শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১


নার্সারি ক্লাসের শিশুটিকে জানুন


প্রকাশিত:
২২ মে ২০২১ ২৩:২৪

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৬

ছবি: সংগৃহীত

এরা মূলত ২-৫ বছর বয়সের শিশু। স্কুলে যাওয়ার আগের ধাপ, এদের কাউকে লক্ষ্য করে হয়তো অভিভাবকেরা বলে বসেন, এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য কাঁদছো; পরে না যাওয়ার জন্য কাঁদবে। ছোট হলেও সে এখন অনেক ভুবনের বাসিন্দা।

পূর্বের তুলনায় প্রিস্কুল বয়সের শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে দেখা যায় প্রচুর তারতম্য। কেননা তার সামাজিক পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। নিত্যনতুন আভিজাত্যের পরশে শাণিত হচ্ছে সে। যার ফলে তার কথাবার্তা দিন দিন বদলাচ্ছে। এখন থেকে যে কোনো পরিস্থিতিতে হুামকির মুখে নিজের অবস্থান নিয়ন্ত্রণে রাখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সে সমর্থ। এভাবে সে খেলার মাঠে বা নার্সারিরুমে নিজেকে সালাম দেয়। বিকাশমান স্বাধীনসত্তা ও অন্তঃবহির্জগতে অনায়াস পদচারণার সীমাবদ্ধতা দু’য়ের এ দ্বন্দ্বই এ বয়সের মূল চালিকাশক্তি এবং টেনশনের কারণ। এমন করেই তার মাঝে টেনশন জেগে থাকে, যা বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে করে প্রভাবিত।

কতটুকু বাড়ে- স্বাস্থ্য কী রকম হওয়া উচিত: ২ বছর বয়সের শেষের দিকে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় কমে যায়। তেমনিভাবে শ্লথ হয়ে আসে মগজের বৃদ্ধি। এ সময় স্বাভাবিক নিয়মে তার খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা কম থাকে; কমে যায় খিদে। ২ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে একজন শিশু প্রতি বছর গড়ে ২ কেজি ওজন ও ৭ সেমি উচ্চতা লাভ করে। টোডলার বয়সের সেই পেটমোটা ভাব আর থাকে না বরং এখন তার স্বাস্থ্য কিছুটা লিকলিকে। তার কর্মচাঞ্চল্য অত্যধিক বেড়ে যায়। দৈনিক ঘুমের পরিমাণ কমে ১১-১৩ ঘণ্টার মতো হয়ে থাকে। ৩ বছর বয়সে ভিস্যুয়েল এক্যুইটি থাকে ২০/৩০ এবং ৪ বছর বয়সে ২০/২০। শিশুর সবক’টি প্রাইমারি টিথ বা দুধে দাঁত সচরাচরভাবে ৩ বছর বয়সের মধ্যে উঠে যায়। ৩ বছর পূরণের আগে বেশির ভাগ শিশু স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে হাঁটতে ও স্থিরতার সঙ্গে দৌড়াতে পারে। ন্যূনতম এটুকু ছাড়াও অনেক শিশু কোনো জিনিস ছুঁড়ে ফেলা বা তালুবন্দি করা, বলে লাথি মারা, বাইসাইকেলে চড়া, খেলার মাঠে উচ্চ কোনো স্থানে আরোহণ প্রভৃতি করতে পারে। কেউ বা নাচ ও আরও কঠিন কোনো কাজ সম্পাদনে সক্ষম হয়ে ওঠে। তবে এ পারাটা সব শিশুর জন্য সমান থাকে না। কেননা বুদ্ধি ও আবেগের বিকাশে পরিবেশের রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পরিবেশের বদৌলতে একে শিশুর দৈহিক ক্ষমতা ও কসরত বিভিন্ন প্রকারের হতে দেখা যায়। যে শিশু কর্মচঞ্চল, যার মধ্যে সমন্বয় গড়ে উঠেছে, শারীরিক ক্ষমতার বলে এবং পিতামাতাকে অনুসরণ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে যাওয়ার মতো কাজে সে কুশলতা প্রদর্শন করে। তুলনায় স্বল্প শক্তির শান্ত মেজাজের শিশুটি বেশির ভাগ সময় মাতা-পিতার সঙ্গে চুপচাপ কাটিয়ে দেয়।

শিশু খেতে চায় না- কী তার সমাধান: এ বয়সে পৌঁছে স্বাভাবিক নিয়মে যখন শিশুর খিদে আগের চেয়ে কমে যায় তা অনেক মা-বাবাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে মা-বাবা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শিশু যদি ওজনে ও উচ্চতায় ঠিক থাকে স্বাভাবিক বাড়ে, তবে তার খাবার সে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করছে কথাটি জানিয়ে এ সময় মা-বাবাকে আশ্বস্ত করতে হবে। মা-বাবার উচিত, এনিয়ে অহেতুক মাথা না ঘামানো। বরং শিশুর বয়স বিবেচনায় রেখে সময়ের অন্তর; স্থান ইত্যাদি চিন্তায় এনে সবসময় ক্যালরিসম্পন্ন পুষ্টিকর খাবার শিশুকে জোগানো হচ্ছে কিনা, সে বিষয়টির প্রতি মা-বাবাকে মনোযোগী হতে হবে। ঠিক কতটা পরিমাণ খাবার শিশু খাবে সেটি তার দায়িত্ব, সে নিজে তা নিয়ন্ত্রণ করুক। একজন শিশু সাধারণতঃ তার শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খিদে থাকা, না থাকার ওপর নির্ভর করে খাবার পরিমাণ নির্ধারণ করে। কোনো শিশুর দৈনিক আহারের পরিমাণে বেশ বড় রকমের গরমিল লক্ষ করা যায়, কিন্তু পুরো সপ্তাহ মিলে তার মোট খাবারে পরিমাণ প্রায়-ই ঠিক থাকে। মা-বাবার উচিত, যে সময়ে বা সপ্তাহের যে দিনগুলোয় সে খাবারে আগ্রহ দেখাচ্ছে, সে সময় উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন খাবার পরিবেশন করা, শিশুকে যখন-তখন চিপস, চকলেট ড্রিংকস খেতে না দেওয়া। শাকসবজি ডাল, চাল ও ডিম এসব খাবার একটু বেশি পরিমাণ সরিষা বা সয়াবিন তেল দিয়ে রান্না করে শিশুর খাবার সহজেই উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন করা যায়। কিন্তু তা না করে সম্পূর্ণ না বুঝে খাওয়ার জন্য মা-বাবা ও অভিভাবকের অতি নিয়ন্ত্রণ ও বাড়াবাড়ি শিশুকে তার খাবার গ্রহণের প্রাকৃতিক নিয়মে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হতে বাধা সৃষ্টি করে। তার ফল হয় মারাÍক। হয়তো শিশু মোটেও খেতে চায় না, মা-বাবা খাবারের প্লেট হাতে নেওয়া মাত্র তা দেখে সে পেছনের দিকে সরে যেতে থাকে বা অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের কারণে স্থুল শরীরের অধিকারী হয়।

শিশুকে চোখে চোখে রাখার প্রয়োজনীয়তা: এ বয়সের শিশু সদাচঞ্চল ও অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে থাকে বিধায় যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই এসব শিশুকে সর্বদা চোখে চোখে রাখার প্রয়োজন আছে। কেরোসিন, ইঁদুর মারার ওষুধ, রঙিন ওষুধের সিরাপ বা ট্যাবলেট দেখে প্রলুব্ধ হয়ে খেয়ে ফেলার কারণে পয়জনিং হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই মা-বাবা ও অভিভাবকের উচিত, এ ধরনের জিনিস যেন শিশুর নাগালের বাইরে থাকে সে ব্যবস্থা করা, বিপজ্জনক যে কোনো পরিস্থিতি হতে তাকে দূরে রাখা। বিশেষত কোনো শিশুর দুরন্তপনা অতিমাত্রার হয়ে থাকলে তার জন্য নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা একান্ত কর্তব্য।

বাকশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি ও খেলাধুলা- এ তিনটি ক্ষেত্র এ বয়সের শিশুর বিকাশে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; কেননা এসবের সাহায্যে পৃথিবীটাকে সে নিত্যনতুনভাবে জানার সুযোগ পায়। বিশ্বপরিচয়ের দ্বার যায় খুলে। প্রতিদিনের সূর্য- ‘কে তুমি’ সম্বোধনে হয়তোবা বৎসর বৎসর ধরে তাকে জাগায়।

বাকশক্তি ও ভাষাজ্ঞান অর্জন একদণ্ড কথা না বলে থাকতে পারে না: শিশুর ২ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে বাকশক্তির যেরূপ বিকাশ ঘটে থাকে, তা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে হয়ে থাকে। তার শব্দভাণ্ডার ৫০-১০০ থেকে একলাফে বেড়ে প্রায় ২০০০-এর সীমানা অতিক্রম করে। ‘৫ বৎসর বয়সের মিনি একদণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না’- রবীন্দ্রনাথ সত্য বলেছেন। মুখে যেন কথার খই ফোটে বিশেষত কন্যা সন্তানটির। এতকাল সে ব্যবহার করতো ২ বা ৩ বাক্যাংশ নিয়ে গঠিত বাক্য। বর্তমানে সে ব্যাকরণের প্রায় সবক’টি মৌলিক নিয়ম বাজায় রেখে বাক্যগঠন করতে সক্ষম। তবে তার কথাবার্তা বলার মধ্যে যে দিকটি চমকপ্রদ, তা হচ্ছে- বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শব্দচয়ন ও শব্দোচ্চারণের অভূতপূর্ব ক্ষমতা, যার দ্বারা সে মনের কথাটি ঠিকঠাক জানিয়ে দেয়। বোঝার ক্ষমতা ও তার বাচনিক প্রকাশ ও দুইয়ে সে এখন সব্যসাচী। একেই বয়সের শিশু বলতে পারার চাইতে বোঝার ক্ষমতায় প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করে। যে কারণে কোনো শিশুর বাকস্ফুরণ ওই বয়সের তুলনায় স্বাভাবিক আছে কিনা নির্ণয়ের জন্য দ্বিতীয়টির গুরুত্ব অধিক ধরা হয়। তাছাড়া কোনো শিশুর মধ্যে বলতে পারার সমস্যা দেখা গেলে তার চিকিৎসা কোনো শিশুর ভাষাজ্ঞান অর্জনের সমস্যার চেয়ে সাধারণভাবে সহজতর বলে মনে করা হয়।

মুখের ভাষা ফোটাতে ঘর ও বাইরের প্রভাব: নিজস্ব গুণে ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে পড়ে শিশুর ভাষা শিক্ষার শুরু। পরিবারে বড়রা কীভাবে শিশুর সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, তাকে কোনো প্রশ্ন করা বা আদেশ দেওয়ার ধরন কী রকম, ঘরে বিরাজমান সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং একজন শিশুকে কথা বলতে শেখানোর প্রচেষ্টায় কতটা সময় দেওয়া হচ্ছে- এসব কিছুর সমন্বয়ে শিশুর বাকশক্তি ও ভাষাজ্ঞান বিকশিত হয়। এ ব্যাপারে শিশুরা কেবল বড়দের অনুকরণ করে না বরং তাদের ব্যবহƒত বাক্যের ব্যাকরণ সিদ্ধতা বুঝে নেয়, ধীরে ধীরে তা পরিবর্তন ও পরিশীলিত করে, বলা যেতে পারে তা আÍস্থ করে এবং এভাবে কথা ও ভাষাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে।

যদিও ভাষাজ্ঞান অর্জনের জন্য ভাষাশিক্ষার গুরুত্ব অনেক, তবুও তার মূল ছাঁচটি মগজে ধরা থাকে- এ রকম প্রমাণিত হয়েছে। ব্যাকরণের প্রয়োজনীয় ও মৌলিক নিয়মনীতি মেনে ভাষা তৈরির এক অনবদ্য সৃজনশীল ব্রেইন সঙ্গে নিয়ে প্রত্যেক শিশু জন্মগ্রহণ করে।

সময়মতো কথা বলতে শেখার সুফল: কোনো শিশুর মুখে সময়মতো ভাষা ফুটলে তা ওই শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগ অনুভূতির গঠনে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। বলা হয়, তা ওই কাজে পালন করে নিখুঁত ব্যারোমিটারের দায়িত্ব। মানসিক প্রতিবন্ধী কোনো শিশুর অন্যান্য পূর্ব লক্ষণগুলো মা-বাবা ও অভিভাবক তেমন পাত্তা না দিলেও, ২ বছর বয়সি কোনো শিশু যখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শেখে না, তা কখনো কখনো শিশু ও ধরনের অসুখে আক্রান্ত কিনা তাদের কাছে প্রথম লক্ষণ হিসাবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে শিশু নির্যাতন বা শিশুর প্রতি অযত্ন অবহেলা শিশুর কথা বলা ও ভাষাজ্ঞান অর্জনে বাধা দেয়, পরবর্তী সময়ে যা শিশুর আচার আচরণ, সামাজিকতা ও মেধাশক্তির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বড়দের মুখে ভাষা শুনে শুনে শিশু আÍস্থ করে; কানে শোনা স্বর মনের গহিনে নিয়ে বারবার আওড়ায় এবং এভাবে বড়দের উচ্চারিত শব্দ ভাষা ও আচরণ সে নিজের মধ্যে রপ্ত করে নেয়। ভাষার মাধ্যমে শিশু তার রাগ, ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করতে শেখে না, ভবিষ্যতে তাদের আচরণে এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থ ভাব থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

নার্সারি বয়সের শিশুটির বাকশক্তি ও ভাষাশক্তির এই যে দখল, তা তার পরবর্তী স্কুলজীবনে সাফল্য নির্মাণ করে। পড়তে ও লিখতে পারাটা যদিও এ বয়সের মুখ্য অর্জন হিসাবে গণ্য করা হয়, কোনো শিশুর ভাষাজ্ঞান তৈরির ভিতটা এই প্রিপারেটরি স্কুল বয়সে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। এমন বয়সের শিশুকে কোনো ছাপানো বর্ণ বা শব্দ বারবার দেখানো হলে সে লেখার উপকারিতাগুলো যেমন- গল্প বলতে পারা বা সংবাদ প্রেরণ ইত্যাদি জানতে পারে। এ ছাড়া লেখার কিছু কিছু নিয়ম যেমন- বাম থেকে ডানে; উপর থেকে নিচে লেখা এ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে যায়।

শিশুর মুখে ভাষা ফোটাতে মা-বাবা অভিভাবকের করণীয়: ছবি-আঁকা বই শিশুর বাকশক্তি বিকাশে ও মুখের ভাষা তৈরিতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে শিশুকে পড়ানো হলে শিশু ছাপানো বর্ণের সঙ্গে সহজে পরিচিত হয়ে ওঠে ও তা মুখের ভাষা ফোটাতে সাহায্য করে। আওয়াজ করে কিছুটা সুরের সঙ্গে শিশুকে পড়তে দিলে শিশুর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। এরপর কিছুটা অনুরোধের সঙ্গে কোনো একটা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা যায়- ওটি কী? তখন শিশুকে এই বলে ফিডব্যাক করা যেতে পারে- হ্যাঁ; এটি একটি বেড়াল। এভাবে ওই পড়ার বিভিন্ন পর্যায়ে এ প্রশ্নোত্তর ফিডব্যাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। কিছু পরে শিশুকে প্রশ্নের ধারাটি আরও বর্ণনামূলক ও সামান্য কঠিনভাবে করা যেতে পারে যেমন- বেড়ালটি কী রঙের বা বেড়ালছানাটি কী করছে। এভাবে পড়াতে শিশুর আগ্রহ জন্মিয়ে, তার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, ফিডব্যাক দিয়ে, পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে ধীরে ধীরে কঠিন থেকে কঠিনতর কর্মে শিক্ষাদান শিশুর ভাষাশিক্ষার আদর্শ পদ্ধতি রূপে গণ্য হতে পারে।

শিশুর চিন্তাভাবনার ধরন: প্রিস্কুল বয়সের শিশু মূলত প্রিলজিক্যাল পর্বে অবস্থান করে। এ পর্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জাদুকরি ভাবনা, সামান্য স্বার্থপরতা এবং চিন্তা চেতনায় ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রাধান্য। সব জিনিসকে নিজের করে পাওয়ার অদম্য বাসনা ও ইচ্ছাশক্তি বিষয়ে যাবতীয় কাল্পনিক বিশ্বাস নিয়ে তার জাদুকরি ধারণাগুলো তৈরি হয়। মানুষ ছাতা মেলে ধরার কারণে বৃষ্টি নামে কিংবা ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার জন্য সূর্য অস্ত যায়- এসব কথা তাকে বিশ্বাস করানো যায়। ঠিক স্বার্থান্ধতার জন্য নয়, বরং অন্যের মনোভাবটি না বোঝার কারণে তার আচরণে কিছুটা স্বার্থপর ভাব ফুটে ওঠে। নিজের অতিপ্রিয় খেলনা বা জিনিস হাতে তুলে দিয়ে এ বয়সের শিশুটি কখনো কখনো বয়স্কজনকে সান্ত্বনা জোগাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের সিরিজে প্রমাণিত হয়েছে নার্সারি ক্লাসের শিশুর মধ্যে যুক্তির চেয়ে ইন্দ্রিয়ানুভূতির জোর বেশি প্রবল থাকে। যেমন- পানিভর্তি খানিকটা লম্বা অথচ সরু একটি পাত্র ও চ্যাপ্টা থালার মধ্যে কোনটিতে বেশি পানি আছে, জিজ্ঞেস করা হলে সচরাচরভাবে সে যে পাত্রটি বড় মনে করে (এক্ষেত্রে লম্বা সরু পাত্রটি) তাতে বেশি আছে বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়। এভাবে প্রাকৃতিক মায়াতে সে ভ্রম করে এবং শেখে। তবে এখনো পর্যন্ত একই অবস্থার বিভিন্ন দিক দেখতে পারার মতো উপলব্ধি তার হয়নি।

খেলাধুলার বৈশিষ্ট্য কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা: নার্সারি ক্লাসের শিশু নতুন নতুন চিন্তা ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে তার খেলাধুলাতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। এখন সে আগের সহজ সাধারণ খেলাগুলো জটিলতার বিন্যাসে সাজিয়ে খেলতে ভালোবাসে। ২ থেকে ৩ বছর বয়সে কিছু সওদা করা কিংবা পুতুলকে ঘুম পড়াচ্ছে এমনতরো খেলার আনন্দে মেতে থাকতো, ৩ থেকে ৪ বছর বয়সে পৌঁছে চিড়িয়াখানায় দেখতে পাওয়া কিংবা দূর ভ্রমণে যাওয়ার পথে দেখা বিভিন্ন দৃশ্যকল্পের চিত্রনাট্য খেলাতে পর্যবসিত করে। ৪-৫ বছর বয়সে কল্পনার ভেলায় চড়ে দূর চাঁদের দেশে বেড়িয়ে আসা এবং ও রকম অনেক কিছুতে মগ্ন হয়ে যাওয়ার মতো সাজানো খেলাতে সে অনুক্ষণ ডুবে থাকতে পারে- ‘যেন কোথাও আমার হারিয়ে যেতে! নেই মানা মনে মনে।

শিশুর কাজকর্মে সামাজিকতা: প্রিস্কুল বয়সে শিশুর সামাজিক ক্রিয়াকলাপে অভূতপূর্ব উন্নতিযোগ ঘটে থাকে। ১-২ বছর বয়সে সে প্রায়শ একা একা খেলতো, তখন খেলার সঙ্গী থাকে না তেমন কেউ। ৩-৪ বছর বয়সে বন্ধুর সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করে দু’বন্ধুতে ভাব হয়, দুজনে মিলে কিউবের সাহায্যে গম্বুজ বানাতে বসে যায়। আরও একটু বেশি বয়সে দলবেঁধে খেলনায় মেতে ওঠে, কখনো বা একজনকে একেক ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দিয়ে ঘর-সংসার খেলতে চায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে তার মধ্যে খেলার নিয়মনীতি মেনে চলার দৃঢ় ভাবটি গড়ে ওঠে। প্রথমদিকে খেলার ব্যাপারে নানা জিজ্ঞাসা নানা প্রশ্ন করতে ব্যস্ত থাকতো বেশি, ২-৩ বছর বয়সে খেলার সাথীর মনোভাব মেনে নিয়ে বা ভাগ করে নিয়ে খেলে, ৪-৫ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো মনোযোগী হয়ে ওঠে খেলার নিয়ম মেনে চলার বিষয়টি, যদিও সে নিজেই মুহূর্তে মুহূর্তে নিয়ম পাল্টাতে থাকে। কিন্তু ৫ বা তার বেশি বয়স হলে সে খেলার নিয়মের অলঙ্ঘনীয়তা দৃঢ়চিত্তে গ্রহণ করে।

