প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, রপ্তানি কমার শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা
প্রকাশিত:
১০ জুলাই ২০২৫ ১১:১৫
আপডেট:
১০ জুলাই ২০২৫ ১৮:২৭

বাংলাদেশে তৈরি ১০ ডলারের একটি চিনো ট্রাউজার বা টুইল প্যান্ট আমদানি করতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে ১৬ শতাংশ বা ১ দশমিক ১৬ মার্কিন ডলার শুল্ক দিতে হয়। গত এপ্রিলে বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ায় মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৬০ ডলার। আগামী ১ আগস্ট থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে এই চিনো ট্রাউজারে মোট শুল্কভার দাঁড়াবে ৫১ শতাংশ। তার মানে, ১০ ডলারের পোশাকটি আমদানিতে উচ্চ শুল্কের কারণে খরচ দাঁড়াবে ১৫ দশমিক ১০ ডলার (জাহাজভাড়া ছাড়া)।
এই হিসাব দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে আমাদের আর প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা থাকবে না। যেসব দেশে শুল্ক কম থাকবে, সেখানেই ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হবে। এই প্রক্রিয়াটি দু-তিন বছরের মধ্যে ঘটবে। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে হতাশা প্রকাশ করছে। চলমান ও ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশের বিষয়ে আগামী সপ্তাহ থেকে আলোচনা শুরু হতে পারে।
শোভন ইসলামসহ আরও কয়েকজন রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে তৈরি পোশাকসহ কোনো পণ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা করার অবস্থায় থাকবে না। ফলে বাংলাদেশের ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্যের রপ্তানি অনেকটাই ঝুঁকিতে পড়বে। ক্রয়াদেশ কমলে শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হবে কারখানাগুলো। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে অধিকাংশই তৈরি পোশাক, সেহেতু এই শিল্পেই বেশি প্রভাব পড়বে। তবে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর ট্রাম্প প্রশাসন কী হারে শুল্ক আরোপ করছে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় ৭ জুলাই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড় শুল্ক দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা এক চিঠিতে বাড়তি এই শুল্ক আরোপের বিষয়টি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি নিরসনের বিষয়ে সমাধান না এলে ১ আগস্ট থেকে দেশটিতে পণ্য রপ্তানিতে বর্ধিত হারে শুল্ক দিতে হবে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৭ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। এ ছাড়া মাথার টুপি বা ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা এবং অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য বেশি রপ্তানি হয়ে থাকে।
প্রতিযোগী দেশের শুল্ক কত
বৈশ্বিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ মোট ১৪টি দেশের ওপর নতুন করে শুল্কহার নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসের ৯০ দিনের শুল্কবিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে অর্থাৎ স্থানীয় সময় গত সোমবার এ ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিও মোটামুটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের পণ্যে বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলেও ভিয়েতনামের ওপর আরোপ হয়েছে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া মিয়ানমার ও লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ; ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ; দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া ও তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ; কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বিশ্ববাজারে শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। এর মধ্যে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার শুল্ক বাংলাদেশের চেয়ে কম। আর বাংলাদেশের চেয়ে কম্বোডিয়ার শুল্ক বেশি। যদিও চীন, ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর চূড়ান্তভাবে কত পাল্টা শুল্ক হবে, সেটি এখনো জানায়নি ট্রাম্প প্রশাসন। এখন চীনা পণ্যে গড় শুল্ক ৫৫ শতাংশ। আর ভারতের পণ্যে ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানি পণ্যে ২৯ এবং তুরস্কের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জানতে চাইলে প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, আলোচনার মাধ্যমে পাল্টা শুল্ক কমানো না গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা ভিয়েতনামের তুলনায় বেশ পিছিয়ে পড়ব। তার কারণ, বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনাম থেকে ১৫ শতাংশ কম শুল্কে পণ্য আমদানি করা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) সঙ্গে পাল্টা শুল্ক নিয়ে গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দফার আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। এই আলোচনা ১১ জুলাই পর্যন্ত চলবে। আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘যেসব কারখানা পণ্য রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বেশি নির্ভরশীল এবং আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী নয়, সেসব কারখানাই বেশি বিপদে পড়বে। তখন শ্রমিকদের আইনানুগ পাওনা বুঝিয়ে না দিতে পারলে তাঁরা রাস্তায় নামবেন। ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়বে। ফলে দর–কষাকষির যে সময়টুকু হাতে আছে, তা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে।’ সরকার এই আলোচনা কতটা গুরুত্ব দিয়ে করছে, সেটি ব্যবসায়ীদের কাছে পরিষ্কার নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ডিএম /সীমা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: