সোমবার, ৭ই জুলাই ২০২৫, ২৩শে আষাঢ় ১৪৩২


ফেরাউনের ডুবে মরার ঐতিহাসিক মুহূর্ত: কোরআন ও হাদিসের আলোকে


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২৫ ১৬:৩৫

আপডেট:
৭ জুলাই ২০২৫ ২২:৫৯

ছবি সংগৃহীত

কিছু ইতিহাস শুধুমাত্র অতীতের গল্প নয়—বরং তা ভবিষ্যতের জন্য চিরন্তন সতর্কবার্তা। এমনই এক ঘটনা ফেরাউনের ডুবে মৃত্যু, যা কোরআন ও হাদিসে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে। ফেরাউনের শাস্তির এই দলিল মানুষের জন্য এক জাগরণী বার্তা যে, আল্লাহর সামনে কারো অহংকার চলে না, আর অবাধ্যতার ফলাফল হয় ভয়াবহ।

কোরআনের আলোকে ফেরাউনের পরিণতি
আল্লাহ তাআলা বলেন— ‘অতঃপর আমি বনি ইসরাঈলকে পার করে দিলাম সমুদ্রের। তখন ফেরাউন ও তার সৈন্যরা জুলুম ও শত্রুতার উদ্দেশ্যে তাদের পিছু নিল। অবশেষে যখন সে ডুবতে লাগল, তখন বলল— ‘আমি বিশ্বাস করলাম বনি ইসরাঈলরা যে আল্লাহতে বিশ্বাস করে, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আর আমি আজ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা ইউনুস: ৯০-৯২)

কিন্তু শেষ মুহূর্তের এই ঈমান কোনো কাজে আসেনি। কারণ, ঈমান তখনই গৃহীত হয়, যখন তা অন্তরের বিশ্বাস ও কর্মে প্রকাশিত হয়—শেষ নিঃশ্বাসে নয়।

মৃতদেহ সংরক্ষণের নিদর্শন
আল্লাহ তাআলা বলেন— ‘অতঃপর আজ আমি তোমার দেহকে উদ্ধার করব, যাতে তুমি পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো।’ (সুরা ইউনুস: ৯২)

এটি ছিল এক অলৌকিক ঘোষণা। সমুদ্র যেখানে জীবন কেড়ে নেয় এবং শরীরকে জলজ প্রাণির খাবারে পরিণত করে দিতে পারে, সেখানে আল্লাহ ফেরাউনের দেহকে নিদর্শন হিসেবে রেখে দিলেন, যাতে যুগে যুগে মানুষ শিক্ষা নিতে পারে।

ফেরাউনের শেষ মুহূর্তের কান্না ও আল্লাহর ন্যায়বিচার
জীবনের শেষ মুহূর্তে ফেরাউন চিৎকার করে উঠেছিল। সে চাইছিল রক্ষা, চাইছিল ক্ষমা, কিন্তু আল্লাহর দরবারে সেই আহাজারি গ্রহণযোগ্য হয়নি।

আল্লাহ বলেন— ‘আকাশ ও পৃথিবীর কেউ তাদের জন্য অশ্রুপাত করেনি এবং তাদেরকে অবকাশও দেওয়া হয়নি।’ (সুরা দুখান: ২৯-৩০)

এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রতি চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান; ফেরাউনের জন্য এটাই ন্যায়বিচার।

হাদিসে ফেরাউনের পরিণতি
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন— ‘ফেরাউন যখন ডুবে মরছিল, তখন সে বলেছিল— ‘আমি ঈমান আনলাম…।’ তখন জিবরাঈল (আ.) তার মুখে কাদা ঢেলে দিলেন, যাতে সে ঈমানের কথা শেষ করতে না পারে।’ জিবরাইল বলেন, ‘হে মুহাম্মদ! আপনি যদি আমাকে ওই সময় দেখতেন যখন আমি সমুদ্র হতে কালো কাদামাটি তুলে তার মুখে ঢালছিলাম যাতে আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ তাকে পরিবেষ্টন না করে।’ (তিরমিজি: ৩১০৭-০৮)

আল্লাহ ফেরাউনকে দুনিয়ার সবচেয়ে লজ্জাজনক মৃত্যু দিলেন—ডুবে মরার মধ্যেও শেষ কথার ঘোষণা তাকে বলতে দেয়া হয়নি।

কেয়ামতের দিনে ফেরাউনের যা হবে
‘ফেরাউন কেয়ামতের দিন তার জাতির অগ্রভাগে থাকবে। সে তাদের নিয়ে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করবে। যেখানে তারা প্রবেশ করবে, তা কত নিকৃষ্ট স্থান।’ (সুরা হুদ: ৯৮)

সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ প্রভু’ বলে দাবি করেছিল, সে হবে জাহান্নামের পথপ্রদর্শক।

ফেরাউনের মৃতদেহ নিয়ে তাফসির ও ইতিহাস
তাফসির: ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন— ‘আল্লাহ ফেরাউনের দেহ সমুদ্রতীরে নিক্ষেপ করেন, যাতে মানুষ দেখে নেয়—আল্লাহ কীভাবে শাস্তি দেন।’ (তাফসির ইবনে কাসির, সুরা ইউনুস: ৯২)

ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ: ১৮৮১ সালে মিসরের রাজকীয় সমাধি থেকে এক ফেরাউনের মমি আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে এটি কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। গবেষকদের ধারণা, এটাই সেই ফেরাউন, যার কাহিনি কোরআনে রয়েছে।

আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, মমিটির শরীরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে—ফুসফুসে জলাবদ্ধতা ও শ্বাসরোধের প্রমাণ মিলেছে। যা কোরআনের ঐতিহাসিক বর্ণনার সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে যায়।

ঘটনা থেকে গ্রহণযোগ্য শিক্ষা
অহংকারের পরিণতি ধ্বংস: ফেরাউন ছিল চরম অহংকারী; সে নিজেকে প্রভু দাবি করেছিল। তার শেষ পরিণতি ছিল লাঞ্ছনাজনক মৃত্যু।

শেষ মুহূর্তের ঈমান অকার্যকর: যখন মৃত্যু এসে দাঁড়ায়, তখন ঈমান ঘোষণা করা কোনো কাজে আসে না—এটি শুধু দুনিয়াবি বাঁচার চেষ্টা হয়ে পড়ে।

আল্লাহর নিদর্শন চিরকালীন: ফেরাউনের লাশ সংরক্ষণ কেবল ইতিহাস নয়, বরং আল্লাহর কুদরতের এক জীবন্ত নিদর্শন।

আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- ‘এটি কেবল একটি সতর্কবাণী, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা নাজম: ৪০)

ফেরাউনের ডুবে মৃত্যুর ঘটনা আজও জীবন্ত। প্রতিটি মানুষের জন্য এটি সেই জাগ্রত বার্তা, যেখানে মানুষ দেখে নিতে পারে যে- অহংকার, জুলুম ও আল্লাহর আদেশ অমান্যকারীর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

আসুন, আমরা এই ঘটনাটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর আনুগত্যে জীবন গড়ি। কারণ, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু আল্লাহর বিচারের দিন অনিবার্য।

সূত্র
সূরা ইউনুস, সূরা দুখান, সূরা নাজম
সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম
তাফসির ইবনে কাসির
মিসরের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও আধুনিক মমি বিশ্লেষণ

ডিএম /সীমা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top