খেলাধুলার উপকারিতা: খেলতে খেলতে আঁকিবুঁকি ও নৈতিকতা: কীভাবে বিপদের মোকাবিলা করতে হয়, বড়দের মতো দায়িত্ব জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, শাসিত না হয়ে বরং প্রভুত্ব অর্জন করা (যেমন- পুতুলকে শাসানো, বকুনি দেওয়া, চড় মারা) ইত্যাদি শিক্ষা খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিশু পেয়ে যায়। ডাইনোসর বা সুপার হিরো এ জাতীয় সুপার পাওয়ার এর সান্নিধ্য ভালোবাসে, কখনো বা মনে মনে ও রকম কাউকে বন্ধু বানিয়ে অবাস্তব চিন্তার জগতে পাড়ি দেয় বা দৃশ্যনাট্য তৈরি করে। ড্রয়িং, পেইন্টিং ও অন্যান্য কলাবিদ্যাতে এ বয়সের শিশুর মাঝে সৃজনশীল নিপুণতার পরিচয় মেলে যা নার্সারি বয়সের শিশুর জন্য খেলাধুলার অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত। এসব আর্টের মধ্য দিয়ে শিশুর অন্তরের সেসব ইচ্ছাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মূর্ত করে তোলার প্রয়াস পায় যা সে শারীরিক বা ইন্দ্রিয়ানুভূতির দ্বারা আয়ত্তে আনতে পারে না। এ সময় তার মাঝে নৈতিকতার কিছু কিছু ছাপ লক্ষ করা যায়। যা তার বুদ্ধি ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথমদিকে সে একবার যা ভালো বা মন্দ মনে করে তাই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করে। এভাবে ২ বছর পূরণের আগে প্রায় সব বিষয় সে একচক্ষুতে বিবেচনা করে। ২ বছর উত্তীর্ণ হলে অন্যের প্রতি নমনীয় হতে শেখে, সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে অন্যকে বিবেচনা করতে চায়। তথাপি পুরো প্রিস্কুল বয়সে শিশু অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাধারা বলে যে একটা জিনিস আছে তা বোঝে না।

মাতা-পিতার রুটিন দায়িত্ব-কর্তব্য ও যেসব বিষয়ে সচেতন থাকা আবশ্যক: সঠিক সময়ে শিশু কথা বলা শিখলো কিনা, মুখের ভাষা তৈরি যথাযথ হচ্ছে কিনা তার প্রতি নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কেননা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আচার-আচরণ ও পরবর্তী স্কুলজীবনের সাফল্যে এ অংশটির স্বাভাবিক বিকাশ মূল চাবিকাঠি হিসাবে কাজ করে। যেসব শিশুর বাকশক্তি ও ভাষা তৈরির ক্ষমতা সময়মতো হচ্ছে না শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আগেভাগে চেয়ে তা প্রতিরোধের চেষ্টা শিশু যত্নের এক অপরিহার্য অংশ।

শিশুর আবেগ অনুভূতি প্রকাশের জন্য সঠিক শব্দটি নির্বাচন করে দিয়ে মা-বাবা ও অভিভাবক তাকে সাহায্য করতে পারেন। বস্তুতপক্ষে, মা-বাবার উচিত, শিশু যেন তার আবেগ আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করার চেয়ে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করতে শেখে, সে চেষ্টা চালানো। প্রতিদিন শিশুকে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বইপড়া বা ছবিতে চোখ বুলানোর অভ্যেস করানো মা-বাবার রুটিন কর্ম হিসাবে নেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে শিশু চিকিৎসক যথাযথ ছবির বই নির্বাচনে ও যাবতীয় তদারকিতে মা-বাবাকে সাহায্য করতে পারেন। পরিবারের এ বয়সের শিশুদের এক সঙ্গে বসিয়ে সমন্বয়ের পড়তে বলাটা খুব কাজের হয়।

শিশু ভয় পায় কেন, কীভাবে ভয় ভাঙবেন: প্রিস্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৮০% মা-বাবা কোনো একটিতে এবং প্রায় ৫০% মা-বাবা ৭ বা ততোধিক বিষয়ে শিশুর ভয় পাওয়ার কথা বলে থাকেন। স্নান করতে রাজি না হওয়া বা টয়লেটে বসতে না চাওয়া একধরনের ভয় থেকে হয়ে থাকে এ ভেবে যে, সে সময় হয় সে ভেসে যাবে বা ফ্লাশ করলে নিচে তলিয়ে যাবে। ঘটনা পূর্ব চিন্তা থেকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বস্তুর সাইজ ও সামর্থ্য সম্বন্ধে সম্যক ধারণা না আসাতে তা মনে এ রকম ভয় বাসা বাঁধে। একই কারণে অনেক শিশু সামান্য সূঁচকে বিশাল ত্রিশূল মনে করতে পারে যখন ভাবে এটি বেলুনের মতো তাকেও ফুটো করে দেবে।

এসব ব্যাপারে মৌখিক আশ্বাস যথেষ্ট নাও হতে পারে। তাকে তখন কোনো পুতুল বা কারো উপর বরাবর প্রয়োগ করে বিশ্বাস জন্মাতে হবে।

