শনিবার, ২৭শে জুলাই ২০২৪, ১২ই শ্রাবণ ১৪৩১


প্রবাসী আয় যখন অর্থনীতির প্রাণশক্তি


প্রকাশিত:
১৩ মে ২০২৪ ১৪:৫৩

আপডেট:
১৩ মে ২০২৪ ১৫:২১

ছবি সংগৃহিত

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের আর্থসামাজিক বিকাশে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত। একজন বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মী তার পরিবার বা দেশে থাকা অন্যান্য ব্যক্তির কাছে প্রবাস থেকে যে অর্থ স্থানান্তর করেন তাই প্রবাসী আয় বলে বিবেচিত হয়।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রবাসী আয় উপার্জনে বিশ্বে সপ্তম স্থানে আছে। দক্ষিণ এশিয়াতে শুধু ভারত ও পাকিস্তানের প্রবাসী আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বেশি আসে সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও কুয়েত থেকে।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে শ্রমশক্তির চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রবাসের শ্রমবাজার আমাদের শ্রমিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। একদিকে যেমন প্রবাসী শ্রমিকদের আয় সামষ্টিক অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করছে, অন্যদিকে তাদের পাঠানো অর্থ দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

পাঁচ দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রবাসী আয়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনাটা তাই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। সময়ের পালাবদলের হাত ধারে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের একটি গঠনমূলক পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট অভিবাসনের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে শ্রমিকদের অস্থায়ী দেশান্তর। বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রবাসী আয়ের প্রভাব নিয়ে আলোচনার আগে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঁচ দশক জুড়ে মোট অভিবাসন ও প্রবাসী আয়ের ওপর আলোকপাত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই বাংলাদেশ অন্যান্য দেশে কর্মী প্রেরণের মাধ্যমে তার প্রাথমিক সম্পদ মানব পুঁজি ব্যবহার করার দিকে মনোনিবেশ করে। এই কৌশল সত্তর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে তেল সম্পদ উত্তোলনের বৃদ্ধির সময় গতি লাভ করে এবং মূলত মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের প্রবাসে কর্মী অভিবাসনের মূল এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে অভিবাসনের সংখ্যাটা যেখানে ছিল মাত্র ৬ হাজার, ২০০৭ সালে তা পৌঁছে রেকর্ডসংখ্যক ৮ লাখ ৭৫ হাজারে। তবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট স্বাভাবিকভাবেই বিদেশের শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করেছিল।

যার সাময়িক প্রভাব আমরা দেখতে পাই ২০১১-১২ থেকে শুরু করে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত অভিবাসনের সংখ্যা হ্রাসের মধ্য দিয়ে। তবে পরবর্তী বছরগুলোয় অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের দিকে খানিকটা উন্নত হতে শুরু করে এবং ২০১৭ সালে গিয়ে অভিবাসনের সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১০ লাখ অতিক্রম করে।

তবে ২০১৮-১৯ সালে অভিবাসীর সংখ্যা হ্রাস পায় এবং ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে তা একেবারে কমে যায়। এরপরে মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে অভিবাসনের সংখ্যা পুনরায় বাড়তে থাকে এবং ২০২৩ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ অভিবাসন হয় যা সংখ্যায় ১৩ লাখেরও বেশি।

অভিবাসন সংখ্যার তারতম্য থাকলেও দেশে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কিন্তু ক্রমাগত বেড়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৬ সালে প্রবাসী আয় ছিল মাত্র ২৪ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যা দশ বছরের মাথায় ১৯৮৫ সালে গিয়ে বিশ গুণেরও বেশি বেড়ে ৫০০ মিলিয়নে দাঁড়ায়। এরপর প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১ বিলিয়নের অঙ্ক অতিক্রম করে।

এরপর প্রবাসী আয় ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ৪ বছর যাবৎ ২১-২৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারের অধিক হয়েছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালেও প্রবাসী আয় ২৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে আশা করা যায়।

৫০ বছরের এই সামগ্রিক বিশ্লেষণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো–কোভিড ১৯ মহামারির সময়ে অভিবাসনের সংখ্যা একেবারে নিচে নেমে গেলেও একই বছরে প্রবাসী আয় ২১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দুরবস্থার সময় দেশের প্রবাসীরা দেশের মানুষের সাথে সর্বাঙ্গীণভাবে সাথে ছিলেন।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নে প্রবাসী আয় একটা বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ছিল জিডিপি-এর ৪.৫৬ শতাংশ, মোট রপ্তানি আয়ের ৪২.৭১ শতাংশ এবং মোট আমদানি ব্যয় পরিশোধের ২৫.৪৯ শতাংশ। এক কথায় বলতে গেলে প্রবাসী আয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায়, জাতীয় সঞ্চয় বাড়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণে (ভেলসিটি অব মানি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

প্রবাসী আয় প্রবাহের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার একটি স্থির জোগান নিশ্চিত হয় যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ভারসাম্য স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। এছাড়া প্রবাসী আয় লাখ লাখ পরিবারে নগদ অর্থ প্রদান করে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে, পরিবারগুলো দরিদ্রতার করাল গ্রাস থেকে উদ্ধার করে এবং প্রবাসী আয়ের ফলশ্রুতিতে পরিবারগুলো উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পায়। তাই বলা যায়, প্রবাসী আয় দারিদ্র্য বিমোচনসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখে।

আবার প্রবাসী আয় স্থানীয় ব্যবসায় বিনিয়োগ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে এবং প্রবাসী আয় গ্রহণকারী পরিবারসমূহের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে। এছাড়া প্রবাসী আয় সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে, যেমন–বিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্মাণ যার ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়।

যথেষ্ট পরিমাণ প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে, যা বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দিকে দেশকে পরিচালিত করে। অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের এত ধরনের প্রভাবের কারণে প্রবাসী আয়কে অর্থনীতির প্রাণশক্তি বলা যায়।

প্রবাসী আয়ের প্রবাহকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ বেশকিছু নীতি বাস্তবায়ন করছে। সরকার অভিবাসীদের বাড়িতে টাকা পাঠানোর জন্য ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করতে উৎসাহিত করার জন্য নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের ইনওয়ার্ড প্রবাসী আয় আনার অনুমতি দিয়েছে, যার লক্ষ্য হলো প্রক্রিয়াকে সহজ করা এবং আইনি চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি প্রবাসী আয় আকৃষ্ট করা।

বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কোনো মতেই বেশি বলা যাবে না। এর মূল কারণ প্রবাসী কর্মীরা সাধারণত অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যেখানে তার আয়ের পরিমাণ বেশি নয়। তাদের নিজের ভরণ-পোষণের খরচ জুগিয়ে দেশে পাঠানো প্রবাসী আয় তাই খুব বেশি হয় না।

আবার দেখা যায়, প্রবাসের ভাষা না জানা থাকার কারণে প্রবাসী কর্মীরা দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ভালো কাজ পায় না। প্রবাসী কর্মীদের কারিগরি ও ভাষাগত দক্ষতার অভাবের বিষয়ে সরকার সচেতন। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দক্ষতামূলক কোর্সসহ নানা ধরনের ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এছাড়া দক্ষতামূলক কোর্সে সনদগুলোর আন্তর্জাতিক সনদায়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও সরকার গ্রহণ করেছে। এর বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবে কর্মরত অদক্ষ ও আধা-দক্ষ কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ সরকার থেকে প্রদান করা হচ্ছে যাতে তারা পরবর্তীতে দক্ষ পেশায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

এই সবই প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে সরকারের পক্ষ থেকে উৎসাহবাঞ্জ্যক কাজ। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার পথ পরিক্রমার জন্য প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একমাত্র বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

এজন্য প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ করা যাতে একজন শিক্ষার্থী কোনও একটি নির্দিষ্ট ট্রেডে দক্ষতা অর্জন করে আন্তর্জাতিক সনদায়নের মাধ্যমে প্রবাসে দক্ষ পেশায় নিযুক্ত হতে পারবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা উজ্জ্বল। শুধু সঠিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতির এই প্রাণশক্তিকে বলীয়ান করতে হবে।

সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top