অর্থাৎ, বদকাররা তাদের পাপ অনুযায়ী সেদিন সূর্যের তাপে কষ্ট পেতে থাকবে। ফলে তাদের কারো কারো ঘাম গোড়ালি পর্যন্ত থাকবে, কারো হাঁটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত, কারো মুখ পর্যন্ত। (তিরমিজি: ২৪২১)

মানুষ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকবে। আল্লাহ সব নবীকে শীতল পানির হাউজ দান করবেন। সবচেয়ে বড় হাউজ হবে আমাদের নবীজির। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার হাউজে কাউসারের পরিধি হবে ইয়েমেনের আদন বন্দর থেকে আম্মানের বালকা শহর পর্যন্ত। পনির রঙ হবে বরফের চেয়েও সাদা, স্বাদ হবে মধুর চেয়েও মিষ্টি। পানপাত্র হবে আকাশের নক্ষত্রের মতো অসংখ্য। যে ব্যক্তি একবার হাউজে কাউসারের পানি পান করবে সে কখনও আর তৃষ্ণার্ত হবে না।’ (তিরমিজি: ২৪৪৪; ইবনে মাজা: ৪৩০৩)

যারা নবীজির আদর্শ মেনে চলেনি, নিজেদের মনমতো চলেছে, দ্বীনের ভেতর নতুন নতুন জিনিস সংযোজন করেছে, তারা এই হাউজ থেকে পানি পান করতে পারবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (স.) বলেন, ‘কেয়ামতের ময়দানে আমার উম্মতের এক দল লোক আমার হাউজের কাছে আসতে থাকবে, তবে তারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। আমি বলব, হে রব! এরা আমার উম্মত! তখন বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার পরবর্তীতে এরা কী বেদআত আবিষ্কার করেছিল!’ (সহিহ মুসলিম: ২৪৭)

সেদিন আরশের ছায়া ছাড়া অন্য ছায়া থাকবে না। সেই আরশের ছায়ায় সাত শ্রেণির মানুষ স্থান পাবেন। তারা হলেন ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক ও কর্তা। ২. ওই যুবক; যে তার যৌবনকাল প্রভুর ইবাদতে অতিবাহিত করে। ৩. ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে। ৪. ওই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পরে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে এবং এর ভিত্তিতেই তারা একত্র হয় ও পৃথক হয়। ৫. ওই ব্যক্তি যাকে অভিজাত বংশীয় সুন্দরী কোনো নারী আহ্বান করে আর জবাবে সে বলে- আমি আল্লাহকে ভয় করি। ৬. ওই ব্যক্তি যে গোপনে দান করে, এমনকি তার বাম হাতও জানে না তার ডান হাত কী দান করছে। ৭. ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।’ (বুখারি: ৬৬০; মুসলিম: ২৪২৭)

বুখারির এক দীর্ঘ হাদিস থেকে জানা যায়, মানুষ এই কঠিন পরিস্থিতিতে অসহ্য হয়ে নবীদের কাছে ছুটবে, যেন তাঁরা মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে সবাইকে এই কঠিন মুহূর্ত থেকে উদ্ধার করে এবং যাতে তাড়াতাড়ি বিচারকার্য শুরু হয়। কিন্তু কোনো নবীই মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার সাহস করবেন না। শেষ পর্যন্ত তারা মহানবী (স.)-এর কাছে এসে বলবে, হে মুহাম্মদ (স.), আপনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী। আল্লাহ তাআলা আপনার আগের-পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কিসের মধ্যে আছি?

তখন তিনি আরশের নিচে এসে তাঁর রবের সামনে সেজদায় পড়ে যাবেন। তারপর আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রশংসা ও গুণগানের এমন সুন্দর নিয়ম তাঁর সামনে খুলে দেবেন, যা এর পূর্বে অন্যকারো জন্য খোলেননি। এরপর বলা হবে, হে মুহাম্মদ (স.), তোমার মাথা ওঠাও। তুমি যা চাও, তোমাকে দেওয়া হবে। তুমি সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে। এরপর নবীজি (স.) মাথা উঠিয়ে বলবেন, হে আমার রব, আমার উম্মত। হে আমার রব, আমার উম্মত। হে আমার রব, আমার উম্মত। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মদ, আপনার উম্মতের মধ্যে যাদের কোনো হিসাব-নিকাশ হবে না, তাদের জান্নাতের দরজাসমূহের ডান পাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিন। এ দরজা ছাড়া অন্যদের সঙ্গে অন্য দরজায়ও তাদের প্রবেশের অধিকার থাকবে। তারপর তিনি বলবেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সে সত্তার শপথ! জান্নাতের এক দরজার দুই পাশের মধ্যবর্তী স্থানের প্রশস্ততা যেমন মক্কা ও হামিরের মধ্যবর্তী দূরত্ব, অথবা মক্কা ও বসরার মাঝে দূরত্বের সমতুল্য। (বুখারি: ৪৭২১ অবলম্বনে)

এভাবেই সেদিন নবীজি (স.)-এর সুপারিশে মানুষ কেয়ামতের বিচার-পূর্ববর্তী ভয়াবহ অবস্থা থেকে নিস্তার পাবে। তাই আমাদের উপলব্ধি করা উচিত, দুনিয়ায় কোটি কোটি মাইল দূরের সূর্যের তাপে যদি আমাদের এই বেহাল হয়, তাহলে কাল কেয়ামতের দিন কতটা ভয়াবহ হবে!

অতএব, আমাদের মহান আল্লাহর কাছে সকল গুনাহের জন্য তাওবা-ইস্তেগফার করা উচিত। নবীজির আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করা উচিত। এর বিনিময়ে আমাদের ইহকাল-পরকাল শান্তিময় হবে, চিন্তামুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top