শিশুর মনোবৃত্তি- সর্বত্র স্বরাজ কায়েমের বাসনা: দু’ধরনের পরিস্থিতিকে সামাল দিতে দিতে প্লেগ্র“প বয়সি শিশুর ভাবাবেগ গড়ে ওঠে। এর একদিকে আছে শিশুটির আচার-আচরণ ঘর ও পরিবেশের কাছে ঠিক কতটা পরিমাণ গ্রহণযোগ্য সে বিষয়টি এবং অন্যদিকে আছে তার নিজের ভেতরকার চালানশক্তি যাতে কিছুটা পরিমাণ অহং মিশে আছে। সবকিছুতে নিজের প্রধান্য বিস্তারের বলতে গেলে, এক প্রকারের স্বরাজ কায়েমের উগ্র বাসনা বলবৎ থাকে। যৌন অনুভূতি ও বয়স্কজন কিংবা সমবয়সি সাথীদের সঙ্গে অহরহ ঘটতে থাকা বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রভাব পড়ে তার মাঝে। এ বয়সের শিশুর আবেগ-অনুভূতি হচ্ছে এ দুইয়ের দ্বান্দ্বিক পরিণতি। ২ বছর বয়সের একজন শিশুকে মাত্রাতিরিক্ত দুরন্তপনা থেকে নিবৃত্ত করে রাখে বাইরের শাসন। কিন্তু ৫ বছর বয়সে এসে শিশু স্বশাসনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এভাবে সে ক্লাসরুমের কাজকর্মে মনোনিবেশ করে, শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তবে শিশুর এ উন্নতি সাধন যেসব বয়স্ক ব্যক্তি বিপদে ভেঙে পড়েন না, বরং ধৈর্যের সঙ্গে সংযতচিহেলাফেরার মনে না করে; তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের না ভাবে ও নিজের মূল্য সে আবিষ্কার করে নিতে সমর্থ হয়।

শিশুকে নিয়ন্ত্রণ অতি কড়াকড়ি বা লাগামহীন ছেড়ে দেওয়া দুটোই ভুল: ত্ত থাকতে পারেন তাদের ভাবমূর্তি দেখে দেখে অনুসরণ করেই হয়ে থাকে। বড়দের উচিত, শিশুর সঙ্গে এমনতরো আচরণ করা যাতে সে নিজেকে এ পর্যায়ে শিশু তার কোন কোনটি আচার-ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে তা জেনে যায়। সে জন্য সে মাঝে মধ্যে বড়দের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে থাকে। সে যখন দেখে, প্রতি মুহূতেই তার উপর নজর রাখা হচ্ছে অথবা যাচ্ছে তাই করে বেড়ালেও তাকে কেউ কিছু বলছে না- দু’রকম অবস্থায় তার মধ্যে বড়দের গ্রাহ্যশক্তি পরখ করে দেখার বাসনা বাড়ে। কিন্তু তার এসব পরীক্ষামূলক কর্মকাণ্ড কখনো কখনো মা-বাবার ক্রোধের কারণ হয়ে উঠতে পারে কিংবা এসব করতে গিয়ে মা-বাবা যদি মনে করেন, তাদের সন্তান ক্রমশ তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তবে তা যথেষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এ বয়সের শিশুর যত্নে তার প্রতি অত্যধিক কড়াকড়ি আরোপ ক্ষতিকর। কেননা এতে করে তার সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনিভাবে তাকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেওয়া ভয়ংকর ভুল। সে যখন দেখে, সবকিছু সে ইচ্ছেমতো করতে পারছে, কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; তাকে সামাল দেওয়ার নেই কেউ, তখন তার মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে।

শিশু বদমেজাজি হয় কেন: এ বয়সের শিশুকে সঠিকভাবে পরিচালনা করাটাই হচ্ছে আসল ব্যাপার। সুনিয়ন্ত্রণের অভাবে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- বলার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটি কিনে না দেওয়া হলে কিংবা কোন খান থেকে চলে যাওয়ার প্রশ্নে রাজি করাতে না পারলে তার মধ্যে বিপুল ক্রোধ জন্ম নেয়। তখন সে এমন বদমেজাজি আচরণ শুরু করে দেয় যা সহ্যের বাইরে চলে যেতে পারে। কোনো কিছুতে ভয় পাওয়া, ভীষণ ক্লান্তি কিংবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে সে এ ধরনের ক্ষিপ্ত আচরণ করে থাকতে পারে। শিশুর আবদার ও চাহিদা সময় সময় পূরণ করে, মাঝে মাঝে তাকে দু-একটি পুরস্কার জুগিয়ে তাকে এ রকম বদমেজাজি হওয়া থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। তবে কোনো শিশুর বদমেজাজ অবস্থাটি যদি একনাগাড়ে ১৫ মিনিটের অধিক স্থায়ী হয় কিংবা নিয়মিতভাবে দৈনিক ৩ বারের বেশি হতে থাকে তবে তার কারণ হিসাবে কোনো অসুখ, সামাজিক সম্পর্কের টানাপোড়েন বা মানসিক নিপীড়ন ইত্যাদি আছে কিনা তলিয়ে দেখা উচিত। সাধারণভাবে শিশু ১ম বছরের শেষের দিকে কিছুটা বদমেজাজি হয়ে ওঠে এবং তার ২ থেকে ৪ বছর বয়সের মধ্যে তা তীব্র রূপ ধারণ করে। তবে শিশুর বয়স ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর এ রকম অবস্থা যদি বার বার দেখা যায়, সেক্ষেত্রে তা তার পুরো শৈশবকালজুড়ে বজায় থাকার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।

যৌন অনুভূতি: ম্যাস্টারবেশন, নিজ ও বয়স্কদের যৌনাঙ্গের প্রতি কিছুটা কৌতূহল থাকা এ বয়সের শিশুদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। শিশুর ৪-৬ বছর বয়সের মধ্যে এ সম্বন্ধীয় লজ্জা, শালীনতা, নম্রতা ইত্যাদি ভাব জেগে ওঠে। তবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে ফ্যামিলি বা সামাজিক কালচারের উপর। কিন্তু ম্যাস্টারবেশন বা যৌনতা যদি খুব প্রবল হয়, যা এ বয়সের শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করে তবে তার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।

একটি ছোট মানুষ তাহার একশো রকম রঙ্গতো,
এমন লোককে একটি নামেই ডাকা কি হয় সঙ্গত?
নার্সারি বয়সের শিশুটি তার পিতামাতাকে বিভিন্ন রকমের আবেগ ও অনুভূতির সাহায্যে পরখ করে। প্রগাঢ় ভালোবাসায় আপন করে নিতে চায়। অন্য কারো প্রতি মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা প্রদর্শনে সে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তার প্রতি পিতামাতার কোনো অবহেলা সে মেনে নিতে পারে না। পিতামাতার আচরণে তাকে অপমান করার সামান্য উপাদানও সে সহ্য করতে পারে না। তবে ভীষণ রেগে গিয়ে পিতামাতা তাকে ছেড়ে চলে যাবে কিনা সে ভয়টি তার মনে বজায় থাকে। শিশুর আবেগ-অনুভূতির এত রং, তার এত ওঠানামা যা প্রায়শ তার পক্ষে যথাযথ প্রকাশ করা বা বিশ্লেষণ করে দেখানো সম্ভব হয় না। ফলে তার প্রকাশভঙ্গি হাজারও মুডের হয়ে থাকে। যে যা চায় তা বোঝাতে না পারার যে দুঃসহ বেদনা তা কাটিয়ে উঠতে কখনো বা বছর খানেক সময় লেগে যেতে পারে। এ সময়টিতে তাই তার বাহ্যিক আচরণে বজায় থাকে প্রভুত্ব ভাব যা কোনো কোনো পিতামাতা তাদের সন্তান তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাচ্ছে বলে মনে করতে পারে। পরবর্তী সময়ে শিশু যখন খেলাধুলাতে মেতে ওঠে, ভাষাতে দখল পেতে শুরু করে এবং মনের কথাটি মা-বাবাকে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়ে ওঠে তখন পূর্বের ওসব অসুবিধা দূর হয়ে যায়। নিজের বাসনাকে ব্যক্ত করতে না পারার দুর্মর বেদনায় সে আর গুমরে মরে না, বরং সে এখন মা-বাবার সঙ্গে একসঙ্গে অনেক আনন্দ উপভোগ করতে পারে।

শিশুকে গড়ে তোলার কাজে দুশ্চিন্তা পরিহার করুন- প্রয়োজন শুধু মা-বাবার হƒদয় দিয়ে দেখাশুনা: এ বয়সের শিশু সন্তানকে কোনো না কোনো পর্যায়ে পিতামাতা ঠিক যেন চিনে উঠতে পারেন না। ক’মিনিট পূর্বে অসম্ভব রকমের নতজানুভাব থাকে তো, পরক্ষণে তার আচরণে ফুটে ওঠে স্বাধীন স্বাবলম্বীতার ছাপ, কখনো নিতান্তই কোলে অবুঝ শিশুর মতো কান্নাকাটি করে; আবদার জানায়, কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মুখে ফোটে চমকে দেওয়ার মতো শব্দ ব্যবহারের ফুলঝুড়ি। এ যদি সে দেবদূতের মতো নিষ্পাপ অভিব্যক্তিতে আনন্দময় নৃত্য করতে থাকে কিছু পরে তার ব্যবহারে জেগে ওঠে বেয়াড়া ভাব দস্যুবৃত্তি। শিশুর আচার ব্যবহারের এতশত রূপ মা-বাবাকে বিস্মিত করে, সারা দিন উৎকণ্ঠিত রাখে, তাদের বিশ্বাস লোপ পায় এবং সময়ে সময়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারে। তবে এ নিয়ে অযথা চিন্তা না করে শিশুকে যথাযথ আচার ব্যবহার শেখানোর মাধ্যমে মা-বাবা প্রার্থিত সুফল পেয়ে যাবেন। এজন্য মা-বাবার বিশেষ ট্রেনিং গ্রহণের প্রয়োজন নেই, শুধু মা-বাবার হƒদয় দিয়ে শিশুকে দেখাশুনা করলেই হবে। যার মধ্যে ক্রোধ থাকবে, অনুতাপ থাকবে, বিভ্রান্তি থাকবে- এসব কিছুই মিলে মা-বাবার মন, এসব কিছুই স্বাভাবিক এবং শিশুকে নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন লাঘব করার উপায়।

শিশুর যে কোনো সমস্যা শিশু চিকিৎসককে অবহিত করুন- কোনো কিছুই গোপন না করা শ্রেয়: কোনো কোনো পিতামাতা শিশুর আচার আচরণ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত থাকার পরও শিশু বিশেষজ্ঞকে তা অবহিত করেন না। তা ঘটে হয় চরম হতাশা থেকে, নয়তো এ ভেবে যে, এতে শিশু চিকিৎসক কোনো সাহায্য করতে পারবেন না। প্রকৃতপক্ষে শিশু চিকিৎসক মা-বাবাকে স্মরণ করিয়ে দেন, যেন শিশুর আচরণের এসব দুর্বলতা তাকে জানানো হয়। কেননা শিশুর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় তা এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোনো কোনো সময় এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব কঠিন হয়ে থাকে যে, নির্দিষ্ট শিশুটির আচার ব্যবহার স্বাভাবিক হচ্ছে কিনা নাকি সত্যিকার অর্থে তাতে কিছু সমস্যা রয়েছে। এটি আরও জটিল ও বিপদের নিশানা আঁটা হয়ে পড়ে, যখন মা-বাবা তাদের সন্তান সম্পর্কে সঠিক অবস্থাটি জানতে দেয় না। শিশু বদমেজাজি কিনা বা তার উপর শারীরিক নির্যাতন হয় কিনা অধিকাংশ মা-বাবা এসব চেপে যান। শিশুর যে কোন দীর্ঘমেয়াদি অসুখ তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ না হওয়া, পরিবারে বিভিন্ন টানাপোড়েন সম্পর্ক প্লে গ্রু“প বয়সি শিশুর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সে কারণে শিশুকে পরীক্ষা করার সময় শিশুচিকিৎসক এ নিয়ে বিশদ খোঁজ নিয়ে থাকেন এবং প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে নিতে উপদেশ দিতে পারেন।

শিশুকে কীভাবে শাসন করবেন- মারধর করা কতটা যুক্তিযুক্ত: শিশুকে শাসনের কাজে অনেক সমাজে শারীরিক শাস্তির বিধান প্রচলিত আছে। কিন্তু একটি আধুনিক পরিবারের কোনোমতেই তা আর মানানসই বলা যাবে না। যদিও শিশুকে শাসন করতে গিয়ে সামান্য চড়-থাপ্পড় মারাতে তেমন বিশেষ ক্ষতি হয় বলে জানা যায়নি, তবুও মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের মনে রাখা উচিত, শারীরিক প্রহার হচ্ছে শিশুকে শাসনের শেষতম অস্ত্র। অনেক মা-বাবা বলে থাকেন, তারা শিশুকে ঠিক থাপ্পড় মারতে চাননি কিন্তু অন্য কোনো কিছুতে কাজ না হওয়ায় এক রকম বাধ্য হয়েই তা করে ফেলেন। চড়-থাপ্পড়ে যে বিশেষ কোনো সাফল্য আসে না এক্ষেত্রে মা-বাবাকে অনুধাবন করতে হবে। জানতে হবে, এ রকম শাস্তি ঘন ঘন প্রয়োগের আসল অসুবিধা কোথায়। যেমন- যে শিশু প্রতিনিয়ত চড়-থাপ্পড় খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাকে শাসনের কাজে কখনো বা আরও বড় ধরনের শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় নিতে হতে পারে। যা হতে শিশু মারাÍক আহত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। মা-বাবার বোঝা উচিত, শারীরিক প্রহারের দ্বারা যে কোনো অন্যায় কর্ম থেকে শিশুকে থামানো যায় বটে কিন্তু তার তুলনায় শিশু মানসিকভাবে যা হারায় তার তুল্যমূল্য খুব বেশি। অনেক শিশু শারীরিক শাস্তির এই চিন্তা মনের মধ্যে অণুক্ষণ ধরে রাখে, যা ভেবে ভেবে নিজের মধ্যে নিজে নিপীড়িত হতে থাকে। এটাও অবাস্তব নয় যে, শারীরিক প্রহারের কালে কখনো বা শিশু মা-বাবাকেই উল্টো চড়-থাপ্পড় বসিয়ে দিতে পারে। তাই মা-বাবা ও অভিভাবকের উচিত, শিশুকে শাসনের কাজে যে কোনোরূপ শারীরিক শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকা। অথবা না মারলে নয় সেরূপ পরিস্থিতিতে সতর্কতার সঙ্গে তা প্রয়োগ করা শিশু যদি কোনো গুরুতর অন্যায় করে বসে বা বিশেষ অমান্য করে তাহলে চেয়ারের উপর বা রুমের নির্দিষ্ট স্থানে একটা সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে বলার মতো অশারীরিক শাস্তি প্রথমবারের মতো দেওয়া যেতে পারে। তবে শিশুকে শাসনের চাইতে তাকে আদব, আচরণ ও অন্যান্য নিয়মে শিক্ষিত করে তোলাটাই হলো আসল কাজ। কাজের নিয়মে বেঁধে দেওয়া, তার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া, তাকে যা বলার তা স্পষ্ট করে বলা ও বুঝিয়ে দেওয়া এবং ভালো করলে তাতে উৎসাহিত করা, প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা ইত্যাদি নার্সারি ক্লাসের একজন শিশুকে শৃঙ্খলা পূর্ণ করার জন্য দারুণ পদক্ষেপ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top